৩০ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ০৬:০৫:০৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের প্রতিভা বিকাশে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা রাখা যাবে না’ সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে - আসাদুজ্জামান খান কামাল ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ‘বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নিন’ ভূল স্বীকার করে সরে দাড়ানোয় একজনের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার বাফেলোতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত ‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬


চার দিনব্যাপী বইমেলা সমাপ্ত
বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের জয়গান
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৭-২০২৩
বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের জয়গান ৩২ জন অতিথি প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে বইমেলার মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান শুরু


মুক্তধারা ফাউন্ডেশনে আয়োজিত নিউইয়র্কে চার দিনব্যাপী বই মেলার সফল সমাপ্তি হয়েছে। গত ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টসে চলে এই মহাযজ্ঞ। দেখতে দেখতে বইমেলার ৩২টি বছর কেটে গেল। এক কথায় চিন্তা করলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে একপেশে লড়াই করে এটি চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি এবং দেশপ্রেম না থাকলে কারো পক্ষেই এটি কথা সম্ভব নয়। বলতে গেলে নিজের পকেটে কেটেই শুরু করেছিলেন বিশ্বজিৎ সাহা এই সংগ্রাম। অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তাকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। চার দিনের অনুষ্ঠান করতে গেলে ছোটখাটো ভুলত্রুটি থাকবেই। কিন্তু সেই ভুলত্রুটিই সাফল্যের মাপকাঠি নয়, সোজা বাংলায় বলা যায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন বইমেলার আয়োজকরা। সেদিক থেকে তারা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। জয়তু আয়োজকবৃন্দ, সেই সঙ্গে কবি, লেখক ও পাঠকদের। এই বইমেলার অর্জন অনেক। চারদিনে কয়েক হাজার বইপ্রেমী, সংস্কৃতিপ্রেমী এবং দেশপ্রেমী মানুষ জড়ো ছিল, একই আমব্রেলার নিচে। কথাবার্তায়, চলন-বলনে, পোশাক-আশাকে, আড্ডায় তারা ছিলেন বাঙালি। বাঙালিময় ছিল বইমেলার স্থানটি। এবারের বইমেলায় আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় সুবীর চৌধুরী ও নুরজাহান বোসকে, সম্মানে ভূষিত করা হয় প্রধান অতিথি সিতারা বেগম বীরপ্রতীককে, সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানকে। চিত্তরঞ্জন পুরস্কার দেওয়া হয় দুটি প্রকাশনাকে। যে কথা বলা প্রয়োজন সেটা হলো আয়োজকরা অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমিয়ে অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে পারেন। বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান দর্শকদের ভালো লেগেছে, কিন্তু সময়সীমা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছিল কিছু নিম্নমানের অনুষ্ঠানও। সেগুলো বাদ দেওয়া যেতে পারে। বেশি অনুষ্ঠানের কারণে অনুষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রীহানি ঘটেছে। বারবার সমাপ্ত করার জন্য ইশারা কেমন জানি বেমানান ঠেকেছে। আয়োজকরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারে। অন্যদিকে মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান সকাল থেকে দর্শক খরায় শুরু না করে, বিকালে করলেই হতো সোনায় সোহাগা। তাছাড়া বইমেলার ৩২ বছর, অনেক সময়। ৩২ বছরের আয়োজনে দুই দেশের আরো কয়েকজন স্টার অতিথি থাকা উচিত ছিল। ২/৪ ছাড়া সবাই প্রতি বছরের একই মুখ। আশা করি আয়োজকরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন। তবে চারদিনের বই মেলাকে অবশ্যই সফল বলতে হবে। কারণ তৃতীয় দিন ছাড়া সব দিনই উপস্থিতি ছিলো ব্যাপক। আবার বই মেলায় বইও বিক্রি হয়েছে। যারা স্টল দিয়েছেন তাদের মুখের হাসিই সে কথা বলে দেয়।

বইমেলার উদ্বোধন 

“যত বই তত প্রাণ” এই স্লোগানে আমেরিকার নিউইয়র্কে শুরু হয়েছে ৩২তম বইমেলা। শুক্রবার জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে চার দিনব্যাপী বইমেলার ফিতা কেটে উদ্বোধন করেন কথাসাহিত্যিক ও গবেষক শাহাদুজ্জামান। প্রধান অতিথি ছিলেন বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বইমেলার আহ্বায়ক ও লেখক ড. আবদূন নূর। বইমেলা উপলক্ষে উদ্বোধক শাহাদুজ্জামান, প্রধান অতিথি ডাঃ সীতারা বেগম, নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল মনিরুল ইসলাম, কবি লুৎফর রহমান রিটন, ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ডা. নূরন্নবী, গোলাম ফারুক ভূঁইয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবিদুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহউদ্দিন আহমেদ, লেখক-সাংবাদিক হাসান ফেরদৌস, লেখক ফেরদৌস সাজেদীন, জসীম মল্লিক, মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি বিশ্বজিৎ সাহাসহ ৩২ জন অতিথি ৩২টি প্রদীপ প্রজ্বালন করেন। এবারের বইমেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, ভারত, কানাডা, মেক্সিকো, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া থেকেও লেখক-সাহিত্যিকরা অংশ নেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও কৃষ্টিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রে ধারাবাহিকভাবে বাংলা বইমেলার আয়োজন করে আসছে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন। মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত সাহা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সাহিত্যিকরা নিউইয়র্কের বইমেলায় এসেছেন । এটি সারা বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমী সব বাঙালির মেলায় পরিণত হয়। অনেক বই প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক বইমেলার সামনে রেখে। তাই স্টলের সংখ্যাও বাড়ছে, থাকছে শিশু চত্বর। প্রতি বছরের মতো এবারও বই মেলাজুড়ে থাকছে লেখক, পাঠক, প্রকাশক ও নতুন বই নিয়ে আলোচনা, সেমিনার সংস্কৃতিক পরিবেশনাসহ নানা আয়োজন। আমন্ত্রিত অতিথিরা বাংলা ভাষা, শিল্প, সাহিত্য ও কৃষ্টির আধুনিক চর্চা নিয়ে বিভিন্ন পর্বে ভাগ হয়ে আলোচনায় অংশ নেবেন। দর্শনার্থীরা বলছেন, এটি শুধু বইমেলা না, সংস্কৃতি মেলা, আনন্দ উৎসব। তরুণদের যুক্ত করার মিলনমেলা। সংস্কৃতিঘনিষ্ঠ বাঙালিদের এক আবেদনময় উৎসবের নাম নিউইয়র্ক বইমেলা। প্রবাসী বাঙালিদের যুক্ত করাই এর সার্থকতা। এবারও বইমেলায় মুক্তধারা-জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হবে। পুরস্কারের অর্থমূল্য ৩ হাজার মার্কিন ডলার। মেলায় কলকাতা ও বাংলাদেশের প্রথম সারির ২৫টি প্রকাশনী সংস্থা অংশগ্রহণ করছে, থাকছে বাংলাদেশ, ভারত ও প্রবাসের ৩০টিরও অধিক বইয়ের স্টল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. সিতারা রহমান বইমেলার প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদানকালে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমি এখানে এসে এতো আনন্দিত, খুশি এবং গর্বিত। মনে হচ্ছে যে, আমার বীর প্রতীক খেতাব পাওয়াটা বোধহয় সার্থকই হয়েছে। কারণ এখানে এতো বাঙালি-বাংলাদেশ, কলকাতা, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রিলিয়া থেকে এসেছেন, সবারই একটি পরিচয়, তা হচ্ছে বাঙালি।’

বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত তারামন বিবি ইন্তেকাল করার পর ডা. সিতারা হচ্ছেন জীবিত একমাত্র বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা। ৭৮ বছর বয়স চলছে। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হলেও মনোবল হারাননি। তবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না বলে চেয়ারে বসে বক্তব্য প্রদানের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। 

বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতির জন্যে অফুরন্ত ভালোবাসা থেকে তিনি দেশ ও প্রবাসের লেখক-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-কবি-চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ার সবার প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লেখার জন্য। যারা যুদ্ধ করেছেন, রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পরিপক্ব মানুষ ছিলেন, তারা যেন সঠিক ইতিহাস লিখেন। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা রটেছে যার অনেকটাই সত্য নয়। আসল কথা বলতে গেলে মুশকিল হয়ে যায়। আমি বলবো যারা আসল খবর, আসল ইতিহাস জানেন, তারা যেন নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার স্বার্থেই তা লিখতে এগিয়ে আসেন।’ 

শুভেচ্ছা বক্তব্যে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বইমেলা শব্দটি আমার কাছে মনে হয় এটি একটি প্রবেশদ্বার, এটি বইয়ের জগতকে আপনার সামনে উম্মুক্ত করে দেয়। যখনই কেউ বইয়ের জগতে প্রবেশ করেন তখনই তার কল্পনাজগত এবং সৃজনশীলতার জগতে প্রবেশ করেন। যার মাধ্যমে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন এবং নিজের সম্ভাবনাগুলোকে নতুন করে আবিষ্কারের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। আর এমন একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে বহুজাতিক এ সমাজে।’ 

মনিরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশের লেখক-কবি-সাহিত্যিকগণের মধ্যে যারা এই প্রবাসে স্থায়ীভাবে বাস করছেন তাদের সেই সত্ত্বা অটুট রেখে বাঙালি সংস্কৃতির ফাগুধারা নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের চমৎকার একটি পরিবেশ তৈরি করেছে এই বইমেলা। একই সঙ্গে আমি আরো মনে করছি, যারা বাংলাদেশে থাকতে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাদেরও একটি অংশ এই প্রবাসে লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং উৎসাহবোধ করছেন গত ৩২ বছরের এই মেলা থেকে। প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, আবেগ, যে অনুভূতি তা প্রকাশ করার জন্য অনেকে লেখছেন অথবা উদ্যোগী হয়েছেন। তাই এই বইমেলা শুধু বই পড়ার জন্যই নয়, নতুন লেখক সৃষ্টিতেও অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘একইভাবে এই প্রবাসে যারা বড় হয়েছেন, যারা এই সংস্কৃতিতে জড়িয়ে থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, আলোকিত হয়েছেন, তাদের মধ্যেও কিন্তু বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বাঙালির ইতিহাস নতুনভাবে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করেছে এই বইমেলা।’ কন্সাল জেনারেল বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যকার বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তাকে আরো বলিষ্ঠ, বেগবান এবং গভীর করার কাজটিও করছে এই বইমেলা। তাই আমি প্রত্যাশা রাখছি যে, এই বইমেলার মধ্য দিয়ে আমরা সংকল্প গ্রহণ করি, আমরা জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়তে চাই, জাতি গঠন করতে চাই, যেখানে কোনো মারামারি-হানাহানি থাকবে না, ভালোবাসা আর সম্প্রীতির বন্ধনে পরস্পরের সহযোগী হয়ে কাজ করে যাবো।’ 

লেখক-সাংবাদিক শামিম আল আমিন এবং উর্বি হাইয়ের উপস্থাপনায় এ পর্বে আরো বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, আবৃত্তি শিল্পী আহকাম উল্লাহ, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার এ জেড এম সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ।

বইমেলার দ্বিতীয় দিন 

তসলিমা নাসরিন এসেছিলেন নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলায়

নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলার দ্বিতীয় দিন এসেছিলেন তসলিমা নাসরিন। বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত এই কবি ও লেখক ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট ছিলেন মেলায়। এসময় তিনি বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন। তার সঙ্গে ছবি তুলতে এবং কথা বলতে ভিড় জমে যায়। তিনি হাসিমুখে সবার সঙ্গে ছবি তোলেন, উত্তর দেন নানান প্রশ্নের। এবার সুবীর চৌধুরী ও নুরজাহান বোসকে মেলার পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। স্মারক সম্মাননা পেয়েছেন মেলার উদ্বোধক ও কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান এবং মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম, বীর প্রতীক। ১৫ জুন শনিবার বন্ধের দিন হওয়ায় মেলায় ছিল ব্যাপক দর্শনার্থী। 

মেলায় এসে তসলিমা নাসরিন  বলেন, আমি ঢাকার বইমেলা, কলকাতা বইমেলায় যেতে পারি না ৩০ বছর ধরে। অথচ আমি বাংলায় লিখি। কিন্তু আমার বাংলা বইমেলায় যাওয়ার অধিকার নেই। অন্যান্য ভাষাভাষীর বইমেলায় আমি যাই। অনেক সময় উদ্বোধনও করেছি। নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলায় এসে খুব ভালো লাগছে। পুরোনো প্রকাশকদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। অনেক নতুন বই দেখছি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, এই যে বলা হয় আমাকে মেরে ফেলবে, আমার বিরুদ্ধে প্রচুর মানুষ, কই আমি এসে দেখলাম কত মানুষ এলো, আমাকে ভালোবাসে, কত মেয়ে এলো তারা বলে আমার বই পড়ে, আমাকে ভালোবাসে। 

মেলায় বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয় ২৫টি প্রকাশনা সংস্থা। বন্ধের দিনে ভালোই বিক্রি হয়েছে বই। মেলা উপলক্ষে আদনান সৈয়দের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে একটি বিশেষ সংকলন। মেলা প্রাঙ্গণের সমরেশ মজুমদার মঞ্চে প্রদান করা হয় আজীবন সম্মাননা। এবার পেয়েছেন সুবীর চৌধুরী ও নূরজাহান বোস। তাদের হাতে সম্মাননা তুলে দেন সাংবাদিক রোকেয়া হায়দার, ডা. জিয়া উদ্দিন আহমেদ, এবং স্মারক সম্মাননা ও কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের হাতে তুলে দেন আহ্বায়ক ড. আব্দুন নূর। এই সময় ড. আব্দুন নূর বলেন, সম্মানীত লোকদের হাতে সম্মাননা তুলে দিতে পেরে আমরা নিজেরাও সম্মানীত এবং গর্ববোধ করছি। বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সেরা ৫০ জন থট লিডারের একজন সুবীর চৌধুরী। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ভাষায়, তিনি নেতৃস্থানীয় উৎকর্ষ বিশেষজ্ঞ। নুরজাহান বোস একজন সংগ্রামী নারী। যিনি আত্মজীবনী আগুনমুখার মেয়ে বইটি লিখে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। লেখক হিসেবে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এই সম্মাননা দেওয়ার আগে শিল্পী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মার্কিন শিল্পী জর্জ হ্যারিসন, ‘বাংলাদেশ’ গানটি পরিবেশন করে বিশ্বময় আলোড়ন তুলেছিলেন তা পরিবেশন করেন দেবযানী বর্ষা।

রাতে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অণিমা রায়ের গান দিয়ে শেষ হয় মেলার দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান। তার গানের মধ্য দিয়েই শেষ হয় দ্বিতীয় দিনের মেলা। তবে দ্বিতীয় দিনের মেলা শুরু হয়েছিল আড্ডার মধ্য দিয়ে। ছিল মঞ্জুর কাদেরের সঞ্চালনায় আমরা ধরাকে ছড়া জ্ঞান করি। অংশগ্রহণ করেন লুৎফর রহমান রিটন, রোমেন রায়হান ও ফারুক হোসেন। আরো ছিল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। আদনান সৈয়দের সঞ্চালনায় নতুন বই নিয়ে লেখক ও তাদের প্রকাশিত বইয়ের প্রদর্শনী। আলোচক ছিলেন শাহাদুজ্জামান। তানভীর রাব্বানীর পরিচালনায় ছিল প্রিন্ট বনাম ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ে আলোচনা। আলোচনায় ছিলেন আবেদীন কাদের, জাফর আহমেদ রাশেদ এবং হাসান ফেরদৌস। ড. আশরাফ হোসেন উপস্থাপন করে অজনা বেগম রোকেয়াকে। আবীর আলমগীরের পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে অংশগ্রহণ করেন মুমু আনসারী, জি এইচ আরজু, গোপন সাহা, পারভীন সুলতানা, নজরুল কবীর প্রমুখ। ফাহিম রেজা নূরের সঞ্চালনায় একুশ থেকে একাত্তর নিয়ে আলোচনা করেন শারমিন আহমদ, অধ্যাপক এ বি এম নাসির, ড. নূরুন নবী। সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আনিস আহমেদ, লুৎফর রহমান রিটন। উপস্থাপনায় ছিলেন তমিজ উদ্দিন লোদী। আলোচনকদের মধ্যে ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায় পর্যাপ্ত সময় না দেয়ার কারণে। কেউ কেউ তাদের বক্তব্যেই তা প্রকাশ করেন। নত্যৃ পরিবেশন করে বাফা। ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদের পরিচালনায় অঞ্জলী লহ মোর অনুষ্ঠানে অংশ নেন লিম চৌধুরী, বিজয়া সেন গুপ্তা, নজরুল ইসলাম ও কবীর কিরণ। পশ্চিমের রবি অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করেন লন্ডনের আনন্দধারা আর্টস। মূলত একজন চিকিৎসক তার দুই কন্যাকে নিয়ে চমৎকার পরিবেশনা করেন। অংশগ্রহণে ছিলেন ইমতিয়াজ আহমেদ এবং তার দুই কন্যা উর্বী মধুরা এবং পূর্বা অধরা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে পশ্চিমা কবি, লেখক এবং শিল্পীদের অনুকরণ করে তার আদলে যেসব গান করেছিলেন, তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়। মূল গানটি দুই কন্যা ইংরেজিতে করেন আবার বাবার সঙ্গে বাংলা গানটিও করেন। যা ছিল সত্যিই মনোমুগ্ধকর। ইমতিয়াজ আহমেদ দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে নতুন প্রজন্মের হাতে আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে দিতে হয়। বলেছেন নতুন প্রজন্মের হাতে আমাদের সংস্কৃতি তুলে দিতে হলে তাদের মতো করেই তুলে দিতে হবে, আমাদের মতো করে নয়। বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন আহকাম উল্লাহ।

তৃতীয় দিন

বইমেলার তৃতীয় দিন নিয়ে শঙ্কা ছিল। সেই শঙ্কা ছিল বৃষ্টি নিয়ে। বলতে গেলে সারা দিনই বৃষ্টি ছিল। কিছুক্ষণ বৃষ্টি, কিছুক্ষণ ভাল। বলা যায়, প্রকৃতির লুুকোচুরি খেলা। সেই খেলার মধ্যেই বই মেলার তৃতীয় দিন শুরু হয়েছিল। তবে বৃষ্টির কারণে বইপ্রেমি মানুষের সংখ্যা ছিল কম। বৃষ্টি বইমেলার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বরং বৃষ্টিই যেন পরাভূত হয়েছে খানিকটা। স্বরচিত কবিতা পাঠ দিয়েই এই দিনের শুরু। মোশাররফ হোসেনের সঞ্চালনায় কবিতা আবৃত্তি করেন আলফ্রাড খোকন ও কাজল চক্রবর্তী। ফাহিম রেজা নূরের সঞ্চালনায় অপরাধ ও শাস্তি বিষয়ক আলোচনা, একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন ড. নূরন্নবী, আনিস আহমেদ ও ওবায়দুল্লাহ মামুন। হুমায়ুন কবীরের উপস্থাপনায় ডায়াসপোরা সাহিত্যবিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন শাহাদুজ্জামান, লুৎফর রহমান রিটন, জসীম মল্লিক এবং নাজমুন নেসা পিয়ারি। ফকির ইলিয়াসের সঞ্চালনায় আমাদের প্রত্যাশা-বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশক ও বিভিন্ন শহরের বইমেলা সংগঠকদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব ও মতবিনিময়ে অংশগ্রহণ করেন জিয়াউল হক এবং দস্তগীর জাহাঙ্গীর। রোকেয়া হায়দারের সঞ্চালনায় গানের ছোঁয়ায় কবিতায় অংশগ্রহণ করেন আতিয়া মাহজাবিন, দিনার মনির ও নজরুল ইসলাম। অনুবাদ কলার আলোচনায় ছিলেন অনন্ত উজ্জ্বল, আনিসুজ্জামান ও শাহাব আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন শাহাদুজ্জামান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টেরের ভূমিকা নিয়ে আলাদা আলাদা দলিল থাকলেও চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে তেমন কিছু নেই। চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে দলিল হিসাবে বই লিখেছেন আলোচক নিজেই। তাই তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এই দিনের উল্লেখযোগ্য ইভেন্ট ছিল মুক্তধারা/জিএফবি সাহিত্য ও চিত্তরঞ্জন সাহা প্রকাশক পুরস্কার। যা পেয়েছেন যৌথভাবে পেয়েছেন কথা প্রকাশ ও নালন্দা। ডা. জিয়াউদ্দিনের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন জসীম উদ্দিন ও রেদোয়ানূর। এই পুরস্কার ঘোষণা করেন গোলাম ফারুক ভুইয়া। এবার মুক্তধারা-জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কবি আসাদ চৌধুরী। মেলার তৃতীয় দিন রোববার সন্ধ্যায় কবি আসাদ চৌধুরীর পক্ষে ক্রেস্ট ও তিন হাজার ডলার প্রাইজমানি গ্রহণ করেন তার সহধর্মিণী সাহানা চৌধুরী ও কন্যা নুসরাত জাহান চৌধুরী। পুরস্কারটি তুলে দেন জিএফবি গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক ভূঁইয়া। হাসান ফেরদৌসের পরিচালনায় মুখোমুখি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে মাহাদুজ্জামান, লুৎফর রহমান রিটন। এই দন সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন মরিয়ম, শাহ মাহবুব, সেলিম চৌধুরী, তানভীর আলম সজীব, মৈত্রেয়ী দেবী ও অনুপম দাস ডান্স একাডেমি।

শেষ দিন

বইমেলার শেষ দিন ছিল শিশু-কিশোর-যুব উৎসব। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে ছিল ফেস পেইন্টিং, হ্যান্ড পেইন্টিং। চিত্রাঙ্কনে সবাই অংশগ্রহণ করে। গান পরিবেশনে মাটি। কবিতা আবৃত্তিতে চারুলতা সৈয়দ, তামান্না আহমেদ, প্রমিত মহান। প্রশ্নেত্তর পর্বে আশনা আলী। প্রকাশনা নিয়ে কথা বলেন নাদিয়া কিউ আহমেদ, নাহিয়ান ইলিয়াস ও ফাবলিহা ইয়াকুব। সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কথা বলেন, রুহুল আমিন ও তাজিন খান। লুৎফর রহমান রিটনের সঙ্গে কথোপকথনে অংশগ্রহণ করে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা। মূলধারায় বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলেন ইশিতা মিলি, অন্তরা সাহা ও নীল জেরিন। শেষদিনে একক সংগীত পরিবেশন করেন তানভীর আলম সজীব। সজীবের পরিবেশনার মধ্য দিয়েই এবারের বইমেলার সমাপ্তি ঘটে।

শেয়ার করুন