১২ এপ্রিল ২০১২, বুধবার, ০৬:৩৩:০৩ অপরাহ্ন


রিজার্ভ নিয়ে যতো উৎকণ্ঠা!
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-১১-২০২২
রিজার্ভ নিয়ে যতো উৎকণ্ঠা! বাংলাদেশ ব্যাংক


বাংলাদেশের এখন গ্রামগঞ্জের দিনমজুর থেকে শুরু করে গৃহবধূরাও বাংলাদেশের ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাবটার খবর রাখার চেষ্টা করেন। ক’মাস আগেও অর্থনীতির এ বিষয়গুলো সমাজের অনেক শিক্ষিতরাও মাথায় নিতেন না। তাদের কথা কী লাভ এগুলো ভেবে। তবে শ্রীলঙ্কা যখন দেউলিয়া হয়ে চরম অর্থ সংকটে। তখন থেকে একটু-আধটু জানার চেষ্টা অনেকের। তাদের প্রশ্ন ছিল তাহলে আমাদের কী অবস্থা? সরকারবিরোধীরাও বলছিলেন, বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে। সে থেকে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ সর্বসাধারণে। 

তবে এ হিসাব কড়াকড়ি নেয়া শুরু যখন দ্রব্যমূল্যের ক্রমশ ঊর্ধ্বগতি। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলে সংকট। স্পটমার্কেট থেকে জ্বালানি ক্রয়ে সংকট। আর্থিক সমস্যা। বিদেশ থেকে আমদানিতে কঠোরতা। প্রধানমন্ত্রী নিজেই যখন বলছেন, দুর্ভিক্ষ আসতে পারে, কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে। বিলাসবহুল দ্রব্যাদি আমদানিতে উৎসাহ কমাতে। রিজার্ভ কী চিবিয়ে খেয়েছে। রিজার্ভের টাকা গেছে পায়রা বন্দরে, রিজার্ভের টাকা গেছে উন্নয়ন প্রকল্পে, রিজার্ভের টাকা গেছে সাধারণ মানুষের জন্য বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যাতি আমদানিতে। ফলে দেশের টাকা দেশেই রয়েছে। 

তখন থেকেই মানুষ বলতে শুরু করেছে যদি মেগা প্রজেক্টগুলো করতে যেয়ে রিজার্ভ সংকট হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। জ্বালানি সংকটে চরম বিদ্যুৎ সংকট হয়। লোডশেডিং হয়। তাহলে সে মেগা প্রজেক্টগুলো কিছু কমিয়ে করলেই তো চলতো। মানুষকে কষ্ট দেয়া কী উচিত।

সাধারণ মানুষের সোজাসাপটা কথা। তবে রিজার্ভ সংকট যে আসলেই সে জন্যই কঠিন শর্তাদি মেনে আইএমএফের লোন চাওয়া। সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার লোন চাওয়া হয়েছে। ইদানীং এ লোন প্রাপ্তি ও প্রাপ্তির সম্ভাবনা দুটো বক্তব্য আবার মানুষকে বিভ্রান্ত তৈরি করেছে। আইএমএফের স্টাফরা বাংলাদেশ সফর করে এ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে চলে গেছেন। যাবার সময় যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেটা লোন অ্যাপ্রুভালের। অর্থাৎ বাংলাদেশ কয়েকটি কিস্তিতে ওই লোন পাবে। কবে থেকে পাওয়া যাবে সেটা স্পষ্ট না হলেও আইএমএফ লোন দিচ্ছে এটাতে কিছুটা স্বস্তি চারদিকে। রিজার্ভ কিছুটা সমৃদ্ধ হলে তাতে আমদানিতে ব্যাংক এলসি খুলবে। শিল্প-কলকারখানা যে সংকটে সেটা কিছুটা কমবে। বিদ্যুৎ সংকট কমবে। গ্যাস সংকটের জন্য যে শিল্প-কলকারখানা কাজ করতে চরম দুশ্চিন্তায় সেটাও লাঘব হবে। 

কিন্তু বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও আইএমএফ এ দীর্ঘদিন চাকরি করে আসা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম শাহ এ এস এম কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়ার বক্তব্য নতুনভাবে ভাবাচ্ছে। 

গত ৯ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। গত ৯ নভেম্বর সচিবালয়ে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘যেভাবে আমরা চেয়েছিলাম, আইএমএফ সেভাবেই আমাদের ঋণ দিচ্ছে। আইএমএফের ঋণ আমরা পেতে যাচ্ছি।’ 

আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে তারা ঋণ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করবে। ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ১ ডলার ১০০ টাকা ধরলে ৪৫ হাজার কোটি টাকা)। সাত কিস্তিতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ঋণ আসবে। প্রথম কিস্তি আসবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। 

এ সময় তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, প্রথম কিস্তিতে আসবে ৪৪৮ মিলিয়ন ডলার। এর জন্য বাংলাদেশকে কোনো সুদ দিতে হবে না। পরবর্তী সাত কিস্তিতে বাকি অর্থ আসবে। প্রতি কিস্তি অর্থের পরিমাণ হবে ৫৫৯ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলার। এটার জন্য বাংলাদেশকে ২ দশমিক ২ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে।’ 

অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের তাৎক্ষণিক জবাবে ড. রেজা কিবরিয়া আইএমএফের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলাদেশের তাদের স্টাফের ভিজিট ও কর্মতৎপরতা নিয়ে যে প্রেস রিলিজ দিয়েছে তার উদ্ধৃতি দিয়ে তার ইউটিউব চ্যানেলে বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের ভুল ইনফরমেশন দেয়া হচ্ছে। কারণ আইএমএফের লোন স্টাফরা দেন না। কারণ লোনটা স্টাফের বাবার সম্পত্তি নয়। স্টাফ তাদের সুপারিশমালা আইএমএফের বোর্ডে পাঠাবে। সেখানে আলোচনা করে, পর্যালোচনা করে লোন দেবে কি না সেটার সিদ্ধান্ত হবে।’ ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘আমি আইএমএফে ১১ বছর হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। আরো ৬ বছর উপদেষ্টা হিসেবে আফ্রিকান জোনের বেশ কয়েকটি দেশের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি। আমি জানি, আইএমএফের লোন দেয়ার সিস্টেমটা কী।’ তিনি বলেন, ‘আইএমএফের যে রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন সেগুলো আগের মতোই বহাল রয়েছে। এখানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা একটা স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেন করে। আমরা এক দেশে আইএমএফের এক্সিকিউটিভ বোর্ডে অ্যাপ্রুভালের প্রয়োজন। তারাই ঠিক করে লোন দেবে কি না। ফলে এটা আইএমএফ বোর্ডে না যাওয়া পর্যন্ত এ লোন অ্যাপ্রুভ হবে না।’  

ড. রেজা কিবরিয়া আইএমএফের দেয়া তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত স্টেটমেন্টের কথা উল্লেখ করে আরো বলেন, ‘সেখানে তারা লিখেছে এবং এটা যে কেউই গুগলে সার্চ করলে দেখতে পারবে যে ‘বাংলাদেশে সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে আইএমএফ স্টাফ লেবেলে একটা অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে এবং এটা প্রথমবারের মতো আইএমএফ স্টাফদের সফর করার পর তারা এ ব্যাপারে রাজি হয়েছে। তবে আগামী মাসগুলোতে এ আলোচনা আরো চলবে। তবে স্টাফ লেবেলের অ্যাগ্রিমেন্ট কখনই আইএমএফ বোর্ডের সিদ্ধান্তের প্রতিনিধিত্ব করে না। বোর্ড মূলত এ ব্যাপারে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। যেটা আরো পরের কথা। কিন্তু এক্ষুণি লোন অ্যাপ্রুভাল হয়েছে, এটা ঠিক তথ্য না।’ 

এছাড়াও রেজা কিবরিয়া জানান দিয়েছেন, বাংলাদেশ কোন কোন খাতে আইএমএফের লোন পেতে পারে সে বিষয়গুলো। অর্থাৎ আইএমএফের লোন দিয়ে সবকিছু করা যাবে না।

রেজা কিবরিয়া বিগত কিছুদিন আগের জ্বালনি উপদেষ্টার একটা বক্তব্যের উল্লেখ করে বলেন, ‘ সরকার থেকে বলা হচ্ছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ রয়েছে। যদি ওই তথ্য সঠিক হয়, তাহলে তো আমদানি করতে সমস্যা নেই। এলসি খুলতে বাধা-বিপত্তির কথা না। ক’দিন আগে জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহি ব্যবসায়ীদের একটা অনুষ্ঠানে বলেছেন, জ্বালানি ও গ্যাস ক্রয়ের মতো অর্থ রিজার্ভে নেই। তিনি জেনেশুনে কথা বলেন। তিনি অহেতুক বাজে মন্তব্য করার মানুষ নন। তার কথাই রাইট হতে পারে। যে রিজার্ভ সত্যিই নেই, যার জন্য চারদিকে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে।’

শেয়ার করুন