২০ মে ২০১২, সোমবার, ০২:০৭:৫৩ পূর্বাহ্ন


৭১’এর ঘাতকরা নীরবে মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করছে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৫-২০২৪
৭১’এর ঘাতকরা নীরবে মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করছে জাহানারা ইমামকে নিয়ে আলোচনায় উপস্থিতি


শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মূল কমিটির আলোচনা সভা আলোচকরা বলেন, ৭১-এর ঘাতকরা নীরবে বিভিন্নভাবে মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ার পরও ’৭১-এর ঘাতকরা কিন্তু থেমে নেই, তারা বিভিন্নভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছে, কারণ তারা সংগঠিত, তাদের অর্থের অভাব নেই, সদস্যেরও অভাব নেই। এজন্য ‘জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের আন্দোলনে তরুণদের নেতৃত্ব দিতে হবে’। 

গত ৩ মে শুক্রবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘জাহানারা ইমামের আন্দোলনে তরুণদের দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র কেন্দ্রীয় আইটি সেলের সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তপন পালিতের সভাপতিত্বে এবং অনলাইন বহুভাষিক সাময়িকী ‘জাগরণ’-এর সহকারী সম্পাদক আবৃত্তিশিল্পী সুশীল মালাকারের সঞ্চলনায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ব্লগার লেখক মারুফ রসূল।

উক্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদান করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইটি সেলের সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর, নির্মূল কমিটির আইন সহায়ক কমিটির সদস্য ড. খন্দকার তানজির মান্নান, চলচ্চিত্রনির্মাতা ইসমাত জাহান, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট শামস রাশীদ জয়, সাংবাদিক আবু সালেহ রনি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আশেক মাহমুদ সোহান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্র ও জগন্নাথ হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অপূর্ব চক্রবর্তী।

মূল প্রবন্ধে ব্লগার লেখক মারুফ রসূল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মই নব্বইয়ের দশকে শহীদজননীকে ঘিরে রচনা করেছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নব্বইয়ের তারুণ্য। এই যে উত্তর প্রজন্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের মেলবন্ধন- আমরা যদি ইতিহাসনিষ্ঠ হই, তবে স্বীকার করতেই হবে, এই যুগলবন্দী থেকেই জন্ম নিয়েছিল ২০১৩ সালের পারাবারপ্রতিম শাহবাগ আন্দোলন।’ তিনি আরও বলেন, ‘লক্ষ জনতার স্রোতে সেইদিন শহীদজননী ছিলেন এমন এক মোহনা- যেখানে এসে মিশেছিল মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী প্রতিটি প্রজন্ম। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে তিনি চিনতে শিখিয়েছিলেন আতশকাচ দিয়ে। কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই নয়, একটি অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য জনমানসিকতায় যে সংবেদনশীলতা প্রয়োজন ঘড়ির বয়স্ক কারিগরের মতো জাহানারা ইমাম তা শনাক্ত করেছিলেন। আমাদের ধর্ম, আমাদের মত, আমাদের জীবনাচরণের বাইরেও যে সুন্দর একটি পৃথিবী আছে তা স্বীকার তো দূরের কথা, সহ্যই করতে পারি না। এই কারণেই আমাদের সহিষ্ণুতা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আমরা এখন অনুভূতির রাজনীতি শুরু করেছি; যেহেতু আমরা জেনে গেছি, আমাদের অনুভূতিসমগ্র কার্যত অর্থহীন। অনুভূতি অর্থহীন হলেই আধিপত্যবাদ চাগাড় দিয়ে ওঠে। কোনো না কোনোভাবে নিজেকে জানান দিতে হবে তো! রাষ্ট্র যেমন জানান দেয় লালনের গানের দুই পঙ্ক্তি শেয়ারকারীকে গ্রেফতার করে, গরিষ্ঠসংখ্যক মুসলমান যেমন জানান দেয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন করে কিংবা আহমদীয় সম্প্রদায়ের জলসায় আক্রমণ করে, বাঙালি যেমন জানান দেয় আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন করে।’

নির্মূল কমিটির আইন সহায়ক কমিটির তরুণ সদস্য ড. খন্দকার তানজির মান্নান বলেন, শহীদজননী জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ত হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোর মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত রাখতে পারলে এদেশের কল্যাণের জন্য ত্যাগ স্বীকারে ইচ্ছুক মানুষের অভাব হবে না। তিনি বলতেন, এই প্রজন্মের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আগামী দশকগুলোর যোগ্য প্রতিনিধি। আর সে লক্ষ্যেই এ প্রজন্মকে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘জেনো সাহসই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।’

তিনি আরো বলেন, ‘জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে পুনর্জাগরিত করেছিলেন। সৃষ্টি করেছেন নতুন ইতিহাস। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক, যিনি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে জ্বেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। জাহানারা ইমাম বেঁচে আছেন কোটি বাঙালির হৃদয়ে। তিনি ছিলেন পথনির্মাতা ও পথপ্রদর্শক।’

চলচ্চিত্রনির্মাতা ইসমাত জাহান বলেন, শহীদজননী জাহানারা ইমাম যদি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন না করতেন, তাহলে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সমমনা কট্টরপন্থি দলগুলো এখনকার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী থাকত।

অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট শামস রাশীদ জয় বলেন, প্রগতিশীলতা একটি প্রক্রিয়া, একটি চর্চা। প্রগতিশীলতার আন্দোলনও একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই আন্দোলন তারুণ্যের পরম্পরা। আমরা যদি দেখি ২০১৩ সালে শাহবাগ গণজাগরণের সময় যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাংগঠনিক কাজ করেছেন, বিশেষ করে গণমাধ্যমে এটা এগিয়ে নিয়েছেন সেই মানুষগুলো ২১ বছর আগে ৯২ সালে গণ আদালতের আন্দোলনের সময় মাঠকর্মী বা সমর্থক ছিলেন, ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের।

সাংবাদিক আবু সালেহ রনি বলেন, শহীদজননী জাহানারা ইমামের আদর্শ ও দমে না যাওয়ার নীতি বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণার উৎস। তরুণরা তার আদর্শকে ধারণ করে বলেই ১৯৯২ সালের পর ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০১৩ সালে প্রথম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনও চলছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই এখনও শেষ হয়নি। তরুণরা নানাভাবে বিভক্ত। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বাস্তবায়নে তরুণদেরকেই নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আশেক মাহমুদ সোহান বলেন, আজ থেকে দুই যুগেরও বেশি সময় আগে র্নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাগণ সমস্বরে উচ্চারণ করেছিলেন, স্বাধীনতার শত্রুরা যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে বিচরণ করবে ততদিন পর্যন্ত একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারব না। আমাদের কোন উন্নয়ন কার্যক্রমই সফল হবে না। এ কারণেই স্বাধীনতার শত্রুদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। আজ এতদিন পরে এসেও কথাটি কতটা প্রাসঙ্গিক তা উল্লেখ করা প্রয়োজন, আজ যখন কোন উন্নয়নের বার্তা প্রকাশিত হয় তখনই হঠাৎ একদল মানুষ তার বিরুদ্ধে বুলিং শুরু করে দেয়, আবার সাংস্কৃতিক উৎসব পালনের সময় ধর্মের নাম করে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে চায়। তবে তারা কখনই সফল হতে পারে না, আমাদের তরুণদের বুঝতে হবে এখনও স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি, স্বাধীনতা বিরোধীদের চেয়ে শক্তিশালী। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অপূর্ব চক্রবর্তী বলেন, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে এবং মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে জাগানিয়া কন্ঠস্বর ছিলেন জাহানারা ইমাম। ৩২ বছর পূর্বে তিনি রাজাকারদের বিচারের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেছিলেন। তার সেই সংগঠনের তাৎপর্য বাংলাদেশ এখন উপলব্ধি করতে পারছে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই লড়াই বর্তমানেও চলমান রয়েছে। 

সভার পর্যালোচনায় শহীদসন্তান আসিফ মুনীর বলেন, আজ শহীদজননী জাহানারা ইমামের ৯৫তম জন্মবার্ষিকীতে তরুণ প্রজন্মের সেই সব প্রতিনিধিরা শহীদজননীকে নিয়ে আলোচনা করলেন, যারা ১৯৯১-৯২ সালের জাহানার ইমাম ও তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেননি। কিন্তু আজ দেখছি জাহানারা ইমাম, শাহরিয়ার কবির, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর মত এই আন্দোলনের প্রবীণ নেতারা কিভাবে তরুণদের অনুপ্রাণিত করছে। শহীদজননীর ৯৫তম জন্মবার্ষিকীর এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে এক দিকে যেমন তরুণ নেতৃত্ব একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনকে নতুন প্রাণ সঞ্চার করছে অন্যদিকে শ্রোতার আসনে উপবিষ্ট এই আন্দোলনের আদি ও প্রবীণ নেতৃত্ব অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করছেন। এই ভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শহীদদের আর শহীদজননীর স্বপ্ন নবতর প্রজন্ম বাস্তবায়ন করবে।

সভাপতির ভাষণে নির্মূল কমিটির আইটি সেলের সদস্য সচিব গবেষক ড. তপন পালিত বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নির্মূল কমিটি। জাহানারা ইমামের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার করা সম্ভব হয়েছিল।

দিনের অনুষ্ঠানসূচি শুরু হয় সকাল ৮টায় মিরপুরে শহীদজননী জাহানারা ইমামের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে।

শেয়ার করুন