২৩ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ১১:২৯:৪৮ পূর্বাহ্ন


সিলেটে জলাবদ্ধতা ও বন্যা নিয়ে বেন-এর আলোচনা সভা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-১০-২০২২
সিলেটে জলাবদ্ধতা ও বন্যা নিয়ে বেন-এর আলোচনা সভা বেনের সভায় বক্তব্য রাখছেন শরিফ জামিল


বৃহত্তর সিলেটের জলাবদ্ধতা ও হাওর অঞ্চলে বন্যার কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও পরামর্শ উপস্থাপন করেছেন পরিবেশবিদরা। একইসঙ্গে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় রক্ষায় আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সাধারণ জনগনকে এই আন্দোলনে যুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) গত ২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন)-এর বৈশ্বিক সমন্বয়কারী ড. মো. খালেকুজ্জামান এভাবেই সিলেট অঞ্চলের জলাবদ্ধতা ও বন্যার প্রাকৃতিক ও মনুষসৃষ্ট কারণগুলো অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।  

অনুষ্ঠানে পরিবেশবিদরা বলেন, প্রকৃতি কীভাবে কাজ করে তা মানুষকে বুঝতে হবে। বিশেষ করে বন্যা থেকে বাঁচতে সব সময় যে বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে তা হলো, নদীনালা, খালবিলসহ প্লাবন ভ‚মি কোনোভাবেই ভরাট করে নষ্ট করা যাবে না। তারা বলেন, প্লাবন ভ‚মিতে বাড়িঘর বা স্থাপনা তৈরি করলে এমনভাবে করতে হবে যাতে নিচ দিয়ে পানি সহজে চলাচল করতে পারে।

সিলেট শহরের জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে শহরটির আশপাশে কত নদীনালা রয়েছে সেগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা কত তা নির্ধারণ করতে জরিপ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বেন এর বৈশ্বিক সমন্বয়কারী ড. আব্দুল খালেকুজ্জামান। এ ছাড়াও তিনি বন্যা থেকে রক্ষায় কী কী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে তা তুলে ধরেন।

পরিবেশ রক্ষায় করণীয় গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে চাপে রাখতে পরিবেশবাদীদের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন প্রয়োজন বলে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রতিকালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে এবং বহু রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু দেশের পরিবেশের দ্রুত অবক্ষয় সাধিত হচ্ছে। যে কোনো দিকে তাকালেই এই অবক্ষয় লক্ষ করা যায়। এর একটি দৃষ্টান্ত হলো দেশের নদ-নদী ও জলাশয়ের পরিস্থিতি। বহু নদ-নদী শুকিয়ে গেছে এবং দখল হয়ে গেছে। খাল-বিল, পুকুর, দীঘি, হাওর-বাঁওড় হারিয়ে যাচ্ছে। যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা আজ চরমভাবে দূষিত। বহুস্থানে দূষণের কারণে নদীতীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বন ও পাহাড়ের দিকে তাকালেও পরিবেশের অবক্ষয় চোখে পড়ে। এমনিতেই বাংলাদেশে বনের পরিমাণ কম। কিন্তু যেটুকু বা ছিলো তা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। শিল্পায়ন এবং নগরায়নের কারণে মধুপুর এবং গাজীপুরের শালবন বিলীন হওয়ার পথে। বসতি স্থাপন, বাগান ও অন্যান্য কৃষির সম্প্রসারণ, বিভিন্ন সরকারি এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বৃহদাকার নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ইত্যাদি কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে ও বিপন্ন হয়ে পড়ছে। সেই সাথে পাহাড়ি জনগণের জনজীবন-সংস্কৃতি হুমকির মুখে। তিনি আরো বলেন, সুন্দরবনের অতিনিকটে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের এই বন বিপদগ্রস্ত। যানবাহন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কালো ধোঁয়া, নিয়ন্ত্রণহীন নির্মাণকাজ, ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ইটের ভাটা স্থাপন ইত্যাদি কারণে শহর ও গ্রাম উভয় স্থানে বায়ু আজ দূষিত। কঠিন, তরল এবং বায়বীয় বর্জ্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। প্লাস্টিক বর্জ্য দেশের সর্বত্র মাটি এবং জলাশয়সমূহকে দূষিত এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বন্যার প্রকোপ বাড়ছে, জলাবদ্ধতা বিস্তৃত হচ্ছে, নদীভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, উপক‚লীয় এলাকা সমুদ্রসীমার নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের জীববৈচিত্র্য লোপ পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভারে দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ আরো ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। পরিবেশের এই সামগ্রিক অবক্ষয় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিকে ম্লান করে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি চায়। তিনি বলেন, ২০০০ সালে বাপা প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা পরিবেশ রক্ষায় সংগ্রাম করে যাচ্ছি। এই সংগ্রামের ফলে অনেক সাফল্যও অর্জিত হয়েছে। যেমন, কালো ধোঁঁয়া উদগীরণকারী স্কুটারসমূহ অপসারিত হয়েছে। দেশে সিসামুক্ত গ্যাসোলিন চালু হয়েছে। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপিত হয়েছে। দেশে নদীরক্ষা আন্দোলনের সূচনা ও প্রসার ঘটেছে এবং এই আন্দোলনের ফলে সরকার প্রথমে নদীরক্ষা টাস্ক ফোর্স এবং পরে নদীরক্ষা কমিশন গঠন করেছে। নদ-নদীর তীরে অবৈধভাবে নির্মিত বহু স্থাপনা অপসারিত করেছে। নদ-নদীকে দূষণমুক্ত করার জন্য কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জলাশয় রক্ষা আইন ও পরিবেশবান্ধব নির্মাণ বিধিমালা গৃহীত হয়েছে। আরো অনেক পরিবেশরক্ষা অভিমুখী নীতি, আইন, বিধি, আদেশ ইত্যাদি গৃহীত হয়েছে। কিন্তু পরিবেশের অব্যাহত অবনতি প্রমাণ করে যে, এযাবৎ গৃহীত পদক্ষেপসমূহ পরিবেশ রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত হয়নি। 

তিনি বলেন, এই অসন্তোষজনক পরিস্থিতির একটি কারণ হলো বাস্তবায়নের সমস্যা। অর্থাৎ ভালো নীতি গৃহীত হলেও সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না। যেমন উচ্চ আদালত ঢাকার চতুষ্পার্শ্বের নদ-নদীর সীমানা পিলার স্থাপনের মাধ্যমে চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছিল যাতে দখল রোধ করা যায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যেয়ে জেলা প্রশাসনসমূহ নদ-নদীর শীতকালীন প্রবাহের সীমানা ধরে পিলার স্থাপন করে। ফলে ভ‚মিদস্যুদের জন্য নদীতীর দখল আরো সুগম হয়েছে। এরূপ আরো বহু উদাহরণ প্রমাণ করে যে, পরিবেশ রক্ষার্থে নীতি গ্রহণ পর্যাপ্ত নয়। সেসব নীতির সমূহের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন এবং সেজন্য  প্রশাসনকে প্রভাবিত করা জরুরি। কিন্তু আরো ভালোভাবে তলিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, চ‚ড়ান্ত বিচারে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রভাবিত না করে পরিবেশ-সপক্ষ নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাও কঠিন। প্রশাসনকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিকট জবাবদিহি করতে হয়। ফলে, প্রশাসনের আচরণও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং, পরিবেশ সপক্ষ নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন উভয়ই শেষ বিচারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা এবং সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রভাবিত করার জন্য প্রয়োজন হলো জনসমর্থন। সুতরাং পরিবেশ আন্দোলনকে দেখাতে হবে যে, তার পেছনে জনসমর্থন রয়েছে। তাহলেই কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবেশ আন্দোলনের দাবি এবং সুপারিশসমূহের প্রতি প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিতে উদ্বুদ্ধ হবে। তদুপরি পরিবেশ আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন দৃশ্যমান হলে এই আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন আরো বৃদ্ধি পাবে। 

পরিবেশ রক্ষার প্রতি জনসমর্থন প্রদর্শন এবং বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) দেশের পরিবেশ-দরদী অন্যান্য সংগঠনের সহযোগে আগামী ১৩ জানুয়ারি ঢাকার শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে পরিবেশের পক্ষে এক মহাসমাবেশের আয়োজন করেছে। সারা দেশ থেকে এই সমাবেশে যারা যোগ দিবেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বাপার সদস্য ও শুভানুধ্যায়ী; নদ-নদী এবং পরিবেশ রক্ষার্থে যেসব আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার অংশগ্রহণকারীরা; নদীভাঙন, উপকূল প্লাবন ও নিমজ্জন, বন উজাড় এবং পরিবেশের অন্যান্য অবক্ষয়ের ভুক্তভোগী জনগণ; দূষণ দ্বারা আক্রান্ত কলকারখানার শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ; পরিবেশ সচেতন তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, ও যুবসমাজের সদস্যরা;  নারী সমাজ ও নারী আন্দোলনের সদস্য ও প্রতিনিধিবৃন্দ; দেশের রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী সম্প্রদায়, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, ও মিডিয়া জগতের পরিবেশ সচেতন প্রতিনিধিবৃন্দ; সমাজের অন্যান্য বিভিন্ন স্তর ও বর্গের পরিবেশ-দরদী গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ; এবং পরিবেশ-দরদী সকল মানুষ। মহাসমাবেশের থাকবে আকর্ষণীয় কর্মসূচি। এতে থাকবে দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিবেশের সমস্যা এবং সংগ্রামের অভিজ্ঞতা; পরিবেশ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য; পরিবেশ-দরদীদের শুভেচ্ছা; বাপার মূল বক্তব্য এবং মহাসমাবেশের ঘোষণা গ্রহণ। আরো থাকবে পরিবেশবিষয়ক কবিতা আবৃত্তি, সংগীত, পালা, নাট্যাংশ, নৃত্যনাট্য, ও বিভিন্ন প্রদর্শনী। মহাসমাবেশের শুরুতে থাকবে তরুণ-তরুণীদের আকর্ষণীয় প্যারেড এবং সবশেষে গণমিছিল। যারাই বাংলাদেশের পরিবেশ সুন্দর দেখতে চান তাদের সকলের জন্য পরিবেশ মহাসমাবেশে অংশগ্রহণ অবশ্যকরণীয়। পরিবেশ মহাসমাবেশে যোগ দেয়া আপনারও কর্তব্য! এই কর্তব্য পালনে এগিয়ে আসুন! বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষা করুন।

বেন-এর নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও কানেকটিকাটের সমন্বয়কারী অধ্যাপিকা রানা ফেরদৌস চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বেন-এর উপদেষ্টা ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ। এতে বক্তব্য রাখেন  কলামিস্ট ও লেখক সুব্রত বিশ্বাস, আর্কিডিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার সুফিয়ান এ খন্দকার, বেন-এর যুগ্ম সমন্বয়ক ড. ফারুক জামানসহ বেশ কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথি।

অনুষ্ঠানে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক টেলিকনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন এবং সিলেটের বন্যা এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

শেয়ার করুন