১২ এপ্রিল ২০১২, বুধবার, ০২:৫৮:২৯ অপরাহ্ন


কি করেছেন আমার মুক্তির দাবিতে?
খালেদার ক্ষোভ ॥ ফখরুলের অগ্নিপরীক্ষা
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৮-২০২২
খালেদার ক্ষোভ ॥ ফখরুলের অগ্নিপরীক্ষা


জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাচলেটের বাংলাদেশ সফরের সময় মুক্তি দাবি করে রাজপথে কর্মসূচি না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এব্যাপারে বিএনপি’র বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে তিনি দোষারোপও করেছেন। দলের একটি বিশ্বস্ত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে ছিলেন। তবে ২০২০ সালের মার্চে বয়স ও মানবিক বিবেচনায় শর্ত সাপেক্ষে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান,যদিও বিএনপি খালেদা জিয়ার এমন মুক্তিকে ‘গৃহবন্দি’ দাবি করে। তবে সেসময়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তার বয়স ও মানবিক দিক  বিবেচনা করে সরকার এমন  সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেসময় মন্ত্রী আরো জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার দন্ডাদেশ স্থগিত করে ৬ মাসের জন্য তাকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে আরো বলা হয় খালেদা জিয়া চাইলে তিনি নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন তবে বিদেশ যেতে পারবেন না, এমন শর্তে তাকে মুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এবছরও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দন্ড স্থগিত করে আগের দুটি শর্তেই মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। তার মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে এবছর (২৩ মার্চ) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজায় কারাজীবন শুরু করেন খালেদা জিয়া। পরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও তার সাজার রায় হয় এবং তার বিরুদ্ধে আরও ৩৪টি মামলা রয়েছে। 

কী করেছে বিএনপি?

দুর্নীতির একটি মামলায় কয়েক ধরে কারাগারে ছিলেন বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার রাজনৈতিক জীবনে কখনো এত দীর্ঘসময় ধরে কারাভোগ করেন নি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ার থেকে ঢাকার পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে বিএনপি তার মুক্তির দাবিতে আইনি এবং রাজনৈতিক বেশ কিছু কর্মসূচি দিলেও কোন সুবিধা করতে পারেনি। তার মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রথমে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যেমন উপস্থিত থাকতেন তেমনি সারাদেশ থেকেও এসে ঢাকার বিভিন্ন কর্মসূচি যোগ দিতো। বিএনপি শীর্ষ পর্যায়ের মধ্য থেকে নেতাকর্মীদের এই ধারণা দেয়া হচ্ছে যে দেশে আদৌ আইনের শাসন আছে কি না এই মুহূর্তে সেটাই বড়ো প্রশ্ন। তাই আইনের শাসন যদি থাকলে অনেক আগেই দেশনেত্রী কারামুক্ত হতে পারতেন। এছাড়া মাঝে মধ্যে তার মুক্তি দাবি করলেও তা জোড়ালো হয়নি। 

বিদেশ পাঠানো দাবিতে নানান রহস্য

দলের এই নেত্রীর মুক্তির দাবিতে বিএনপি তেমন জোড়ালো কর্মসূচি দিতে না পারলেও মাঝে মধ্যে অসুস্থ খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে গণঅনশনে করেছে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এধরনের কর্মসূচি নিয়ে বেশ সন্দেহ অবিশ্বাসও দেখা দেয় দলের ভেতরে। কেননা খোদ খালেদা জিয়া বেশ কয়েকবারই জানিয়েছেন কোনো ধরনের আপোষ-রফা করে তিনি দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যেতে চান না। সেখানে কারা খালেদাকে বিদেশ পাঠানোর নামে গণঅনশনের মতো কর্মসূচি দিতে বিএনপি’কে উৎসাহিত করে? কারণ অসুস্থ খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পেতে তো অবশ্য সরকারের কাছে শর্ত নিয়ে দেশ ত্যাগ করতে হবে। এব্যাপারে খালেদা জিয়া যেমন রাজি হবেন না তেমনি সরকারও ছাড় দেবে না। তাহলে গণঅনশনে বসতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের কারা আশ্বস্থ করে তা নিয়ে দলে বেশ ককেবার প্রশ্ন রয়ে যায়।  

মিশেলের সফর ও খালেদার ক্ষোভ

এ মাসে চারদিনের সফরে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাচলেট। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে তার এই সফর। এমনটাই এক বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সদর দফতর। এতে আরো বলা হয়, জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেট সরকারের আমন্ত্রণে রোববার থেকে বাংলাদেশে সরকারি সফর করবেন। জাতিসংঘের কোনো মানবাধিকার প্রধানের এটিই ছিল প্রথম কোনো সরকারি সফর। মিশেল ব্যাচেলেট ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠকের কথাও জানিয়েছে সে বার্তায়। এছাড়া তিনি দেশে কর্মরত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। এর পাশাপাশি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শনও করেন তিনি। 

এছাড়া বিএনপি’র নেতাদের সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন। রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিএনপির চার সদস্যের প্রতিনিধি দল জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল সাথে বৈঠক করে। বৈঠক শেষে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে জানিয়েছে বিএনপি। কিন্তু এতোসব করার পরও কেনো মিশেল ব্যাচলেটের বাংলাদেশ সফরের সময় মুক্তি দাবি করে রাজপথে কর্মসূচি না দেয়া হয়নি এটা জানতে চেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সম্প্রতি জন্মদিন উপলক্ষে খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সামনে তিনি খোলামেলা কথা বলেন। জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে জানতে চেয়েছেন তার মুক্তি দাবি করে বিএনপি আসলে কি করেছে? খালেদা জিয়া সরাসরি বলেন, কি করেছেন আমার মুক্তির দাবিতে। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, মুক্তির বিষয়টা তার ব্যক্তিগত দাবির বিষয় না। 

একটি গণতান্ত্রিক দেশ বলে দাবি করা সরকার কিভাবে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীর প্রতি আচরণ করছে তা তুলে ধরে রাজপথ প্রকম্পিত করতে পারতো বিএনপি। কেননা যুক্তরাজ্যও তাদের পার্লামেন্টে বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এবং চলমান নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক অবস্থা ও চরম অমানবিক আচরণসহ সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বেআইনিভাবে আটক রাখা এবং তার প্রতি অমানবিক আচরণের বিষয়টি প্রকাশ করেছে। 

জাতীয় অর্ন্তজাতিক পর্যায়ে এটি বেশি আলোচিত হতো বিশেষ করে মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেলের সফরের সময়ে। প্রথমে কারাবন্দি পরে শর্ত দিয়ে গৃহবন্দির বিষয়টি তুলে ধরতে পারতো বিএনপি মাঠ কর্মসূচির মাধ্যমে বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেলের সফরের সময়। কেননা র‌্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক প্রধানের এই সফর অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।  বেগম খালেদা জিয়া এনিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে অনেক বকাঝকাও করছেন বলে দলের একটি সূত্র জানায়। এমনকি তাকে বলে দিয়েছেন আগামীতে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি যেনো কর্মসূচির প্রধান এজেন্ডা হয়। 

মুক্তি দাবি উঠলো আবার, দেয়া হবে কর্মসূচি

জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাচলেটের বাংলাদেশ সফরের সময় মুক্তি দাবি করে রাজপথে কর্মসূচি না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশের পর থেকে বিএনপি’র কর্মসূচিতে পরিবর্তন এসেছে, দাবিতে উঠে এসেছে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রসঙ্গ। এখন থেকে নির্বাচনকালী সরকারসহ সরকারের গুম-খুন আর অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে কর্মসূচির পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেও কর্মসূচি থাকবে বলে দলের একটি সূত্র জানায়। এরই প্রমাণ পাওয়া যায় ১৬ আগস্টবিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘গৃহবন্দি’ দাবি করে তার নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।বিএনপি মহাসচিব এসময় আরো বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনীতির ইতিহাস লিখতে হলে বেগম খালেদা জিয়ার নাম আসবে। খালেদা জিয়া এবং গণতন্ত্র- এই দুটো বিষয় অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। খালেদা জিয়া জাতির প্রয়োজনে, সময়ের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজন সাধারণ গৃহবধূ হয়েও গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করবার জন্যে সামনে এসে দাঁড়ালেন। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর থেকে তিনি সারা জীবন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও গণতন্ত্র চর্চার জন্য সংগ্রাম করে আসছেন। যার কারণে আজ তাকে আওয়ামী লীগ সরকার মামলা দিয়ে গৃহে অন্তরীণ করে রেখেছে।

শেষ কথা

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞমহল মনে করেন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে বিএনপি হঠাৎ নিরবতাকে সরকার বেশ ভালোভাবেই নিয়েছে। এতে করে খালেদা জিয়াকে তারা রাজনৈতিকভাবে কৌশলে মাইনাস করে দেখানোর সুযোগ নিয়েছে। বিষয়টি বিএনপি’র শীর্ষ পর্যায়েও আলোচিত হয়েছে। আর কৌশলকে বিএনপি’কে ব্যবহার করা হয়েছে জেনেই খালেদা জিয়া দলের মহাসচিবকে সর্তক করে দিয়েছেন। সামনের দিনে দেখা যাবে বিএনপি মাঠে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে কতটা সক্রিয় হয়। আবার খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে মাঠ গরম করতে না পারলে দলের মহাসচিবের ভাগ্যেও যে দুর্ভোগ আছে তা-ও বলা অপেক্ষা রাখে না। সেক্ষেত্রে এটাও যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অগ্নি পরীক্ষা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 


শেয়ার করুন