২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৮:১৪:৪৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


দুর্নীতিতে বাংলাদেশের আরো ২ ধাপ অবনমন
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০১-২০২৪
দুর্নীতিতে বাংলাদেশের আরো ২ ধাপ অবনমন বক্তব্য রাখছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান


বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২৩-এ বাংলাদেশের স্কোর ২০২২ এর তুলনায় ০-১০০ স্কেলে এক পয়েন্ট কমে ২৪ এবং নিম্নক্রম ও ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থানের দুই ধাপ অবনতি হয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে যথাক্রমে ১০ম ও ১৪৯তম। স্কোর ও অবস্থানের এই অবনমন প্রমাণ করে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূণ্য সহনশীলতার ঘোষণাসহ সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার-সূচকের তথ্যের সময়কালে (নভেম্বর ২০২০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৩) বাস্তবিক অর্থে কোনো কার্যকর প্রয়োগ হয়নি। বরং আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আরো অবনতি হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে কার্যকরভাবে সব ধরনের দুর্নীতির অপরাধের শাস্তি এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। 

গত ৩০ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে সিপিআই ২০২৩-এর বৈশ্বিক সমান্তরাল প্রকাশের অংশ হিসেবে টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, “সিপিআই অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্কোর ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৫ থেকে ২৮ এর মধ্যে আবর্তিত ছিলো। কিন্তু ২০২৩ সালে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় আরো এক পয়েন্ট কমে এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন ২৪ স্কোর এবং নিম্নক্রম ও ঊর্ধ্বক্রম উভয় দিক থেকেই দুই ধাপ অবনমন হয়ে যথাক্রমে ১০ম ও ১৪৯তম অবস্থানে রয়েছে। টিআই কর্তৃক ২০১২ থেকে ২০২৩ মেয়াদের প্রবণতা বিশ্লেষণ (Trend Analysis) করে দেখা যায়, বাংলাদেশের এ বারের স্কোর সার্বিক ১২ বছরের গড় স্কোর ২৬ এর তুলনায় দুই পয়েন্ট কম এবং এই মেয়াদে সর্বনিম্ন।” 

টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মঞ্জুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৩ সালের সিপিআই অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। ৮৭ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড এবং ৮৫ স্কোর পেয়ে তৃতীয় স্থানে নিউজিল্যান্ড। আর ১১ স্কোর পেয়ে ২০২৩ সালে তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে সোমালিয়া। ১৩ স্কোর পেয়ে নিম্নক্রম অনুযায়ী যৌথভাবে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা এবং ১৬ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ইয়েমেন। সংবাদ সম্মেলনে আারো জানানো হয়, সিপিআই-এ অন্তর্ভুক্ত ১৮০টির মধ্যে ১০৫টি দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩ এর কম স্কোর করেছে। অর্থাৎ বিশ্বের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই গড় স্কোর ৪৩-এর চেয়ে কম পেয়ে সূচকের শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী অতীব উদ্বেগজনক দুর্নীতির মধ্যে বাস করছে। আর সূচকে অন্তর্ভুক্ত দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি- ১২২টি দেশের স্কোর ৫০ এর নিচে, যার অর্থ এসব দেশে দুর্নীতির মাত্রা উদ্বেগজনক। 

এবছর সিপিআই-এর প্রতিপাদ্য ‘‘দুর্নীতি ও অবিচার’’ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ড. জামান বলেন, “সিপিআই-এ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় যে, ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৪৮টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় সিপিআই স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৮, ৩৬ ও ২৯; অথচ বাংলাদেশের স্কোর ২৪! এমনকি ফ্রিডম হাউজ অনুযায়ী যেসব দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র আছে এমন ৯৩টি রাষ্ট্রের গড় স্কোর ৫৩ এবং নির্বাচনী গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রসমূহের গড় স্কোর ৩১- সেখানেও বাংলাদেশের ২৪ স্কোর, উদ্বেগজনক ও বিব্রতকর। দুর্নীতি ও অবিচার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত; দুর্নীতি অন্যায়ের জন্ম দেয় এবং অন্যায় দুর্নীতির দুষ্ট চক্র তৈরি করে। সিপিআই-এর তথ্য আরো প্রমাণ করে, যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রয়েছে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত, সেসব দেশের কার্যকর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বেশি।” 

সিপিআই উপস্থাপনায় বাংলাদেশের নিম্ন অবস্থানের ব্যাখ্যা তুলে ধরে ড. জামান বলেন, “গত কয়েক বছর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’র সবচেয়ে আলোচিত মেয়াদ ছিলো। কিন্তু এই মেয়াদে এই ঘোষণাকে চর্চায় রূপ দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কৌশলনির্ভর কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি; উপরন্তু এই মেয়াদে দুর্নীতির ব্যপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি ক্রয় ও বিতরণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে দুর্নীতির অসংখ্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়কালে বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে আসলেও এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। ঋণ খেলাপী, জালিয়াতি ও অর্থপাচারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় নি, বরং এর জন্য যারা দায়ী তাদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমনে কার্যকর দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিতে কার্যকরতা দেখাতে পারেনি। রাজনৈতিক, প্রসাশনিক ও আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে অর্জিত ক্ষমতার অবস্থানকে অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহারের ব্যপকতা বৃদ্ধি পেয়ে স্বাভাবিকতায় রূপান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ব্যপকতর হয়েছে।” 

২০২৩ সালের সিপিআই অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে ভুটান গত বছরের ৬৮ স্কোর ধরে রাখলেও, এ অঞ্চলের পাঁচটি দেশ এবার ২০২২ এর তুলনায় কম স্কোর করেছে আর অবশিষ্ট দুটি দেশের স্কোর কিছুটা বেড়েছে। এরমধ্যে আফগানিস্তানের ৪ পয়েন্ট, শ্রীলংকার ২ পয়েন্ট এবং বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও ভারতের স্কোর ১ পয়েন্ট করে কমেছে। আর পাকিস্তানের ২ পয়েন্ট এবং নেপালের ১ পয়েন্ট স্কোর বেড়েছে। তবে, দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটান ছাড়া বাকি সাতটি দেশই সূচকের গড় স্কোর ৪৩-এর কম পেয়েছে। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার জনসাধারণ সার্বিকভাবে অতীব উদ্বেগজনক দুর্নীতির মধ্যে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

সিপিআই সূচকে দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০-১০০ এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়। সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশই এখন পর্যন্ত শতভাগ স্কোর পায়নি। অর্থাৎ, দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বনিম্ন এমন দেশগুলোতে কম মাত্রায় হলেও দুর্নীতি বিরাজ করে। 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআই-এ অন্তর্ভুক্ত হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতো টিআইবিও দুর্নীতির ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে বৈশ্বিক প্রকাশনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে একই দিনে ও সময়ে প্রকাশ করে মাত্র। সিপিআই ২০২৩ এর তথ্যসূত্র হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য সর্বমোট ১৩টি জরিপ ব্যবহার করা হয়েছে। সূচকে অন্তর্ভুক্তির জন্য সর্বনিম্ন তিনটি আন্তর্জাতিক তুলনাযোগ্য জরিপ থাকতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো ৮টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলো হলো: বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস এবং ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্র্যাসি প্রজেক্ট ডেটাসেট এর রিপোর্ট। 

সিপিআই অনুযায়ী দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে ব্যক্তিগত সুবিধা বা লাভের জন্য ‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার’ (abuse of public power for private gain)। সিপিআই নির্ণয়কালে জরিপের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সর্বোচ্চ মান এবং বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

শেয়ার করুন