২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ১১:৪২:০৪ পূর্বাহ্ন


বিএনপির আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ প্রশাসনকে ভোটের কাজে চায় না আ.লীগ
ইসিতে শুদ্ধি অভিযানের দাবি আওয়ামী লীগের
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৮-২০২২
ইসিতে শুদ্ধি অভিযানের দাবি আওয়ামী লীগের


নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসি সংলাপে আওয়ামী লীগ মোট ১৪টি দাবি দিয়েছে। যার মধ্যে একটি হলো প্রায় দেড়যুগ আগে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি ও জামায়াত জোটের সময়ে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেয়া বিএনপি ও জামায়াতপন্থী নির্বাচন কর্মকর্তাদের খটুজে বের করে নির্বাচন কমিশনে দায়িত্বহীন করা এবং তাদেরকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অকার্যকর রাখা, যা এক অর্থে নির্বাচন কমিশনে শুদ্ধি অভিযান তুল্য।  

দেড়যুগেরও আগে কথিত জোটপন্থীদের দিয়ে ২০১৪ ও ২০১৮ সনে,কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি। যে দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় টিকে আছে। হঠাৎ ওইসকল কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার হেতু কী? দাবিতে বলা হয়, ‘এটি সর্বজন স্বীকৃত, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনকে দলীয়করণ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে একদিকে যেমন দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত অশুভ জোট সরকারের সময় কর্মকর্তা পর্যায়ে হাওয়া ভবনের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক দলীয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়। ওইসব দলীয় ব্যক্তি এখন নির্বাচন কমিশনের আওতাভুক্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত রাখার লক্ষ্যে এ বিষয়ে কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় দলীয়করণের অংশ হিসেবে পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনে ব্যাপকভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের দেয়া হয়েছে। তাদের অনেকেই এখন জেলা পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অথবা দায়িত্ব পাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ। এসব কর্মকর্তার তালিকা প্রস্তুতপূর্বক তাদের সবধরনের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বাইরে রাখতে হবে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ, সিভিল প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বের বাইরে রাখা এ দাবি জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গত ৩১ জুলাইনির্বাচন ভবনে ইসির সঙ্গে সংলাপে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। 

একইসঙ্গে নির্বাচনকালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় সব সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানকে ইসির অধীনে ন্যস্ত করাসহ বাকি ১৩টি প্রস্তাব ছাড়াও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের তিনশো আসনেই ইভিএমে ভোটের দাবি জানিয়েছে টানা তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। 

এদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এসব প্রস্তাবনা বা দাবি অবশ্যই সিইসি আমলে নিলে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা পাবে রাষ্ট্র ও দেশ। কিন্তু যে বিষয়টা নিয়ে আলোচিত হচ্ছে সেটা বিএনপি-জামায়াতের আমলে নিয়োগ পাওয়া নির্বাচন কমিশনে কর্মকর্তা কর্মচারীরা। সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেও যারা ওই আমলে চাকরি পেয়েছেন তাদের চিহ্নিতকরণ ও নির্বাচন কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা। 

এখন প্রশ্ন কেন তুললো আওয়ামী লীগ ওই প্রশ্ন। এটা উল্টা আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল কি-না। একইসঙ্গে তৃতীয় নির্বাচনে কেন ওই সকল পুরোনো ও জোটসরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরাকাঠগড়ায়। কেন তাদেরকে নিষ্ক্রিয় রাখতে হবে। তাহলে এর বাইরে আওয়ামী লীগের টানা তিন টার্মে যে সকল নিয়োগ হয়েছে সেখানে কী কোনো বিএনপি ও জামায়াতপন্থী লোক ঢোকেনি। নিয়োগ পায়নি? 

আওয়ামী লীগের ওই তিন টার্মের মধ্যে যে বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা নিয়োগ পায়নি সে গ্যারান্টি কী। তাহলে কী প্রতিটা নিয়োগে প্রতিটা চাকরিপ্রার্থীর আমল নামা অর্থাৎ তার  লাইফ হিস্টোরি, বাবা-মা’র লাইফ ও রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করে নিয়োগদান করা হয়েছে। যদি সেটাই হয়, তাহলে এ তিন টার্মে নিয়োগপ্রাপ্তরা কারা। তাদের পরিচয় কী। দেশে নিরপেক্ষ লোক আছে এমন কথা কেউই বিশ্বাস করবেন না। কেউ হয়তো বিএনপি, কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ জামায়াত, জাতীয় পার্টির সাপোর্টার। কিন্তু নিয়োগে বিএনপি বা তাদের প্রতি সমর্থন থাকাদের যদি ছাকনি দিয়ে ছেঁকে নেয়া হয়, তাহলে নিয়োগপ্রাপ্তরা কারা সেটা আর বুঝতে বাকি থাকে? তাহলে আওয়ামী লীগের এ দাবির পরিপেক্ষিতে বিএনপি যদি নিরপেক্ষতারধুয়া তুলে একই দাবি করে বসে, তাহলে নির্বাচন কমিশনের অবস্থা কী দাঁড়াবে? এক কথায় এমন কর্মকর্তাদের খুঁজতে যাওয়া মানেই সকলের পিঠে একটি দলীয় সিল মেরে দেয়া নয়কি। খোদ নির্বাচন কমিশনেই যদি থাকে দেশের রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সিল মারা কর্মকর্তা। তাদের দ্বারা সাধারণ জনগণ ভালো কী আশা করবে? 

তবু একটা দাবি তোলা সেটা একজন মানুষ বা একটা রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। বিজ্ঞ সিইসি সেটা কীভাবে ম্যানেজ করবেন সেটা তিনিই বুঝবেন। তবে সব দলকেই আশ্বস্ত করে ভোটে আনা নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেটা করতে যেয়ে তিনি যেটা করবেন সেটাতে জনগণ আশ্বস্ত থাকতে হবে এটাই বড় কথা। 

আওয়ামী লীগের বাকি ১৩ প্রস্তাবগুলো হলো-

১. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা ঊর্ধ্বে রেখে সংবিধান ও আইনে প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে সক্ষমতা প্রদর্শন।

২. নির্বাচনকালীন নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-সংস্থার দায়িত্বশীলতা।

৩. ছবিযুক্ত একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা এবং ভোটগ্রহণের দিন নির্বাচন কেন্দ্রের সার্বিক নিরাপত্তা।

৪. ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণ বৃদ্ধি করা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতের মতো প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোট ডাকাতি ও ভোট কারচুপি বন্ধ করতে ইভিএমের কোনো বিকল্প নেই। ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহারের শুরুর দিকে কিছু কিছু ভোটারের অপছন্দ থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় প্রমাণিত হয়েছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখল, ভোট কারচুপি- এসব বন্ধ করে একটি টেকসই স্বচ্ছ নির্বাচন পদ্ধতি বাস্তবায়ন ইভিএম ব্যবস্থায় সম্ভব।

বর্তমান সরকারের অব্যাহত সহায়তা ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে এখন ১ লাখ ৫০ হাজারের অধিক ইভিএম মেশিন রয়েছে, যা দিয়ে মোট ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১৩ হাজার কেন্দ্রে শতকরা মাত্র ৩১ শতাংশ কেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট নেয়া সম্ভব। আগামী নির্বাচনে ইভিএম মেশিনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে হবে।

৫. বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবর্তে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার পদে নিয়োগ করা।

৬. আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদের নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল আচরণ।

৭. দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী কোনোভাবেই কোনো দল বা প্রার্থীর প্রতি অনুগত বা কোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে পরিচিত বা চিহ্নিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না।

৮. নির্বাচনে পেশিশক্তি ও অর্থের প্রয়োগ বন্ধ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সব পর্যায়ের ভোটারের অবাধ ভোটদানের সুযোগ নিশ্চিত করা।

৯. নির্বাচনের পূর্বে ও পরে সর্বসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

১০. নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত করা।

১১. নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি কেবল আবশ্যকীয় দৈনন্দিন (রুটিন) কার্যাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।

১২. অ্যাডহক বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার পরিবর্তে টেকসই সাংবিধানিক, আইনি ও রেগুলেটরি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা।

১৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি পাস্টএন্ড ক্লোজ চ্যাপ্টার। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক এবং অবৈধ ঘোষণা করেছে। আইন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১-এর বিধান অনুযায়ী এই বিষয়ে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার নেই। এ বিষয়ে সাংঘর্ষিক কোনো মন্তব্য করা সংবিধান লঙ্ঘন করার শামিল।

এ প্রস্তাবগুলো ছাড়াও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক রেগুলেটরি কমিশন ‘নির্বাচন কমিশনকে’ সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করবে।

ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল সংলাপে অংশ নেয়। প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিলেন- উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, ড. আব্দুর রাজ্জাক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। আর নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল, চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।


শেয়ার করুন