আমেরিকার শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকদের প্রবেশ নিয়ে ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন নীতির পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক আবার শানিত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকার হাইস্কিলড বা উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কারিগরি শ্রমিকদের আমেরিকায় আনতে ট্রাম্প প্রশাসন কতটুকু সহনীয় হবে? অন্যদিকে দক্ষ কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমিগ্র্যান্ট ব্যতিরেকে আমেরিকায় টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রি কতটুকু সচল থাকবে?
এ মতভেদ শুধু ট্রাম্পের সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে নয়; বরং যারা ট্রাম্পকে নির্বাচনে সহায়তা করেছে, তাদের মধ্যেও রয়েছে। এক্ষেত্রে যারা ট্রাম্পের সঙ্গে আছেন, সেই বিশ্ববিখ্যাত ইলন মাস্কও দক্ষ শ্রমিকদের ইমিগ্রেশনের পক্ষে। এই মাস্ক ট্রাম্পের জন্য বিলিয়ন ডলার খরচ করে ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এম্পাওয়ারমেন্ট (ডিওজিই)-এর তত্ত্বাবধায়ক হয়েও ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন নীতির বিরোধিতা করছে। যদিও তা প্রকাশ্যে নয়, তথাপি তার টেক ইন্ডাস্ট্রি সচল রাখতে তার দক্ষ ইমিগ্রান্টের প্রয়োজন। তার সঙ্গে টক্করে রয়েছেন ধনকুবের ডেভিড স্যাকস, যিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়ালি ইন্টেলিজেন্সের প্রধান বা বিরাট ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। এ ব্যক্তি ক্রিপ্টো কারেন্সির নীতি নিয়েও কাজ করেন।
টেক ইন্ডাস্ট্রি পরিচালনার জন্য আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি দক্ষ শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক্ষেত্রে স্ববিরোধী নীতি গ্রহণ করেছেন। একদিকে তিনি দক্ষকর্মীদের ওয়ার্ক ভিসা দেওয়ার পক্ষে। অন্যদিকে তিনি সীমান্ত বন্ধ করেছেন এবং আমেরিকানদের চাকরি সৃষ্টির জন্য ট্যারিফ বসিয়েছেন এবং ভয়ানকভাবে ইমিগ্রেশন কমিয়েছেন। এর আগে ট্রাম্প অনুরক্ত বলে খ্যাত গভীরভাবে দক্ষিণপন্থী লাওরা লুমার- যার কথায় ট্রাম্প সম্প্রতি অনেক লিবারেল নিরাপত্তা অফিসারকে চাকরিচ্যুত করেছেন, তিনি একসময় এক ভারতীয়-আমেরিকান শ্রীরাম কৃষ্ণননের ন্যাচারালাইজড নাগরিকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পলিসি উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের সমালোচনা করেছিলেন। কারণ তার মতে, শ্রীরাম কৃষ্ণনন ইমিগ্রেশন পলিসি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর তার প্রভাব খাটিয়ে তৃতীয় বিশ্বের ইমিগ্র্যান্টদের অনুপ্রবেশ ঘটাবেন।
মিস লাওয়া লুমার এক্সে লিখেছেন, ইতিমধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, ট্রাম্পের আমেরিকা প্রথম এজেন্ডার পরিবর্তে ট্রাম্প প্রশাসনে বামপন্থী লোকের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। মিস লুমার তাঁর ডানপন্থী বিষোদগার সামনে নিয়ে আসছেন। যখন ট্রাম্পের নির্বাচনে যেসব বিজনেস হাউজ এইচ ওয়ান বি ভিসার মাধ্যমে বিদেশ থেকে দক্ষ লোক নিয়োগ করে তাদের ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি করেছেন, তারা সমর্থন জুগিয়েছেন।
অবশ্য তার এ মতের বিরুদ্ধে একসময় লুমারের সমালোচনাকারী স্যাকস লিখেছেন- শুধু তাই নয়, ইলন মাস্কও তার কলামে বলেছেন, আমেরিকায় জন্মানো তেমন মেধাবী লোক নেই- যাদের দিয়ে আমেরিকান টেকনোলজি কোম্পানিগুলো তৈরি করা যায়। একসময় মাস্ক লিখেছেন, আমেরিকান কোম্পানিতে নিয়োগ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ বিশেষজ্ঞ আমেরিকায় নেই।’ অথচ নির্বাচনের আগে এই মাস্ক বলতেন, ডেমোক্রেটিক পার্টি অবৈধদের উৎসাহিত করছে, যাতে তারা আমেরিকান ভোটারের প্রতিপালন করতে পারে। অথচ এই ইলন মাস্ক নিজেই দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মানো এক ন্যাচারালাইজড সিটিজেন। একসময় নিজেই ছিলেন অনাগরিক আর এখন অনাগরিকদের ডাকছে ‘অনুপ্রবেশকারী’। আবার দেখা গেছে, এখন ইলেকট্রিক কার কোম্পানি টেসলার মালিক মাস্ক ২০২৪ সালেই ৭২৪টি এইচ ওয়ান বি ভিসা নিয়েছেন তিন বছরের জন্য। তারা এই ভিসার মেয়াদ বাড়াতে পারে। কিংবা গ্রিনকার্ডের আবেদন করতে পারেন। অবশ্য লুমার ও মাস্কের এসব হম্বিতম্বি মার্কা কথার বিরুদ্ধে কৃষ্ণনন বা স্যাকস কোনো সরাসরি কথা বলছেন না।
মিস লুমার মনে করেন, ইলন মাস্ক ‘মগা’ সমর্থক নয়। বরং তিনি ট্রাম্পকে ব্যবহার করছেন একজন ট্রিলিয়নিয়ার হওয়ার জন্য।
একসময় তার প্রচারণাকালে ট্রাম্প বলেছিলেন যেসব আন্তর্জাতিক ছাত্র, যারা আমেরিকায় গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন, তাদের এ দেশে বসবাস করতে পারা উচিত। এ কারণে ধনকুবের মার্ক জুকারবার্গ, জেফ বেজোস ও গুগলের সান্ডার পিছাই মার-এ-লাগোতে গিয়ে ট্রাম্পের উদ্বোধনীর জন্য ডোনেশন দেন।
এদিকে এখন শোর উঠেছে মাস্ক ডিওজিই থেকে বিদায় নিচ্ছেন। ট্রাম্প তাকে রাখার জন্য কিছু বলছেন না। তার টেসলা কোম্পানিতে উঠেছে শ্রমিক অসন্তোষ তাকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। এদিকে ডিওজিইর আরেক ঠাকুর(!) রামস্বামী বলেছেন, এইচ ওয়ান বি এক ভেঙে পড়া সিস্টেম। এই সিস্টেমকে সর্বোত্তম কারিগরের ওপর আরো ভালো কারিগর আনার জন্য নবায়ন করতে হবে। তবে মাস্কের যদিও ডিওজিই থেকে সরে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে ঠাকুর রামস্বামীর কি হবে তা নিয়ে আলোচনা নেই। কারণ রামস্বামী এখন ঝোঁক বুঝে কোপ মারার তালে আছেন। ট্রাম্পের রাজত্বে কে কোন সময় ‘ঠাকুর’ আবার কে কোন সময় পদলেহী হয় তা বলা মুশকিল।
ট্রাম্পের যেন একসময় মোদির সঙ্গে তার সখ্য ছিল, আর এখন আমেরিকায় ট্যারিফ নিগ্রহে মোদি নিষ্পেষিত হচ্ছে। তেমনি শিগগিরই ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানের দরজা অবাধ হয়ে গেলে তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। ইমিগ্রেশন চলতি পথে যেভাবে হোঁচট খেয়েছে এ ব্যবস্থা, তা আবার ফিরে পথ চলতে কতক্ষণ?