১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৫:১৫:২৬ অপরাহ্ন


বিদ্যুৎ সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে বাংলাদেশে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৭-২০২২
বিদ্যুৎ সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে বাংলাদেশে


বিশ্ব জ্বালানি বাজারে প্রাথমিক জ্বালানির অগ্নিমূল্য সকল দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যমান পরিবর্তন আনছে। অধিকাংশ দেশ তাদের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার কারণে পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দিবে এটিও নিশ্চিত। কিন্তু বাংলাদেশে অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন দুর্বল পরিকল্পনা, আনাড়ি ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের চলমান সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিদ্যুৎ সেক্টরের বর্তমান জ্বালানি সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ নিজস্ব জ্বালানি (কয়লা,গ্যাস)অনুসন্ধান,উন্নয়নে নীতিহীনতা, অদক্ষতা এবং কিছু কিছু মানুষের ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার সুপ্ত বাসনা।

বিশেষজ্ঞরা ২০০৯ থেকেই সরকারকে কয়লা উত্তোলন, গ্যাস অনুসন্ধান তৎপরতা বৃদ্ধি বিষয়ে তাগাদা দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশ যখন দেশীয় জ্বালানি আরোহন উপেক্ষা করে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন কিন্তু বারবার সতর্ক করা হয়েছে বাংলাদেশ কিছুতেই আমদানিকৃত জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেলে বা কোনো কারণে সাপ্লাই চেন ব্যাহত হলে- দেশ বিশাল সংকটে পর্বেই। 

বাংলাদেশ কয়লা উত্তোলন করলো না। এর জন্য কে বা কারা দায়ী? বাংলাদেশ জলে-স্থলে ন্যূনতম গ্যাস অনুসন্ধান করলোনা। মেট ওশান সার্ভে অনুমোদন করতে ৪ বছর  সময় নিলো। এখন পর্যন্ত গভীর সাগরে পিএসসি বিডিং রাউন্ড আহ্বান করতে পারলো না। এর জন্য দায়ী কে? 

২০১০-২০১৪ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর আওতাধীন এলাকায় লক্ষাধিক অবৈধ সংযোগ দেয়া হলো। দায়ী কে? কার নেতৃত্বে গ্যাস সংকট থাকা সত্ত্বেও শিল্প কারখানাসমূহে বেছে বেছে গ্যাসসংযোগ দিয়ে গ্যাস চাহিদা সামর্থ্যরে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো? কেন শিল্পকারখানায় মানসম্মত গ্রিড বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলো না? ফলশ্রুতিতে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকায় গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট সৃষ্টি হলো? 

২০০০ সালে ইউনোকোল ডজওচ প্রস্তাব দিয়ে ভোলার গ্যাস খুলনায় সরবরাহের কাজে অনেক অগ্রসর হয়েছিল। জ্বালানি সেক্টরে সম্পৃক্ত একজন বিশেষ ব্যক্তির কারণে প্রকল্পটি চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে অনুমোদন পায়নি। বর্তমান সংকট সময়ে ভোলার বিশাল গ্যাসভান্ডার থেকে দেশবাসী বঞ্চিত।  

২০১০ থেকে শুরু করে ২০১৯ নাগাদ দীর্ঘসময়ে মাত্র দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করে সর্বোচ্চ ৮৫০ এমএমএমএমসিএফডি আরএলেঙ্গি সরবরাহ পাওয়া গেছে। কিন্তু স্পট মার্কেটে এলএনজি মূল্য গগণচুম্বী থাকায় সম্প্রতি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা স্থগিত আছে। ফলশ্রুতিতে এলএনজি সরবরাহ কমে ৫০০ এমএমসিএফডি হয়ে গেছে। এই ধরনের অব্যবস্থাপনার জন্য জ্বালানি সেক্টর ব্যবস্থাপনা বিশেষত একজন বিশেষ ব্যক্তি দায়ী। 

বর্তমানে ২৩ হাজার মেগাওয়াট গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৭ হাজার  মেগাওয়াট আমদানিকৃত তরল জ্বালানিনির্ভর যার সিংহভাগ রেন্টাল প্ল্যান্ট। বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া থাকায় এগুলো চালাতে হলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে। এমনিতেই এগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। ডলার তুল্যমানে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটায় ব্যাক্তিখাতের কিছু বিদ্যুৎকোম্পানি জ্বালানি আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে।তার পরেও বলবো ৯০০-৯৫০ এমএমসিএফডি সরবরাহ পেলে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। 

আসলে বিশ্ব জ্বালানি বাজারে প্রাথমিক জ্বালানি মূল্য অব্যাহতভাবে আকাশচুম্বী থাকায় সার্বিক অশুভ প্রভাব পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। উন্নত,উন্নয়শীল,স্বল্পোন্নত কোনো দেশ আর এখন প্রভাব মুক্ত নয়। বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস সম্পদ আছে, যদিও উত্তোলনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছেই তবুও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উত্তোলন যোগ্য উন্নতমানের কয়লা সম্পদ আছে। সাগরে গ্যাস। তেল পাবার সম্ভাবনা আছে। আছে সূর্যকিরণ, বায়ুবিদ্যুৎ ব্যবহারের অবারিত সুযোগ। কিন্তু ২০২২ সালে এসেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত ক্রমাগত আমদানিকৃত জ্বালানিনির্ভর হতে থাকায় জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক টানাপড়েন শুরু হয়েছে। 

সরকার বিলম্বে হলেও বিভিন্ন পর্যায়ে কৃচ্ছ্রতার কথা ভাবছে। কথা হচ্ছে সরকারি বেসরকারি কার্যালয়সমূহে কর্মসময় সকাল ৮টা থেকে অপরাহ্ন ৩টা করার বিষয়ে। সন্ধ্যার পিক চাহিদা সময়ে ৭টা থেকে বাণিজ্যবিতান, দোকানপাট বন্ধ রাখার। বিনোদন অনুষ্ঠানসমূহ রাতের বেলা না করার, সবধরনের আলোকসজ্জা বন্ধ রাখার। হিসাব করা হয়েছে এগুলো করা হলে পিক সময়ে চাহিদা অন্তত ২ হাজার মেগাওয়াট কমানো সম্ভব। চিন্তা ভালো, কিন্তু কতটা বাস্তবসম্মত সন্দেহ আছে। দেশ চালায় এখন প্রকৃতপক্ষে কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী।  

সরকারপ্রধান (যিনি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন) বিশেষ নির্দেশনা দেয়ায় নড়েচড়ে বসেছে জ্বালানি বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলছেন, গ্যাস সরবরাহ সংকটের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কথাটি আংশিক সত্য। আলোচনায় বেরিয়ে আসবে গ্যাস উৎপাদন ক্রমাগত কমে আসার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে বিকল্প জ্বালানি কয়লা উৎপাদনের তাগিদ দিয়ে আসছিলো। জলে-স্থলে গ্যাস অনুসন্ধানের কথা সুপারিশ করা হয়েছে নিয়মিত।

বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির ঝুঁকিসমূহ বিষয়েও সতর্ক করেছে ক্রমাগত। কেন শুনেনি জ্বালানি মন্ত্রণালয়? এখন যখন সংকট সীমাহীন তখন শুধু গ্যাস খাতকে দোষী বা দায়ী করা সমীচীন নয়। এখন দেশে খাতগুলো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে সেগুলোর সম্মিলিত গ্যাস চাহিদা নিদেনপক্ষে ১৫০০ এমএমসিএফডি। অথচ বর্তমান গ্যাস উৎপাদন থেকে সর্বোচ্চ সরবরাহ সম্ভব ৯০০-১০০০ এমএমসিএফডি। এই গ্যাস দিয়ে জ্বালানি দক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ নিদেনপক্ষে ৬০০০-৬৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

কিন্তু অনেক কেন্দ্র সেকেলে টেকনোলজি ব্যবহার করে তাই গ্যাসের ব্যবহারে অপচয় আছে। দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট আমদানি সহ) ২৫ হাজার মেগাওয়াট। অন্তত ৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিকৃত তরল জ্বালানি থেকে উৎপাদন করা যায়। দেশে দুটি ফ্লোটিং এলএনজি টার্মিনাল থেকে সর্বোচ্চ ৮৫০ এমএমসিএফডি এলএনজি গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে পটুয়াখালীর পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি আমদানি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। 

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সন্নিহিত এলাকায় ৫০৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লার অভাবে ধুঁকছে। ভারত থেকে দুটি পণ্যে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে। অচিরেই বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরো একটি আমদানিকৃত কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেও একটি সমমানের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হচ্ছে। আদানি গ্রুপ ভারতে উৎপাদন করে ১৮০০ মেগাওয়াট কয়লা  নির্ভর বিদ্যুৎ রফতানি শুরু করবে অচিরেই। এখন প্রশ্ন হলো বিশ্ব জ্বালানি বাজারে অব্যাহত প্রাথমিক জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানিকৃত কয়লা, তরল জ্বালানি বা এলএনজি-নির্ভর জ্বালানি খাত টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে কিনা? বাংলাদেশের অর্থনীতি জ্বালানি মূল্য পরিষদে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিতে পারবে কিনা? 

মূলত নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ-নির্ভর বাংলাদেশ প্রমাণিত গ্যাস মজুদ নিঃশেষ হবার উপক্রম দেখে ২০১০ বিদ্যুৎ সিস্টেম মহাপরিকল্পনায় ২০৩০ নাগাদ প্রাক্কলিত ৪০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ২০ হাজার মেগাওয়াট বিকল্প জ্বালানি কয়লা থেকে উৎপাদনের কথা লিখা থাকলেও সরকার নানা বিভ্রান্তির কারণে ২০১০-২০২২ নিজস্ব কয়লা উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। পরিপেক্ষিতে ২০১৬ আরেকটি বিদ্যুৎ সিস্টেম মহাপরিকল্পনা করা হয়।

যেখানে ২০৪১ নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি মিশ্রণ সুপারিশ করা হয় কয়লা ৩৫ শতাংশ (মূলত আমদানি), গ্যাস ৩৫ শতাংশ (নিজস্ব এবং এলএনজি),৩০ শতাংশ পরমাণু বিদ্যুৎ, আমদানিকৃত বিদ্যুৎ, রিনুয়াভেল বিদ্যুৎ। ২০২২ এসে দেখা যাচ্ছে বৈষয়িক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের বেশকিছু প্রকল্প বাতিল হয়েছে, পেট্রোবাংলা নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান পরিমিত প্রমাণে করতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এলএনজি আমদানির অবকটাঠামো নির্মাণ কমপক্ষে ৫ বছর পিছিয়ে ঢিমেতালে চলছে। তাই এখন টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জনের মাধ্যমে ২০৪১ নাগাদ উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হবার সম্ভাবনা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।

কিছু পরিসংখান দিলে আলোচনাটি বস্তুনিষ্ঠ হবে। দেখা যাক, ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে প্রভাব ফেলেছে। যুদ্ধের আগেই ফার্নেস অয়েলের মূল্য ছিল ৭০৮ ডলার/টন এখন মূল্য ১০৮০ ডলার/টন। এলএনজি মূল্য ছিল ১০ ডলার/ এমএমবিটিইউ এখন ৩৮ ডলার/ এমএমবিটিইউ, কয়লা ছিল ৬৪ দলের/টন এখন ১৭৮ ডলার/টন। এখন ভেবে দেখুন বাংলাদেশের মতো অনুন্নত অর্থনীতি থেকে সবে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে রূপান্তর পর্যায়ের দেশ কোন ভরসায়, কার উপদেশে নিজেদের সম্পদ মাটির নিচে রেখে জ্বালানি আমদানির দিকে ঝুঁকেছিলো? ২০০৯ মহাসংকটের সময় জরুরি প্রয়োজনে কন্টিনজেন্সি ব্যবস্থা ঠিক ছিল। নিজেদের জ্বালানি অনুসন্ধান এবং উৎপাদন বাড়িয়ে ২০২২ নাগাদ অন্তত ৭০-৮০ শতাংশ নিজস্ব জ্বালানি-নির্ভর থাকলে বাংলাদেশের বর্তমান সংকট অবস্থায় হাবুডুবু খাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হতো না।

নিশ্চিত নয় কতদিন ইউক্রেন যুদ্ধ চলবে। যুদ্ধ শেষ হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জ্বালানি বাজার অস্থির থাকবে বহুদিন।এখনই বাংলাদেশকে ২৮ হাজার কোটি টাকা জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। মেগা প্রকল্পগুলোর ধার দেন পরিষদ শুরু হলে অব্যাহত ভর্তুকি প্রদান সম্ভব হবে না। এখনো সময় আছে সর্বস্তরে কৃচ্ছ্রতার পাশাপাশি নিজেদের জ্বালানি অনুসন্ধান জোরদার করার। কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জলে-স্থলে গ্যাস অনুসদ্ধানের জন্য যুদ্ধ ঘোষণার। জ্বালানি সেক্টর আমলা নিয়ন্ত্রণমুক্ত পেশাদারদের কাছে ফিরিয়ে দিলে ২০৩০ নাগাদ ঘুরে দাঁড়ানোর এখনো স্বভাবনা আছে। কিন্তু প্রয়োজন জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাত থেকে বারো ভূতদের দ্রুত বিদায় দেয়ার।


শেয়ার করুন