১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৭:৩২:৩২ অপরাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-১১-২০২২
কথার কথকতা


কোনো পুত্র কী তার পিতার মৃত্যু কামনা করে? প্রিয় পাঠকবৃন্দ, জানি, আমার এই আট শব্দের ছোট্ট প্রশ্নবোধক বাক্যটি পড়ে প্রায় প্রত্যেকেই লাফিয়ে উঠেছেন এবং নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে একটা মন্তব্য বেরিয়ে পড়েছে: ‘এই লোকটায় কি কয়, মাথা ঠিক আছে তো?’ কিন্তু আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু যখন এবারের লেখার নির্ধারিত বিষয়ের কথা শুনলো, তখন সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো: ‘মানুষ নিজের জীবন নিজেই বিসর্জন দিতে পারলে পিতার মৃত্যু কামনা করাও অসম্ভব নয়।’ কিন্তু প্রিয় পাঠক, ঘটনাটি ছিলো আমাদের ভাবনার চেয়েও অনেক জটিল। বিশেষ পরিস্থিতিতে পিতার মৃত্যু কামনা করেছিলো যেই পুত্র, তার মুখেই আমি ঘটনাটি শুনেছি। শুনে আমি সত্যিকার অর্থেই নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের জানার বাইরে মানুষ যে কতো রকমের জটিলতা এবং করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় তা চিন্তাই করা যায় না।

পিতার মৃত্যু কামনার মতো পরিস্থিতি বেশ কয়েক প্রকারে সৃষ্টি হতে পারে। জমিজমা ভাগাভাগি নিয়ে হতে পারে, লোকটি কোনো অনৈতিক বিষয়ে জড়িয়ে পড়লেও হতে পারে। এই ধরনের কামনার উদ্রেক করানোর মতো বিষয় সংখ্যায় খুব বেশি নয়। আমাদের আজকের আলোচ্য ঘটনার সংশ্লিষ্ট পিতার উল্লিখিত দুটি কারণের কোনোটার সাথেই সম্পৃক্ততা ছিলো না। ওনার ক্ষেত্রে কাজ করেছিলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটি কারণ।

এই ভদ্রলোক সরকারি চাকরি করতেন। চাকরি জীবনে যথারীতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলায় বদলি হয়েছেন। আপন জেলাতেও লম্বা সময় ছিলেন রিটায়ারমেন্টে যাবার আগের সময়টাতে। এ সময় তিনি অনেকেরই উপকার করেছেন। ঘুষ ছাড়া কাজ করতেন, যার জন্য তাঁর অনেক সহকর্মী ওনার ওপর খুশি থাকতে পারতেন না।

তিনি একসময় পাশের জেলায়ও পোস্টিং পেয়েছিলেন। ওখানে জয়েন করতে গিয়ে দেখেন, অফিসেরই একজন স্টাফের নামে বিভাগীয় একটি মামলা হয়েছে। যা-ই হোক, এতে তাঁর উদ্বিগ্ন হবার বিষয় ছিলো না, কিন্তু ডিপার্টমেন্টের অনেক কিছু আত্মসাতের অভিযোগ আছে শুনে অস্বস্তিবোধ করেছেন। অনেকেই জানেন, এ জাতীয় মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে অন্যান্য মামলার চেয়েও অনেক বেশি সময় লাগে।

ওই বিষয়টি আর কখনো আমাদের আলোচিত ভদ্রলোকের সামনে আসেনি। তিনি ওখান থেকে আপন জেলায় বদলি হয়ে এসে দীর্ঘসময় চাকরি করার পর রিটায়ারমেন্টে গিয়েছেন, তাও অনেক বছর হয়ে গেছে। এ অবস্থায় একদিন হঠাৎ তিনি পাশের জেলার আদালত থেকে একটা চিঠি পেলেন এই মর্মে যে, সাক্ষী হিসেবে ওনাকে আদালতে হাজির হতে হবে। মামলা হচ্ছে সেই বহুদিন আগের ওই জেলা অফিসের সেই মামলাটি। একদিকে ইনি আদালত সম্পৃক্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ নন, অন্যদিকে অসুস্থতা ওনাকে প্যারালাইজ করে ফেলেছে। তিনি নড়াচড়া করতে পারেন না। ওনার ছেলেদের মধ্যে একজন ছোট, আরেকজন বিদেশে, অন্য একজন ঢাকায় চাকরি করে। এদের কেউই আদালত বিষয়ে অভিজ্ঞ নয়।

এদিকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের ওসি সাহেব একদিন সিভিল ড্রেসে ওনার বাড়ি গিয়ে যথাবিহিত সম্মানের সাথে যা জানালেন তাহলো, হাজিরা দেয়াটা অপরিহার্য। ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন যে, হাজিরা দিতে না পারলে ওনাকে হাজির করানো হবে। অচল শরীরেও তিনি বিব্রত হয়ে পড়লেন। আইন-আদালত বোঝে এরকম মানুষ তিনি চেনেন, সুসম্পর্কও ছিলো, কিন্তু রিটায়ার করার পর অনেকেই পর হয়ে গেছে। শরীর অচল হবার পর সারা পৃথিবীই পর হয়ে গেছে।

ভদ্রলোক কাউকে দিয়ে ডাকযোগে বড় ছেলেকে সব জানিয়ে একটা চিঠি পাঠালেন যার সাথে শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ডাক্তারি সব ডকুমেন্টও ছিলো। ছেলের হাতে যখন এগুলো পৌঁছে, তখন কোর্টে হাজিরার তারিখ মাত্র দু’দিন পর। কিন্তু সমস্যা তো একটা নয়, অনেক। ওনার ছেলেও আইন-আদালত সম্পর্কে অজ্ঞ, পিতার আদর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে আর্থিকভাবে দুর্বল। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট জেলার কিছুই চেনে না। উপরন্তু ঝড়ো আবহাওয়ায় রাজধানী প্রায় অচল। এক সহকর্মীর সাথে সমস্যাটি আলাপ করলো। দু’জন মিলে কুরিয়ার সার্ভিসের সন্ধানে বেরোলো। কোথাও কোনো সার্ভিস খোলা নেই। খোঁজাখুঁজি প্রক্রিয়ায় দু’জনই কাকভেজা হয়ে গেলো, ছাতা থাকা সত্ত্বেও। কারণ ঝড় চলছেই। পুত্রের হঠাৎ শ্যাওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছের একটা কুরিয়ার সার্ভিসের সাইনবোর্ডের কথা মনে পড়লো। দু’জন আবার বেরিয়ে পড়লো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভেতরে আলো জ্বলতে দেখে ছেলের মনে আশার সঞ্চার হলো।  দরোজায় নক করার পর একজন লোক বেরিয়ে এসে জানালো যে, আবহাওয়ার কারণে আজ আর কোনো ডকুমেন্ট নেয়া হবে না- পাঠানো যাবে না বলে। লোকটি দরোজা বন্ধ করার পর দু’জনই বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দায়। এই সময় পুত্রের মনে হলো, তার সহজ-সরল ও অসুস্থ পিতাটিকে আর বুঝি অসম্মান থেকে বাঁচানো গেলো না। তার ভেতর থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, হায় আল্লাহ্, এ রকম অসম্মানের চেয়ে তুমি ওনাকে নিয়ে যেতে পারতে। সেই তো ভালো হতো। ছেলের চোখে পানি এসে গেলো, কিন্তু বৃষ্টি চলছিলো বলে তা মুছতেও হয়নি, সাথের সহকর্মী জানতেও পারেনি।

এক সময় দু’জনই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কর্মস্থলের দিকে রওয়ানা দিলো। দু’জনেরই ওইদিন নাইট ডিউটি ছিলো আর আলোচিত পিতার এই পুত্রটি অফিসে তার সেকশনের হেড ছিলো।

অফিসে ঢোকবার পর আরেক সহকর্মী এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো: ‘বস, আপনাকে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে কেন?’ 

এই সহকর্মীকে একপাশে নিরিবিলি স্থানে নিয়ে বসে সংক্ষেপে সমস্যাটি জানালো। শুনে সহকর্মিটি বললো: ‘বস, আপনার সমস্যাটি তো আমি সমাধান করতে পারি। কারণ আমার বাড়ি তো ওই জেলায়। আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন। তাছাড়া ওখানকার আদালতে সব লোক আমাদের।’

কথাগুলো শুনে সরল পিতার সহজ ছেলেটি যেন বন্যার পানিতে ভাসতে ভাসতে বাঁচার একটা অবলম্বন পেলো। এই সহকর্মীকে তিনদিনের ছুটি মঞ্জুর করে দিলো, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ যা যা লাগে তা তা দেয়া হলো। আর এই সহকর্মী বললো: ‘বস, ওয়েদার নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না, যে কোনো পরিস্থিতিতে আমি পৌঁছে যাবো। আপনি আমার বস আর আপনার আব্বা তো ছিলেন আমার মামার কলিগ। এটা আপনার একার নয়, আমারও বিষয়। কোনো টেনশন করবেন না, ধরে নেন প্রবলেম সলভ্ড।’

সহকর্মীটি আদালতে গিয়ে ঠিকঠাক মতো সমস্যাটি সমাধান করে এসেছিলো। ভদ্রলোককে ওই মামলার সাক্ষী হিসেবে আর যেতে হয়নি। কিন্তু প্রিয় পাঠক, আমার কাছে সরল পিতার সহজ ছেলেটি যখন এ ঘটনা বর্ণনা করছিলো, তখন তার দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছিলো। শুনে আমারও চক্ষু ছলছল করছিলো। আমি শুধু আমার একটা হাত ওনার কাঁধে ছোঁয়াতে পেরেছি, কথা বেরোয়নি আমার মুখ দিয়ে। ওনার পিতা এরপরও অনেক দিন বেঁচেছিলেন। এখন তিনি পরলোকে। সেখানে ওনার আত্মিক প্রশান্তি কামনা করছি। কি বলে আজকের লেখা শেষ করবো, বুঝতে পারছি না। মনে ভেসে উঠছে আমার প্রয়াত পিতার ছবি। আসলে সহজ-সরল মানুষদের জন্য পৃথিবীটা সত্যিই একটা জটিল স্থান। মানুষ কতো অসহায়!

শেয়ার করুন