২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৮:০৬:৩৬ পূর্বাহ্ন


মে মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় শিকার ৫৪৯ জন
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৬-২০২৩
মে মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় শিকার ৫৪৯ জন


রাজনৈতিক, নির্বাচনী সহিংসতা ও সভা সমাবেশে বাধার ৩৫ টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)’র এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। 

রাজনৈতিক সহিংসতা ও সভা সমাবেশে বাধার ঘটনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে আহতদের মধ্যে ১১ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, অপরদিকে নিহত ৫ জনের মধ্যে ২ জন ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে  ও ১ জন সাবেক ইউপি সদস্য ও ২ জন বিএনপির কর্মী।

রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহত, মামলা ও সমাবেশে যোগদানে বাধা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে, ২০২৩ সময়ে বিরোধীয় দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন, নির্বাচনী সহিংসতা, আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বল প্রয়োগ, শান্তিপূর্ণ সভা, মিছিলে বাধাদান অব্যাহত ছিল। সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মে ২০২৩ মাসে বিএনপির বিরুদ্ধে ২৪টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৬৫ জন নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলমান অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় ১১৭জন, বাড়ি ও বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার হয় ৩৩৯ নেতাকর্মী এবং আদালতে জামিন প্রার্থনাকালে জামিন না দিয়ে ১০৯ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৫৫৫ জন বিএনপি ও সমমনা দলের এবং ১০ জন জামায়েত ইসলামী কর্মী।

এ মাসে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলমান অবস্থায় ১৩৭জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় অপরদিকে আদালতে জামিন প্রার্থনাকালে জামিন না দিয়ে ৩৩ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১১২ জন বিএনপি ও এর সহযোগী অঙ্গসংগঠনের এবং ৫৮ জন জামায়েত ইসলামীর কর্মী।

গণমাধ্যম সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দাবি করেছে, ১৯ মে থেকে ২৪ শে মে পর্যন্ত ছয়দিনে সারা বাংলাদেশে অন্তত ৬৫০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময়ে বিএনপির ৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অন্তত ১৪৮টি মামলা হয়েছে।

মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন মে ২০২৩’এ বলা হয় এই মাসেও  বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অব্যাহত রয়েছে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু,তাদের পরিচয়ে অপহরণ, গায়েবি মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ডে নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের উপর সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মতামত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা তথা সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মত ঘটনা ক্রমাগত ঘটছে। কারা- হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেড়েছে, সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি বরং উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। অপরদিকে গণপিটুনির মত আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনাও কমেনি। মানবাধিকার লংঘনের এই ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এসব ঘটনা রোধে সরকারের নিষ্কিৃয়তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।

এ প্রতিবেদন সম্পর্কিত বিস্তারিত ঘটনা পরিশিষ্টতে দেয়া হলো- 

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বন্দুকযুদ্ধ

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে, ২০২৩ সময়ে বন্দুকযুদ্ধের  ১টি ঘটনা ঘটেছে। কথিত গোলাগুলির ঘটনায়একজন নিহত ও অপর দুইজনকে আটক করা হয়েছে।

অপহরণ-নিখোঁজ

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের নামে যে অপতৎপরতা চলছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকারের চরম লংঘন। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং নাগরিক জীবনে চরম উৎকন্ঠা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত আস্থাহীনতার সৃষ্টি করছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ৩টি ঘটনায় ৫ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু

মে ২০২৩ মাসে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আসামির মৃত্যুর বিষয়টি অনাকাঙ্খিত ও অগ্রহণযোগ্য। যা জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে। এমএসএফ মনে করে প্রতিটি হেফাজতে মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া আবশ্যক।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অপতৎপরতার অভিযোগ

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী, মে ২০২৩ মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে ১টি নির্যাতন ও ১টি অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

কারা হেফাজতে মৃত্যু

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে ২০২৩ মাসে কারা হেফাজতে মোট ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এর সংখ্যা ছিল ১৬ জন। এ মাসে ৭ জন হাজতি ও ৪ জন কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে ২ জন নারী রয়েছেন। মৃত নারী হাজতিদের মধ্যে একজন ময়মনসিংহ কারা অভ্যন্তরে টিনের চালা ঘরের পেছনের অংশের আড়ার সঙ্গে গলায় নিজের ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন নারীসহ ২ জন, ময়মনসিংহ কারগারে ১ জন নারী, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ১ জন ও রাজবাড়ী কারাগারে ১ জনের মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, সকল কারাবন্দিকে বাহিরের হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তৃব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।

এমএসএফ মনে করে, কারা অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি, হেফাজতে মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি

১৯ মে,  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য আবু সাইদ ওরফে চাঁদ এবং দলের অন্যন্য কর্মীর বিরুদ্ধে দেশের ৮ টি জেলায় (রাজশাহী,  নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, ফরিদপুর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, রাজবাড়িতে) ১ টি করে  এবং  নোয়াখালিতে ২টি মোট  ১০ টি মামলা হয়েছে।  এর মধ্যে ২ টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। আবু সাঈদের বক্তব্য দেওয়ার পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে রাজশাহীতেই আটটি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে ৩টি মামলার আসামি আবু সাঈদ। গত ২৫ মে পুলিশ রাজশাহী নগরীর ভেড়ীপাড়া মোড় থেকে আবু সাঈদ চাঁদকে সন্ত্রাস দমন আইনের মামলায় গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে বিজ্ঞ আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ৩০ মে তাকে আবারও আদালতে আনা হলে, গোয়েন্দা পুলিশ আবু সাঈদ চাঁদের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত শুনানি শেষে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গুরুত্ব বিবেচনায় জেলা পুলিশ সুপার মামলাটি তদন্তের জন্য জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। পুলিশের গায়েবি মামলা দায়েরের উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ছে না। চট্টগ্রামে কারাগারে রয়েছে এমন দুজনের নামেও নতুন মামলা দেওয়া হয়েছে যা ভয়াবহ পুলিশি অপতৎপরতা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার/অপব্যবহার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবলভাবে সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও এ আইনে মামলার নামে হয়রানি অব্যাহত রয়েছে ও এর যথেচ্ছ অপব্যবহারের বিষয়টি ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। কর্তৃপক্ষ বারবার এ আইনের সংশোধনীর  কথা বললেও কিছু দিন আগে আইন মন্ত্রী জানিয়েছে, বর্তমান বাস্তবতায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে ২০২৩ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮টি মামলায় ২৮ জন গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ২৭ জন বিএনপি কর্মী এবং ১ জন যুবক রয়েছেন। মে মাসে মামলার সংখ্যা ছিল ৭টি এবং গ্রেফতারের সংখ্যা ছিল ৮ জন। এ মাসে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে  ১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে আদালত। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে কানাডা প্রবাসী ১ ও আমেরিকায় প্রবাসী ২ জন ও গাইবান্ধার ১ জনসহ মোট ৪ জনের নাম উল্লেখসহ ৮ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে রংপুরের সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে রাজশাহীর বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদসহ দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ফরিদপুর এবং রাজবাড়িতে ১ টি করে মোট ২টি  ডিজিটাল নিরাপত্তা  আইনে মামলা হয়েছে। এ মামলাগুলোতে ৫ জনের নাম উল্লেখসহ আরো ৩০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬টি মামলা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মী ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এ ধরনের সমালোচনামূলক পোস্ট/শেয়ার/ কমেন্ট করার কারণে, ১টি মামলা হয়েছে ফেসবুকে কটূক্তি এবং ১ টি মামলা হয়েছে প্রতারণার অভিযোগে ।

এ আইনের যথেচ্ছ অপব্যাবহারের মাধ্যমে মানুষকে তাঁর মতামত প্রকাশে বাঁধাগ্রস্থ করা ও ভয় দেখানো এবং সকলের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার একটি ভয়ংকর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এম এস এফ এই আইনের বাতিল দাবি করছে।

সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের অধিকারের লংঘন

স্বাধীন সাংবাদিকতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় এ মাসে অন্তত ৪৫ জন সাংবাদিক নানাভাবে হুমকি, নিপীড়ন, হয়রানি, নির্যাতন শিকার হয়েছেন, যা মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে। শারীরিকভাবে আক্রমণ, হয়রানি, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র অনাকাঙ্খিতই নয় বরং তার মাধ্যমে সৎ সাংবাদিকতার কন্ঠরোধ করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ছাড়া এ মাসে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানবাধিকার লংঘনের চিত্র ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

শেয়ার করুন