২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৮:১৯:১৪ পূর্বাহ্ন


ক্ষুধামুক্ত জনশক্তি গড়ে তুলুন
সুলতানা রিজিয়া
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৩-২০২২
ক্ষুধামুক্ত জনশক্তি গড়ে তুলুন


সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের বিভাগীয় শহর, শিক্ষানগরী, রেশমশিল্পে মখমলি এবং আম্রকাননের শহর রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের অন্যতম নান্দনিক এবং ব্যয়বহুল যমুনা সেতুর কল্যাণে উত্তরবঙ্গের মাটিতে প্রবেশ করা এখন খুবই সহজ হয়েছে। এককালের প্রমত্তা যমুনা নদী পারাপারে ফেরির নানাবিধ সমস্যা, সময়ের অপচয় এবং রাজধানী ঢাকার সাথে শিল্প-বাণিজ্যের সংযোগসাধনে জনসাধারণের দাবির প্রেক্ষিতে যমুনা সেতুর গোড়াপত্তন। বাংলাদেশের আপামর জনতার বিন্দু বিন্দু অর্থ (ট্যাক্স) এই সেতুর সাথে সম্পৃক্ত। ফলে সকলের প্রাণাধিক প্রিয় যমুনা সেতুর কল্যাণে আজ ফেরি পারাপারের দুর্গতি, দুর্ঘটনা ও সময় হননের অভিশাপের নাগপাশ থেকে আমজনতা মুক্ত। বর্ষাকালে যে নদী বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হয়, সেই নদীই পরবর্তীতে ঋতু পরিবর্তনে এবং আন্তর্জাতিক ( প্রতিবেশী দেশ ) পানিচুক্তির সুসম বণ্টনের অভাবে বিশুষ্ক, নির্জীব হয়ে পড়ে। সবে শীত পেরিয়ে  চলছে চৈত্রের রোদেলা উষ্ণতা। বাতাসে উত্তাপের ঝাঁঝ। অপেক্ষমাণ গ্রীষ্ম ঋতু। এরই মধ্য এককালের এই বাংলার




সুলতানা রিজিয়া 


প্রমত্তা পদ্মার বোন নামে খ্যাত ( জনশ্রুতি) স্রোতস্বিনী যমুনা নদীর বুকে চরের আধিপত্য প্রকটভাবে লক্ষণীয়। 

জল নেই, তাই নৌযান চলাচলের প্রশ্নই আসে না। সাদা, ধূসর চরের বুকে কোথাও কোথাও দুর্দমনীয় সবুজ ঘাস, লতাপাতা গজিয়ে উঠেছে। এই সবুজের লাবণ্য টিকে থাকাটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

গ্রীষ্মের তাপদাহে শুরু হবে খরা, ধূলিধূসর চরাচরে বইবে ধূলিঝড়ের তপ্ত হাওয়া। প্রকৃতির বুকে থৈ থৈ জলের আকাল বাড়ায় জলশূন্য হবে গ্রামীণ জনপদের ডোবা-নালা, খাল-বিল। ঘরে ঘরে পানীয় জলের অভাবে দেখা দিবে রোগবালাই, বাড়তি পরিশ্রম। নদীবাহিত জলযানের অভাবে কৃষিজাত শস্যপণ্যাদিসহ সকল উৎপন্নসামগ্রী নদীপথের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। বিকল্পের কারণে বাড়বে পরিবহনের খরচ। এমন অজুহাতে আবারো সরবরাহকারীরা (মধ্যস্বত্বভোগী) মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিবে। আমজনতা তাতে নতুন করে অসহায়ত্বের চোরাবালিতে নিপতিত হবে।

আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে সেটাই স্থায়ী হয়ে যায়। নামার কোনো লক্ষণ থাকে না। বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসব, পালা-পার্বণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, বন্যা বা ঝড়ঝঞ্ঝায় ক্ষতিগ্রস্ত সিংহভাগ দরিদ্র মানুষ অন্ধকারে তলিয়ে যায়। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল সাহায্য-সহযোগিতা কিম্বা ত্রাণের রসদ নয়ছয়ে উচ্ছন্নে যায়। প্রকৃত অভাবগ্রস্ত মানুষের নাগালে সঠিক সময়ে কিম্বা পরিমাপে সাহায্য পৌঁছে না।

নবাব শায়েস্তা খানের সময়কার বাজার দর আমাদের কাছে ছিলো রূপকথাসম। আমরা সেই শৈশব থেকে অদ্যাবধি বিস্ময়ে আকণ্ঠ ডুবে আছি। শতবছরের অধিককাল অতীতের সেই রাজ্যও নেই, বাজার দরের মাপকাঠিও নেই। তবে আমাদের আমলের ৫০/৬০ দশকে ষোলআনায় এক টাকা, কড়া, গণ্ডার হিসাব শিখতে শিখতে টাকা, আনা, পাই-এর দিনে সুখেই কাটায়েছি। বনেদি খাবারের তালিকায় ছিলো দুই টাকা সের কই মাছ, গরুর মাংস, রুই-কাতলা থেকে সবটাই। চার-পাঁচ টাকার বাজার করলে চার পয়সার কুলি (এখনকার মিন্তি ) ডাকতে হতো। চাল, ডাল, তেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠতো না। বাড়িঘর যেমনই হোক তার চারপাশে ছিলো শাকসবজি, আনাজপাতি, ফলবান বৃক্ষের সুনিবিড় ছায়াঘন সবুজের সমারোহ। কচুরলতি, ঢোককলমির বাথান, বাঁশের জাংলায় বা ঘরের চালে লতিয়ে ওঠা সবুজের লাবণ্য। নিদারুণ অভাব কি? আমরা বুঝতে পারতাম না। মাছে-ভাতে বাঙালির জীবনযাপনে বিলাস না থাকলেও সুখ-শান্তি ও স্বস্তির নিশ্চয়তা ছিলো। দাদি, নানি, মা, খালা, চাচিদের ছিলো ঘরসংসারে দোর্দণ্ড প্রতাপ। তাদের রাজ্যে পুরুষরা যেমন কর্তৃত্ব ফলাতেন না, তেমনি পুরুষদের বহির্জগতের (ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামারে) শ্রমবাজারে তারা (নারীরা) নাক গলাতেন না। এক অর্থে নারী-পুরুষের সম্মিলিত শ্রমে ছোট-বড় একান্নবর্তী সংসার দস্তুর মতো চলতো। পুরুষের আয়ের উপরে নারীরা যেমন ষোলআনা নির্ভরশীল ছিলেন না, তেমনি পুরুষরাও তাদের কর্মহীনতায়, রোজগারে ব্যর্থতায় বিশ্বাস করতেন ঘরে ফিরে গিয়ে নিদেনপক্ষে  শাকসবজি, লতাপাতা, শাপলা-শালুক, কচুভর্তা সহযোগে দানা পানি পাবেন।

ক্রমান্বয়ে মানুষ বেড়েছে, জায়গা-জমিন ভাগবাটোয়ারায় একান্নবর্তী পরিবার টুকরো টুকরো হয়েছে। শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে কম-বেশি সকলেই জেলা-উপজেলা, শহর-বন্দরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমদানি-রফতানি নীতির পথ ধরেই দেশ-বিদেশের সাথে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির আদান প্রদানে প্রবাসীর সংখ্যাও স্ফীত হয়েছে। আধুনিকতার জয়যাত্রা, সাথে তথ্যপ্রযুক্তির মেলবন্ধনে জীবনযাপনেও লেগেছে আমূল পরিবর্তনের ছোঁয়া।


‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ

কেড়ে নিয়েছে আবেগ’।


কৈশোরকালে পাঠ্যক্রমে আমরা ভাবসম্প্রসারণে মনের শব্দকথার ভাণ্ডার উজার করে দিয়েছি। আবেগকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে যুক্তির মালা গেথেছি।

কখনো ভাবিনি আমরা বিজ্ঞানের কোন সে পর্যায়ে পৌঁছে বেগকেই আত্মস্থ করতে পারবো। কিম্বা নিত্যনৈমিত্তিক অনুষঙ্গস্বরূপ অভ্যস্ত হয়ে উঠবো। গুগলের কল্যাণে বিশ্ব তো এখন হাতের মুঠোয়। কখন, কোন কোন দেশে কি ঘটছে এমন সব তথ্যের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচাল সবই নেটদুনিয়ায় উদ্ভাসিত। ক্রমান্বয়ে সুর উঠছে মুক্তবাজারের সাথে তাল মেলানোর কূটচাল। এই মুক্তবাণিজ্যের নামে আমরা বিশ্বের অর্থের মানদণ্ডের সাথে ঠোকর খাচ্ছি। আমাদের অর্থের ভারসাম্যহীনতায় নিজেরাই পতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছি। বিশ্বের প্রথমসারি দেশের অর্থের সাথে আমাদের অর্থের সমন্বয়ের যুক্তি দাঁড় করাচ্ছি। একবারও ভাবছি না ডলার, পাউন্ডসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার সাথে আমাদের টাকার মূল্যায়নের ফারাকটা কত শতাংশ! ফলে শুভঙ্করের ফাঁকির গ্যাঁড়াকলে আমাদের জীবনযাপনের অষ্টপ্রহর নিষ্পেষিত হচ্ছে। নুন আনতে পান্তাও ফুরাচ্ছে।

জীবনের ভয়ঙ্করতম চাহিদা বা অসুখের নাম ক্ষুধা।

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’।

এই অসুখে মৃত্যু অবধারিত। তাই অসম মুক্তবাজার অর্থনীতির পাশ কাটিয়ে বাঁচার জন্য কম-বেশি সকলেই সন্ধিসলুকের দ্বারস্থ হচ্ছে। বাড়ছে ক্রাইম। অর্থলিপ্সার অসৎ সংক্রমণে সিংহভাগ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ছল-বল-কৌশলের চর্চায় মানুষের মানবিক মেধা, সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতা কলুষিত হচ্ছে। পচন ধরছে মানবীয় গুণাবলির মাহাত্মে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এর মারণ ছোবলের চেয়েও অর্থলিপ্সার সংক্রমণ আত্মঘাতী নেশায় অধিক। স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, পেশিশক্তিসহ অন্যান্য জঘন্যতম চক্রান্তসমূহ বিষবৃক্ষের আদলে পুরো দেশটাকে গিলে খাচ্ছে। দেখার কেউ আছে বলে মনে হয় না। বলারও কেউ নেই। এই বিষবৃক্ষ এতোটাই বেপরোয়া, একরোখা এবং জ্যামিতিক নকশায় এতোটাই মজবুত যে স্বাধীন সার্বভৌম এই বাংলাদেশের ত্রিশ লক্ষ শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তের ধারা আজ শ্রীহীন, গৌরবহীন, মর্যাদাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে।


এক সাগর রক্তের বিনিময়ে

বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা

আমরা তোমাদের ভুলবো না।


প্রাণছোঁয়া সুর, দৃপ্ত শপথের বাণীর (গীতিকবিতা)  মর্মার্থ বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত করার প্রধান এবং একমাত্র পথ ক্ষুধামুক্ত (দারিদ্র্যমুক্ত) জনশক্তি গড়ে তোলা। আইনের শাসন কায়েম করা। বিচারের রায় বহাল রাখা। প্রয়োজনে দেশ ও জাতির পচনকারীদের উপড়ে ফেলা। তাহলেই জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করাটা তাৎপর্যমণ্ডিত হবে এবং আগামী জন্মশতবার্ষিকীর উৎসব হয়ে উঠবে গৌরবান্বিত ও দীপ্তিময়। বিশ্বের বিস্ময়।


শেয়ার করুন