০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, সোমবার, ০২:৫২:৫৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্টিত , সহজ গ্রুপে ব্রাজিল - যুক্তরাষ্ট্র ডি গ্রুপে স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া


ড. ইউনূসের চীন ও ব্যাংককে ঈর্ষণীয় সাফল্য
মোদি-ইউনূসের সাক্ষাতে গা-জ্বালা আ.লীগের
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৪-২০২৫
মোদি-ইউনূসের সাক্ষাতে গা-জ্বালা আ.লীগের ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি


চীন সফর থেকে থাইল্যান্ড। সর্বত্র প্রধান উপদেষ্টার জয়জয়কার। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে পরিচিতি ও বিভিন্ন সেক্টরে ঘুরে বেড়ানোর যে অভিজ্ঞতা সেটা বাংলাদেশের মানুষ ইতিপূর্বে টের পায়নি। জীবনের বড় একটা সময় পার করে এবার দেশের দায়িত্ব পেয়ে নিজের ওইসব অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের ক্যারিশমা জাহির করছেন। যে সফলতার উদ্ভাসিত আলোতে বাংলাদেশের মানুষও অভিভূত। ইতিমধ্যে তাকে নিয়ে গর্ব করছেন তার নিন্দুকেরাও। চীনে তার কদর ও বাংলাদেশে বিভিন্ন সহায়তার পাশাপাশি চায়নারা যে সম্মান দেখিয়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তার তাৎক্ষণিক সুফল ২ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার সহায়তা আদায় করে আনা। এরপর ব্যাংককে যে সফলতা তার মধ্যে সর্বাগ্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ৪০ মিনিট সময় ধরে বৈঠক এবং প্রাণবন্ত ওই বৈঠকের ফল কী হবে না হবে সেটা পরের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের যে চাহিদা সেটাই নরেন্দ্র মোদির কাছে অকপটে বলতে পেরেছেন ড. ইউনূস। যার মধ্যে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া ও তার কতিপয় কর্মকাণ্ড যে বাংলাদেশের মানুষের জন্য অস্বস্তির সেটা জানিয়ে দেওয়া।

এর পাশাপাশি দ্বিপাক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ও রয়েছে। সর্বোপরি, প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ভারতের সঙ্গে যে একটা বৈরী ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল, সেটা এ বৈঠকের মাধ্যমে অনেকটাই দূরীভূত হয়েছে। আওয়ামীপন্থী অনেকেই ভেবেছিলেন, মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখনো শেখ হাসিনাকেই মনে করেন এবং তাকে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই পুনর্বাসন করবেন। কিন্তু ড. ইউনূসের সঙ্গে মোদির বৈঠকের পর ওইসব স্বপ্ন ধুলায় মিশে উড়ে গেছে। এখন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নিয়ে ভারতের নতুন পরিকল্পনার ছক আঁকা হতে পারেও বলেও অনেকে মন্তব্য করছেন। এবং সেটা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের অনুকূলে হবে না বলেও মন্তব্য আসছে।

আওয়ামী লীগের মনোবল তলানিতে

নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক হোক ড. ইউনূসের এটা মোটেও কাম্য ছিল না আওয়ামী লীগের। মোদি পাত্তাই দেবে না ইউনূসকে এটাই ছিল তাদের প্রচারণা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদিন আগে যখন কনফার্ম হলো তখনো ভাবতেই পারছিল না কী হবে। এরপর ড. ইউনূস যা করেছেন, তাতে একটি ছবিতে নরেন্দ্র মোদিকে খুশিতে গদগদ অবস্থা। কেননা বছর দশেক আগে এ মোদিই ইউনূসকে স্বর্ণপদক পরিয়েছিলেন, সে ছবি দীর্ঘদিন পর এবং বর্তমান সময়ে যে তিক্ততা ইউনূসে, সে ইউনূসই যখন মোদির হাতে স্মৃতিময় ছবি তুলে দিলেন, মোদি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। অবয়ব হয়ে ওঠে উজ্জ্বল। হেসেই ফেলেন। কারণও আছে। ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আগে যা ছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তার এ পর্যন্ত যে কর্মযজ্ঞ সেটা মোদি তো ভালোই বিশ্লেষণ করেছেন। ফলে এমন এক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বগ্রহণযোগ্য ব্যক্তির সান্নিধ্যে যাওয়া ও তার কাছ থেকে প্রশংসামূলক আচরণ পাওয়া মানেই মোদির দারুণ সন্তুষ্টি। 

কিন্তু মোদি ও ইউনূস ও মোদির এমন হাসিতে জ্বলে পুড়ে আঙ্গার আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ ৭ মাস ধরে ভেবেই রেখেছিল কখনো না কখনো এই মোদিই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করবে। সেই মোদি এমন ৯০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে ঘুরে যাবে সেটা কী মেনে নেওয়ার মতো? 

কী অলোচনা হয়েছে সেটা পরের কথা। কারণ দ্বিপাক্ষিক স্বার্থে বাংলাদেশকেও লাগবে ভারতের, বাংলাদেশেরও লাগবে ভারতকে। ফলে অভিমান করে গুটিয়ে থাকলে লস উভয়েরই। আর সে জট পাকিয়েছে যেখানে ভারত এমননি মুহূর্তে ইউনূস আগ্রহ প্রকাশ করে যখন দেখা করেছেন তখন ওই জট পলিটিকসে পাকা মোদি কেন ছাড়বেন। হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যে বাংলাদেশে অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে সেটা তো সে নিজেও জানেন। ফলে ইউনূসের এ হাত বাড়িয়ে দেওয়া, বরং দুই দেশের জন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিষয়াদি মোকাবেলাতেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। 

শুরুটা চীন থেকে 

চীন সফরে ড. ইউনূসের সফলতার মধ্যে রয়েছে, সেদেশের সরকার ও চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋত ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি লাভ। এর মধ্যে দেশটির প্রায় ৩০টি কোম্পানি বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। 

এছাড়া মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋত দেবে চীন। চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে আরো ১৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। অনুদান ও অন্যান্য ঋত সহায়তা হিসেবে আসবে বাকি অর্থ। 

এছাড়াও বাংলাদেশের বিদ্যমান শুল্ক ও কোটামুক্ত রফতানি সুবিধা আরো দুই বছর বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে চীন। এর আগে চীনা বাজারে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই সুবিধা ছিল। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে চীনা উপ প্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েশিয়াংয়ের এক বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে চীনা উপ প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন।

চীন বাংলাদেশ থেকে আম নিতে আগ্রহী। বাংলাদেশও চীনে আম পাঠাতে চায়। বাংলাদেশ চীনে আম রফতানির জন্য ৬ বছর আগে দেশটির কাছে আবেদন করেছিল। তবে নানা জটিলতায় সেটা আর কার্যকর হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের মধ্যে দিয়ে সে দেশে আম রফতানির দুয়ার খুলেছে। আগামী মে-জুন মাস থেকে চীনে আম রফতানি শুরু হবে। এর মধ্যে দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশি আমের চাহিদা বাড়বে। তবে এ সফরে বড় সফলতা তিস্তা প্রকল্পে সহায়তা। তিস্তা নদী প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক আগেই থেকে চীনের সহায়তা চেয়ে আসছে বাংলাদেশ। এবার প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে এই প্রকল্পে সহায়তার আশ্বাস মিলেছে। তবে শুধু তিস্তা প্রকল্প নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি ড. ইউনূস। তিনি নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীন থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক চীন সফরে সে দেশের পানিসম্পদমন্ত্রী লি গোইয়িংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেসময় নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। বৈঠকে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও ঢাকার চারপাশের দূষিত পানি পরিষ্কারের বিষয়ে সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে একটি চুক্তি ও ৮টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতা-সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়েছে। এছাড়া দুই দেশের চিরায়ত সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে সই হয়েছে ৮টি সমঝোতা স্মারক। বেজিংয়ে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথমত বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে। দীর্ঘক্ষণ হয় সে বৈঠক। এতে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু ছাড়াও আলোচনায় উঠে আসে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যুটি- রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। চীন এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন নীরবই ছিল। কথা বললেও সেখানে দৃঢ়তা দেখেনি কেউ। এবার চীন জানাল বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা। এ সমর্থন কেবল কূটনৈতিক নয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। চীনের রাষ্ট্রনায়কদের কাছে বলা হয়েছে বাংলাদেশ বড় রকমের সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন এক সময় চীনকে পাশে চেয়েছিল বাংলাদেশ। সে সমর্থনও আদায় করেছেন ড. ইউনূস। এছাড়াও বাংলাদেশের পুরোনো এ বন্ধু দেশ, রাষ্ট্র সংস্কার, ব্যবসা, জনসমর্থন তিনটিতেই চীন বাংলাদেশকে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। এ আশ্বাস বাংলাদেশের জন্য বড় কিছু। ড. ইউনূস তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন এটা বাংলাদেশের জন্য শুধু দরকারি নয়, আনন্দেরও। 

চীনের সফলতা নিয়ে দেশে ফিরে আবারও তিনি রওয়ানা হন ব্যংকক। সেখানে বড় সফলতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ৪০ মিনিট জুড়ে আলোচনা। এখানে তিনি বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশার বিষয়গুলো উচ্চস্বরে বলেছেন। তার বলার ঢং এমনটাই ছিল যে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে একজনই কথা বলেছেন, তিনি শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এরপর প্রফেসর ড. ইউনূসই পেরেছেন সে টোনে কথা বলতে। যা ব্যাংকে মোদির সঙ্গে আলোচনায় বলেছেনও। ভারতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া, বাংলাদেশের তিস্তার ন্যায্য হিস্যা থেকে শুরু করে নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু। সামনে বিশ্বের অন্যতম একটা শক্তিশালী দেশের প্রধানমন্ত্রী। ড. ইউনূস ওসব থোড়াই কেয়ার করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্র্রীর যতটুকু সম্মান সেটা তিনি দিয়ে একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নেতা হিসেবেই কথা বলেছেন ড. ইউনূস। মোদিও সবকিছু শুনেছেন এবং একযোগে কাজ করার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন যার মধ্যে ছিল সেভেন সিস্টার্স ইস্যুতে এমন কোনো বক্তব্য যেন তিনি না দেন, যাতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। 

যার অর্থ সেভেন সিস্টারর্সকে নিয়ে চীন সফরে যে বক্তব্য ইউনূস দিয়েছেন সেটাতে বেশ গাত্রদাহ হয়েছে ভারতের। তবে এ আলোচনায় ভারত বাংলাদেশের মধ্যে আঞ্চলিক সমঝোতার এক দ্বার উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেভেন সিস্টার্সসহ অন্যান্য ইস্যুতে। ৫ আগস্টের ভারত তাদের দেশে বাংলাদেশের লাখ লাখ পর্যটকের ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। দুই দেশের বাণিজ্যে টানাপড়েন। এ বৈঠকে ওইসব জটও খুলতে শুরু করবে। 

এছাড়াও বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ, চীনের পর থাইল্যান্ডের মধ্যে যাতায়াতে ভিসা প্রক্রিয়া সহজিকরণ, থাইল্যান্ডের সঙ্গে দুর্নিতির বিরুদ্ধে যৌথভাবে কাজ করার চুক্তি স্বাক্ষর, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাওয়া ও আশ্বাস লাভসহ অনেক কিছুতেই যে প্রাপ্তি এটা কেবল ড. ইউনূস বলেই সক্ষম হয়েছে- এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

শেয়ার করুন