২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৪:৪৪:৪৭ পূর্বাহ্ন


অভিবাসী সমাজে আতঙ্ক
যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাচারালাইজড নাগরিকত্ব বাতিলের নতুন নির্দেশনা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-১২-২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাচারালাইজড নাগরিকত্ব বাতিলের নতুন নির্দেশনা নাগরিকত্ব বাতিল বা ডিন্যাচারালাইজেশন


প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি আরো কঠোর রূপ নিচ্ছে। তার প্রশাসন বিদেশে জন্মগ্রহণকারী আমেরিকান নাগরিকদের ন্যাচারালাইজড নাগরিকত্ব বাতিলের প্রচেষ্টা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম না নেওয়া কিন্তু আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাগরিকত্ব অর্জন করা লাখো মানুষের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন অভিবাসন কৌশল। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর হাতে পাওয়া অভ্যন্তরীণ নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ২০২৬ অর্থবছর থেকে ব্যাপক হারে নাগরিকত্ব বাতিল বা ‘ডিন্যাচারালাইজেশন’ প্রক্রিয়া জোরদার করতে যাচ্ছে। এই পরিকল্পনাকে আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ও আগ্রাসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। ১৬ ডিসেম্বর ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস (ইউএসসিআইএস)-এর মাঠ পর্যায়ের দফতরগুলোতে জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ২০২৬ অর্থবছরে প্রতি মাসে ১০০ থেকে ২০০টি নাগরিকত্ব বাতিলের মামলা বিচার বিভাগের অফিস অব ইমিগ্রেশন লিটিগেশনে পাঠাতে হবে। এই লক্ষ্য পূরণ হলে বছরে প্রায় ১,২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০টি মামলা দায়ের হতে পারে। এটি হবে যা সাম্প্রতিক কয়েক দশকের তুলনায় এক বিশাল উল্লম্ফন। তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত মোট নাগরিকত্ব বাতিলের মামলা হয়েছে মাত্র ১২০টির কিছু বেশি। অর্থাৎ নতুন নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে মাসিক মামলার সংখ্যা হবে আগের পুরো বছরের মোট সংখ্যার কাছাকাছি। দেশ গত ২ জুলাই - যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাচারালাইজড নাগরিকত্ব বাতিলের নতুন নির্দেশনা শিরোনামে একটি খবর জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আইনে নাগরিকত্ব বাতিল একটি অত্যন্ত সীমিত ও ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা। সাধারণত শুধু তখনই কাউকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যায়, যখন প্রমাণিত হয় যে, তিনি নাগরিকত্ব আবেদনের সময় প্রতারণা করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেছেন অথবা আইনের কিছু নির্দিষ্ট গুরুতর শর্ত লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু মানবাধিকার ও অভিবাসন অধিকারকর্মীদের আশঙ্কা, ট্রাম্প প্রশাসনের এই নতুন ‘টার্গেটভিত্তিক’ অভিযান নাগরিকত্ব বাতিলের সেই বিরল ও চরম ব্যবস্থা কে একটি নিয়মিত প্রশাসনিক অস্ত্রে পরিণত করতে পারে। তাদের মতে, কাগজপত্রে সামান্য ভুল, বহু বছর আগের অনিচ্ছাকৃত অসংগতি কিংবা ব্যাখ্যাগত বিভ্রান্তিকেও ‘প্রতারণা’ হিসেবে চিহ্নিত করে মামলা করা হতে পারে।

এ নির্দেশনা এমন এক সময়ে এসেছে, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকেই অভিবাসন ব্যবস্থার তথাকথিত ‘ফাঁকফোকর’ বন্ধ করার নামে একের পর এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। দক্ষিণ সীমান্তে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রবেশ কার্যত বন্ধ, দেশের ভেতরে আশ্রয় আবেদন স্থগিত, এবং প্রধানত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। সব মিলিয়ে অভিবাসন প্রশ্নে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান আগের চেয়েও কঠোর হয়েছে।

ইউএসসিআইএসের মুখপাত্র ম্যাথিউ জে ট্রাগেসার এক বিবৃতিতে বলেন, জালিয়াতির বিরুদ্ধে ইউএসসিআইএসের যুদ্ধের অংশ হিসেবেই অবৈধভাবে নাগরিকত্ব অর্জনকারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে আগের প্রশাসনের সময় যারা নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তার ভাষায়, নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ায় মিথ্যা তথ্য দেওয়া বা তথ্য গোপন করা হলে, সেই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ডিন্যাচারালাইজেশন মামলা করা হবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, এ উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থার অখণ্ডতা রক্ষা করবে এবং জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করবে। বিচার বিভাগও চলতি বছরের জুনে প্রকাশিত এক স্মারকে জানায়, আইনসম্মত ও প্রমাণসমর্থিত সব ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের মামলা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে অনুসরণ করা হবে। বিচার বিভাগের নথি অনুযায়ী, সম্ভাব্য লক্ষ্য তালিকায় শুধু নাগরিকত্ব আবেদনে প্রতারণাকারীরাই নন, বরং কথিত গ্যাং সদস্য, আর্থিক জালিয়াতিতে জড়িত ব্যক্তি, মাদক কার্টেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন এবং সহিংস অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত।

মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ ন্যাচারালাইজড সিটিজেনস বসবাস করছেন। গত বছরই শপথ নিয়েছেন আট লাখের বেশি নতুন ন্যাচারালাইজড সিটিজেনস। তাদের বড় একটি অংশ এসেছে মেক্সিকো, ভারত, ফিলিপাইন, ডোমিনিকান রিপাবলিক ও ভিয়েতনাম থেকে। ইতিহাস বলছে, নাগরিকত্ব বাতিলের প্রক্রিয়া সহজ নয়। ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে এ ধরনের মামলার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৯০টি (সিভিল ও ক্রিমিনাল মিলিয়ে) মামলা হয়েছিল। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, নাগরিকত্ব আবেদনে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি সেই মিথ্যাটি নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। এটিও সরকারকে প্রমাণ করতে হবে। অভিবাসন অধিকারকর্মীদের আশঙ্কা, এই নীতি লাখো বৈধ নাগরিকের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেবে। ব্রেনান সেন্টারের সিনিয়র ফেলো মার্গি ও’হেরন বলেন, আমরা আগেও দেখেছি, যখন ডিএইচএস কর্মীদের জন্য গ্রেফতার বা বহিষ্কারের কৃত্রিম লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, তখন নির্দোষ লোকজনও ফেঁসে যান। নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষেত্রেও একই বিপদ রয়েছে।

তার মতে, এটি শুধু আইনি প্রশ্ন নয়, বরং সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নাগরিক আস্থার প্রশ্ন। বহু মানুষ যারা বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, পরিবার গড়েছেন, কর দিয়েছেন, ভোট দিয়েছেন। তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে গোটা সমাজে এক ধরনের স্থায়ী অনিশ্চয়তা তৈরি করা।বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসন যতই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করুক না কেন, বাস্তবে আদালতে এই মামলাগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। তবু নীতিগত দিক থেকে এই নির্দেশনা একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে নাগরিকত্ব আর আগের মতো চূড়ান্ত ও নিরাপদ অবস্থান নয়।

২০২৬ অর্থবছরের এ অগ্রাধিকার তালিকা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে কি না, নাকি এটি আইনি ও সাংবিধানিক বাধায় আটকে যাবে- সেই উত্তর সময়ই দেবে। তবে আপাতত, বিদেশে জন্ম নেওয়া লাখো মার্কিন নাগরিকের জীবনে এই ঘোষণা অনিশ্চয়তার এক নতুন ছায়া ফেলেছে।

শেয়ার করুন