২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৯:২০:২০ পূর্বাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-০৬-২০২২
কথার কথকতা


মানুষকে ছাড়া মানুষের চলেনা, আবার মানুষই মানুষের অশান্তি ও ভোগান্তির কারন হয়ে ওঠে। অনেক সময় মানুষ নামক প্রাণিটিকে সুখে থাকতে ভ‚তে কিলায়। কথাগুলো শতকোটি বিলিয়ন ট্রিলিয়নবার মানব সমাজে পরীতি। প্রিয় পাঠকদের মধ্যে এ বিষয়ে ভিন্নমত থাকবে বলে আমার মনে হয় না। তাই এগুলোর ব্যপারে বিতর্কে যাচ্ছি না। শুধু সেদিন জ্যাকসন হাইটস যাতায়াতের অভিজ্ঞতাটুকু আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। ও হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো যে, এ লেখা পড়ে আপনার তেমন কোনো উপকার বা অপকার হবার সম্ভাবনা নেই। মিছেমিছি কিছু একটা করে কয়েকটা মিনিট পার করার জন্য একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।

সেদিন জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ প্লাজার বেজমেন্টে বাংলাদেশিদের আয়োজিত পরিবেশ বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান ছিলো। ওই কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত এক শুভাকাক্সক্ষী আমাকে ওতে যোগদানের জন্য দাওয়াত দিয়েছিলেন। এদিকে ছেলে বললো, সে তার মা এবং আমাকে নিয়ে লং-আইল্যান্ডে একটা আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক জায়গা দেখতে যাবার প্ল্যান করে রেখেছে, তার বড় খালার পরিবারের কেউ কেউ এ অভিযানে অংশ নেবে। আমি ছেলেকে জানালাম, ওই অনুষ্ঠানে থাকবো বলে কথা দিয়েছি আর আমি ছেলের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না। অবশেষে সবাই গেলো লং-আইল্যান্ডের দিকে আর আমি গেলাম জ্যাকসন হাইটের দিকে।

উইকেন্ড হবার কারণে ট্রেন এদিন সব স্টেশনে থামলো অর্থাৎ সব এক্সপ্রেস ট্রেন লোকাল হয়ে গেলো আর আমার পৌঁছতে এক ঘণ্টার জায়গায় দু’ঘণ্টার মতো সময় লেগে গেলো।

জ্যাকসনে গিয়ে ফোনে যথারীতি কিরন সাহেবের অবস্থান জানার চেষ্টা করলাম। মেসেঞ্জারে বিভিন্ন রসিকতা বিনিময়ের পরও তিনি কোথায় তা বুঝতে পারলাম না। তাই আমি পরিবেশ বিষয়ক অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে গেলাম। এ স্তরে আমার একটা ‘হিউম্যান এরর’ অর্থাৎ মানবিক ভুল হয়ে গেলো। আমি বাংলাদেশ প্লাজায় না গিয়ে জুইস সেন্টারে চলে গেলাম। পরে ফোনের মেসেঞ্জার চেক করে আসল জায়গায় পৌঁছলাম। অনুষ্ঠান ততণে শুরু হয়ে গেছে। কয়েকজনের বক্তৃতার পর স্ক্রিনে একটা ডকুমেন্টারি প্রদর্শন শুরু । কিরন সাহেবের ফোন এলো, তিনি সদলবলে নবান্ন রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেছেন। আমি আমার আসনটি একজন কংগ্রেসপ্রার্থীকে দিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ সংগ্রহ করে চলে গেলাম নবান্নতে। পেয়ে গেলাম কিরনের সাথে শিব্বীর, আবিদ এবং মশিউরকে, কিছুণ পর যুক্ত হলেন সবার প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় পল ভাই। চা পর্ব শেষে বেরিয়ে নবান্নর সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অনির্ধারিত কথাবার্তা এবং ছবিটবি তোলার পর মনে হলো, কিরন এবং আবিদ এই দুই সাহেব কুইন্স প্যালেসে যাবেন। পল ভাইজান আগেই খোদা হাফেজ জানিয়েছেন। আমি আর শিব্বীর ভাইজান মশিউর সাহেবের সাথে ঢুকলাম ‘প্রবাস’ পত্রিকা অফিসে। সম্পাদক সাঈদ ভাই যথারীতি জানালেন সহাস্য অভিনন্দন। মেহমানদারি হিসেবে পেলাম ওনার বাসা থেকে বানিয়ে আনা তেতুল চা, মিনি কাপে। আসলেই দারুণ লাগলো। শিব্বীর ভাইজানকে মনে হলো কিছু সময় মশিউর সান্নিধ্যে থাকবেন, প্রয়োজনেই। আমি সৌজন্য করেই বেরোলাম ‘ড্রিম লাইটার’ অফিসে যাবো বলে। সিইও সবুজ সাহেব অফিসে এসে ফোন করেছিলেন। সেখানে গিয়ে গেস্ট পেলাম দুজন। অনেক কথা হলো। আমার কিছু লেখালেখির কাজ এবং সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠবার তাড়া ছিলো বলে সবার অনুমতি নিয়ে বেরুতে চাইলাম। রাত তখন দশটার বেশি হয়ে গিয়েছিলো। বেরোনোর আগে সিইও সাহেবের সাথে একান্তে কিছু দাপ্তরিক কথাবার্তা হলো। এরপর বেরিয়ে ডাইভার্সিটি প্লাজা হয়ে ঢুকে গেলাম পাতালপুরীতে অর্থাৎ সাবওয়েতে। সেখানে আমার জন্য অপো করছিলো, যৎসামান্য অমøমধুর অভিজ্ঞতা অর্জন প্রক্রিয়া!

সাবওয়েতে ঢুকতে গিয়ে আটকে গেলাম। কার্ড সোয়াইপ করছি, কাজ হচ্ছে না। টেস্টিং মেশিনে যাচাই করে দেখলাম, কার্ডের ব্যালেন্স শেষ, কয়েকটা সেন্ট আছে মাত্র। কার্ডে টাকা (ডলার) ঢুকাতে গিয়ে দেখি কোনো মেশিনই বিল অর্থাৎ কাগজের ডলার নিচ্ছে না, ক্রেডিট কার্ড চাচ্ছে। এ অবস্থায় যিশুর মতো সুদর্শন এক ছেলে এগিয়ে এসে কি কি যেন বললো, সবটা বুঝিনি। তবে ‘টু ডলার’ কথাটা বুঝেছি। আমি ভাবলাম, সাহায্য চাচ্ছে। ওকে সাবওয়ে স্টেশানটিতে সদা সর্বদাই দেখা যায়। আমি অনেক ভেবে ওকে এক ডলার দিলাম। যখন আবার কার্ডে টাকা ঢুকানের চেষ্টা করছিলাম তখন সে আবার এগিয়ে এসে বললো, দুই ডলার দিলে সে আমাকে স্টেশনের ভেতর ঢুকিয়ে দেবে। বুঝতে পেরে ওকে এড়িয়ে যাবার জন্য বললাম, ‘আই গেভ ইউ ওয়ান ডলার, ওকে ইউ ওয়েট, মি কামিং’, এরপর সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে গেলাম। প্রিয় পাঠক, হয়তো বলবেন, তুমি এতো বোকা কেনো, এক ডলারতো লস হলো! তাহলে আসল রহস্য শুনুন। স্টেশানে ঢুকানোর এই বেআইনি সেবা দেবার জন্য দুই ধরনের লোক কাজ করে। এক ধরনের লোক আপনি মুশকিলে পড়লে আপনার কাছ থেকে তিন ডলার নিয়ে তার কার্ড সোয়াইপ করে আপনাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেবে, এতে ওদের পঁচিশ সেন্ট লাভ থাকে। অন্য ধরনের লোক লাফ দিয়ে ভেতরে ঢুকে ইমার্জেন্সি ডোর খুলে আপনাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দুই ডলার নেবে, পুরোটা তার লাভ। আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, আমি সুযোগটি কাজে লাগালামনা কেনো? তাহলে শুনুন এবং জেনে রাখুন, লাফ দিয়ে ঢুকা এই যে মানুষটি, আপনাকে ঢুকানোর পর যখন পুলিশ আপনাকে পাকড়াও করবে তখন তাকে কোথাও খুঁজে পাবেন না, আপনার জরিমানা হবে এবং রাষ্ট্রীয় রেকর্ডে আপনার দ্বারা সংসাধিত এই অপরাধটি পুরো জীবনের জন্য লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। কি বললেন? এরপর আমি কী করেছি? কিছু পথ-ঘাঁট আমি এরই মধ্যে চিনে ফেলেছি বলে চলে গেলাম ব্রডওয়ের বড় সাবওয়ে স্টেশনটিতে। ওখানে একটা মেশিনে কার্ডে ক্যাশ কারেন্সি ঢুকানোর সুযোগ পেলাম কিন্তু পুরা প্রতিক‚লতা বিবেচনা করে ঠিক করলাম, ট্রেনে যাবোই না, বাসে যাবো। ব্রডওয়েত অনেক সময় অপোর পর কিউ-৫৩ বাসে উঠলাম। এই বাসে উডহ্যাভেন-১০১ স্ট্রিট নেমে আমাকে আবার কিউ-৮ বাস ধরতে হবে। প্রিয় পাঠক, যন্ত্রণা সামনে কিন্তু আরো আছে! লেখাটা একটু বড় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাকি যন্ত্রনাটুকু না জানলে আপনিওতো শান্তি পাবেন না!

আমি উডহ্যাভেন-১০১ স্ট্রিট না নেমে ভুল করে আগের স্টেশনে নেমে গেলাম, হঠাৎ ‘আংকেল আংকেল’ ডাক শুনে পেছন ফিরে চাইতেই দেখলাম, এক ইয়ংম্যান আমাকে ডাকছে আর বলছে, আপনি ভুল জায়গায় নেমেছেন, ফিরে আসেন। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসে আবার বাসে উঠলাম। বিস্মিত হয়ে ভাবছি, আমি ডিসপ্লের লেখা পড়তে ভুল করলাম কি করে, ছেলেটি বাংলা বলছিলো, সে গাড়ি থামিয়ে রেখেছে অনুরোধ করে এবং আমি কোথায় নামবো তা সে জানলো কি করে! পরে মনে হলো, আমি এক বন্ধুকে ফোনে বলেছিলাম, কিউ-৫৩ থেকে নেমে আমি কিউ-৮ বাসে উঠবো। পরে দেখলাম, ওই বাংলাভাষী যুবক একই জায়গায় নেমেছে, সাথে একটি অল্প বয়েসী মেয়ে, সম্ভবত তার নতুন বউ হবে। ছেলেটিকে ধন্যবাদ দিলাম আবার। মেয়েটি বললো, আংকেল, বাসের জন্য অপো করবেন? আমরা ফোনে স্কেজুল দেখেছি, বাস আসবে ত্রিশ মিনিট পর, আমরা হাঁটা শুরু করলাম। আমিও সামান্য সময় অপো করে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তা কিন্তু কম নয়, ফর্বেল স্ট্রিটের সাথে কুইন্স শেষ করে এলডার্ট লেনের কাছাকাছি রাঁধুনী রেস্টুরেন্ট থেকে এক কাপ চা কিনে একটা পত্রিকা হাতে যখন বসলাম তখন রাত বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। প্রিয় পাঠক কি কোন মন্তব্য করবেন? যা-ই হোক, জানিয়ে রাখি, আমার বাসা কাছেই, বেশি দূরে নয়, কাগজে-কলমে এটি ব্রæকলিনে পড়েছে আর যাতায়াতের হরেক রকম সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্তে¡ও আমি মুশকিলে পড়েছি। জ্বী, বাসাটা ব্রæকলিনে পড়েছে আর মাইন উদ্দিন মুশকিলে পড়েছে!


শেয়ার করুন