২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ০১:৫৭:৪৬ পূর্বাহ্ন


লাইলাতুল-কদরের তাৎপর্য
ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৪-২০২২
লাইলাতুল-কদরের তাৎপর্য


লাইলাতুল কদর পবিএ রমজানের অন্যতম উপহার: লাইতুল-কদর, মাগ্ফিরাতের ও আল-কুর’আনের এবং আদম সন্তানকে আল্লাহ তা’আলার পবিএবাণীর উদ্ভাসিত আলোর স্পর্শে অনন্তকাল শান্তির জান্নাতের দিকে আহ্বান করার মহিমান্বিত রাত। যে রাতের মাহাত্ম্য ও মর্যাদার সাথে বছরের অন্য কোন রাতের তুলনা করা যায় না। এই রাতের তাৎপর্যে ও গুরুত্বে শুধুমাএ মুসলিম উম্মাহর জন্যই নয় বরং সকল আদম সন্তানরে জন্য মহাকল্যাণ অন্তনির্হিত রয়েছে। এজন্যই এই পবিএ রাত হচ্ছে মানজাতির জন্য আল্লাহ তা’আলার সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার, দান ও অনুগ্রহের একটা অন্যতম উদাহরণ। মানবজাতির মধ্যে মুসলিম উম্মাহই একমাএ মহাভাগ্যবান  সম্প্রদায়, যারা এই পবিএ রাতের মাহাত্ম্যের ও তাৎপর্যের মূল্যায়ণ করে প্রতিবৎসরই লাভবান হয়ে থাকেন। মানজাতির অন্যেরা উদসীনতা অথবা অহংবোধে নিজেদেরকে আল্লাহ তা’আলার সীমাহীন অনুগ্রহ এবং এই রাতের প্রভূত কল্যাণ থেকে  বরাবর বঞ্চিত রাখছেন। এই মহাকল্যাণের রাত সকল আদম সন্তানের জন্য গুরুত্বর্পূণ এই জন্য যে, এই রাতে দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহ তা’আলা, তার শাশ্বত পবিএবাণী আল-কুর’আন নাযিল করে আদম সন্তানদের অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে বিশ্বাসের আলোকে পর্দাপণ করার সুযোগ দিয়েছেন। আল-কুর’আন সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১: আলিফ-লাম-রা; এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি-যাতে তুমি মানুষকে অন্ধকার [অবিশ্বাস] থেকে আলোর [সত্যপথের] দিকে বের করে আন- পরাক্রান্ত, প্রশংসার যোগ্য প্রতিপালকের নির্দেশে  তারই পথের দিকে।{সূরা ইব্রাহীম}। 

তাই এই মহিমান্বিত রাত সমস্ত মানবজাতির জন্য কল্যাণকর এবং হৃদয়ে প্রশান্তি প্রতিষ্ঠিত করার উৎসের {আল-কুর’আনের] অবর্তীণ হওয়ার উৎসবের রাত। কারণ মানুষ নিবিড় অন্ধকার থেকে যখন দীপ্তিময় আলোকে পর্দাপণ করেন তখন র্নিভয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে প্রশান্তি লাভ করে থাকেন। আল-কুর’আন আদম সন্তানদের দিয়েছে অবিশ্বাসের অন্ধকারের ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত [জাহান্নামের শাস্তি থেকে] হওয়ার সুস্পষ্ট পথ র্নিদেশ। অনুরূপ লাইলাতুল কদর হচ্ছে প্রশান্তির রাত, আল্লাহ তা’আলার শাস্তির ভয়-ভীতি থেকে নিশ্চিত মুক্তি পাওয়ার এবং আল্লাহ তা’আলার নৈকট্যলাভের জন্য উৎসবের রাত। কারণ লাইলাতুল কদরে দৃঢ় বিশ্বাসে  অনুতপ্ত অন্তরে এস্তেগফার  এবং ইবাদতের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ পাপ থেকে মুক্তি লাভে পরহেজগারীর পদমর্যাদায় উর্ত্তীণ হয়ে সম্মানিত ইবাদী হয়ে যান। কদরের রাত সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১: আমি একে [আল-কুর’আনকে] নাযিল করেছি লাইলাতুল-কদরে। ২: লাইলাতুল কদর সম্পর্কে তুমি কি জান। ৩: লাইলাতুল কদর হচ্ছে এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ৪: এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফিরেশতাগণ ও রূহ অবর্তীণ হয় তাদের প্রতিপালকের র্নিশেক্রমে। ৫: এটা নিরাপত্তা যা ফযরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।{সূরা আল-কদর}। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “লাইলাতুল কদর হচ্ছে এক হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ” তাই এই পবিএ রাতের মাহাত্ম্যের ও তাৎপর্যের সাথে অন্যকোন রাতেরই তুলনা হয় না। সূরা কদরের নাযিল সম্পর্কে ইবনে আবী হাতেম (রাঃ) বলেন, “রাসূল (সা.) একবার বনী-ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকে এবং কখনও অস্ত্র সংবরণ করেনি। একথা শুনে মুসলিমরা বিস্মিত হলে এই মহিমান্বিত সূরা নাযিল হয়।” তাই বলা যায় , এই পবিএ রাতে ইবাদত করলে মুসলিমরা এক হাজার মাস অবিরাম জিহাদে লিপ্ত থাকার চেয়েও বেশী সম্মান তারা আল্লাহ তা’আলার নিকট থেকে পাবেন। এতে মুসলিম উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমানও আছে।{তফসীর মা’আরিফুল কুর’আন, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ৮৪৩, ইংরেজী অনুবাদ}। 

পবিএ রমজানকে আল্লাহ তা’আলা করেছেন “তাক্ওয়া অথার্ৎ আল্লাহ-সচেতনতা” অর্জনের অথবা পরহেজগারীর/মুত্তাকীর পদমর্যাদায় উর্ত্তীণ হওয়ার মাস। এই পবিএ মাসেই রয়েছে কদরের রাত, যে রাতের মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণে তাকে বলা হয় “লাইলাতুল-কদর” তথা মহিমান্বিত রাত। আবু বকর ওয়াররাক (রাহি.) বলেন, এই রাতকে লাইলাতুল-কদর বলার আরেকটা কারণ হচ্ছে যে, ইবাদত না করার জন্য এর পূর্বে যার কোন সম্মান ও মূল্য থাকে না, সে এই রাতে তাওবা-এস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে সম্মানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।{তফসীর মাআরেফুল কুর’আন, খন্ড ৮,পৃষ্ঠা ৮৪৪}। এই রাতকে আবার তকদীরের এবং আদেশের রাতও বলা হয় কারণ এই পবিএ রাতে পরবর্তী বৎসরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফিরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়ে থাকে। এই রাতে প্রতিটা আদম সন্তানের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি, আগামীতে কারা হজ্জ করবেন ইত্যাদির পরিমান নির্দিষ্ট ফিরেশতাদের কাছে লিখে দেওয়া হয়। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, ‘চারজন ফিরেশতাকে [ইসরাফিল , মীকাঈল, আযরাঈল এবং আর-রূহ {জীব্রিল (আঃ)}] এসব কাজ সোর্পদ করা হয়।{তফসীর মা’আরেফুল কুর’আনে আল-কুরতুবীর উৎস থেকে এটা উল্লেখ করেছেন]। যাহোক লাইলাতুল-কদরের রাত যে রমজান মাসে  পাওয়া যায় তা আল-কুর’আন থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন ,“আমি আল-কুর’আন নাযিল করেছি রমজান মাসে এবং কদরের রাতে” অর্থাৎ কদরের রাত রমজান মাসেই অবস্থিত। এসম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১৮৫: রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুর’আন, যা মানুষের জন্য হিদায়েত এবং সত্যপথযাএীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।{সূরা আল-বাকারাহ}; ৩: আমি একে [আল-কুর’আন] নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সর্তককারী। ৪: এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞার্পূণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।{সূরা আদ-দুখান}। 

উল্লিখিত আয়াত থেকে সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়, কদরের রাতে সকল আদম সন্তানের জন্যই কল্যাণ রয়েছে। তবে যারা তাওহীদে বিশ্বাসী হয়ে আল্লাহ তা’আলার কাছে সস্পূর্ণরূপে আত্মসমúর্ণ করেন তারাই এই কল্যাণময় রাতের অবারিত বরকতের ভাগীদার হয়ে থাকেন। ইবনে কাসীরের (রাহঃ) তফসীর থেকে জানা যায়, ইবনে আব্বাস (রাঃ) আল-কুর’আন নাযিল সম্পর্কে বলেছেন, “এই মহিমান্বিত রাতে সম্পূর্ণ কুর’আন আল্লাহ তা’আলা ‘আল-লাওহ আল-মাহফুয’ থেকে বাইতুল-ইয্যাতে [মহামহিম ভবনে] অবর্তীণ করেন। এই মহামহিম ভবনের অবস্থিতি হচ্ছে পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে। অতঃপর বিভিন্ন পরিস্থিতির ভিত্তিতে আল-কুর’আনের অংশ বিশেষ ২৩ বৎসর ধরে আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেন।”{ইবনে কাসীর, খন্ড ১০, পৃষ্টা ৫৪২}। লাইলাতুল-কদর হচ্ছে শেষ নবী, আল্লাহ তা’আলার হাবীবের (সা.) উম্মাহর প্রতি আল্লাহ তা’আলার সীমাহীন অনুগ্রহের একটি অন্যতম নির্দশন। পূর্ববর্তী রসূলদের উম্মতের কাউকে আল্লাহ তা’আলার কাছে আত্মসমর্úণ করে তাওবা ও একনিষ্ঠ ইবাদতের মাধ্যমে পূর্ববর্তী বৎসরের পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার এরকম সুযোগ আল্লাহ তা’আলা দেননি। এক রাতের ইবাদত হচ্ছে ৮৩.৩ বৎসরের ইবাদতের চেয়েও মূল্যবান ও অধিক মর্যাদাবান। তাই ধীশক্তিসম্পন্ন ও সুস্থ মস্তিষ্কের কোন মুসলমানই জীবদ্দশায় এই মহাসুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না। প্রতিদিনই প্রতিমূর্হুতে হাজার হাজার মুসলমান পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন, তাদের মধ্যে ৮০ বৎসরের বেশী বয়স ব্যক্তির পরিমান অতি সামান্য। বস্তুত পার্থিব জীবনে কোন ব্যবসাই একরাতে ৮৩ বৎসরের ক্ষতিপুরন অথবা মুনাফা দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিতে পারবে না। কারণ ব্যবসার উন্নতি ও সফলতায় প্রকৃতপক্ষে কারও হাত নেই বরং আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহে, আদেশে, নিয়ন্ত্রনে হয়ে থাকে। তদুপরি কোন ব্যবসাই একমালিকের অধীনে এতবেশী দিন থাকে না। অথচ আল্লাহ তা’আলার সাথে এই পবিএ ব্যবসায় পাপে র্জজড়িত, আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীকে একরাতের ইবাদতের বা ব্যবসার পুরস্কার হিসেবে সুদে-আসলে পুরোটাই তার হিসাবের খাতায় জমা করার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পার্থিব জীবনের ব্যবসার বাণিজ্যিক মেলা হয়ে থাকে। তদুপরি বৎসরে অনন্তত একবার আর্ন্তজাতিকভাবে বাণিজ্যিক মেলা হয়, যে মেলাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছোট-বড় খ্যাত-অখ্যাত ভাল-মন্দ সবরকম ব্যবসায়ীরা নিজেদের পণ্যদ্রব্য নিয়ে হাজির হয়ে খরিদ্দাদের কাছে পণ্রদ্রব্যের গুণগান করেন এবং উৎকৃষ্ট দ্রব্য প্রদর্শনীতে রাখেন। যাতে খরিদ্দাররা পণ্যদ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সন্তুষ্টি চিত্তে সেগুলো যর্থাথ মূল্য দিয়ে ক্রয় করতে উদ্যোগী হয়। উৎকৃষ্ট পণ্রদ্রব্য প্রদর্শন করে ব্যবসায়ীরা অতীতের নিম্নমানের অথবা ক্রটিযুক্ত পণ্যের বদনামকে মুছে ফেলার জন্যই একাজ করে থাকেন। তদুপরি ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের উন্নতিতে ও সাফল্যে মেলায় প্রদর্শিত পণ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনুরূপভাবে লাইলাতুল-কদর মুসলিমদের জন্য এমন গুরুত্বপূর্ণ মেলা, যা আর্ন্তজাতিকভাবে বৎসরে  একবার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সারা বিশ্বের মুসলিমরা [ছোট-বড় পাপিষ্ঠ ও পূণ্যবান ইবাদীরা] সকলেই একাগ্রচিত্তে উৎকৃষ্ট পন্থায় ইবাদতে মশগুল থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ খরিদ্দার আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যাশায় সমস্ত রাত অতিবাহিত করেন।  যাতে র্পূববর্তী জীবনের ইবাদতে যা কিছু ভুল-ত্রুটি আছে তা যেন উপেক্ষা করে দয়াময় পরম দয়ালু  সর্বশ্রেষ্ঠ খরিদ্দার আল্লাহ তা’আলা, তার ইবাদী ব্যবসায়ীকে ক্ষমা করে দেন। এই মহিমান্বিত রাতে ইবাদীর প্রত্যাশার স্বীকৃতি হিসেবে আল্লাহ তা’আলার ক্ষমা এবং অনুগ্রহ সম্পর্কে হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। 

রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে [ইবাদতে] দাড়াল, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ২, ১৮৭১}। রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, লাইলাতুল-কদর অনুষ্ঠিত হযে থাকে রমজানের শেষ দশ রাতে। যদি কেউ এই সকল রাতে ইবাদত করে আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ খোঁজ করে তাহলে বস্তুত তার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। ইহা হচ্ছে বিজোড় রাএি, যেমন ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ রমজানের রাত।{আহমদ, ৫:৩২৪, ইবনে কাসীরের তফসীর, খন্ড ১০, পৃষ্ঠা ৫৪৪}।  এই অনন্ত অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুসলিম উম্মাহর উচিত পবিএ লাইলাতুল-কদরে একনিষ্ঠ অন্তরে ইবাদতে মশগুল থাকা এবং আল্লাহ তা’লার ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশায় ভয়-ভীতি ও সন্দেহ পরিহার করে একাগ্রচিত্তে প্রশান্ত হৃদয়ে প্রতিপালক দয়াময় আল্লাহ তা’আলার কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসম্পর্ণ করা। লাইলাতুল-কদরের সুনির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে রাসূল (সা.)কে আল্লাহ তা’আলা জ্ঞান দিয়েছিলেন তবে এই সময় মুসলিমদের জৈনক দুই ব্যক্তি ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকায়, সে জ্ঞান আল্লাহ তা’আলা তুলে নিয়েছেন। এসম্পর্কে উবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) [একদা] আমাদেরকে লাইলাতুল-কদর [এর সঠিক তারিখ] সম্বন্ধে অবহিত করার জন্য বেরিয়ে এসেছিলেন। এমন সময় দু’জন মুসলমান বিবাদ করতে লাগল। তখন তিনি (সা.) বললেন আমি বের হয়েছিলাম, তোমাদেরকে লাইলাতুল-কদর [এর সঠিক তারিখ সম্বন্ধে] খবর দেওয়ার জন্য। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি ঝগড়ায় লিপ্ত হল। তাই [এর জ্ঞান আমার থেকে] উঠিয়ে নেওয়া হল। সম্ববতঃ এর মধ্যেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত ছিল। অতএব, তোমরা লাইলাতুল-কদরকে [শেষ দশ দিনের] নবম (২১), সপ্তম (২৩) ও পঞ্চম (২৫) রাএিতে তালাশ কর।{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ২, ১৮৮১}। 

উল্লিখিত হাদিসসমূহ থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ তা’আলার নৈকট্যলাভের প্রায়াসে আল্লাহ তা’আলার ভালোবাসায় এই মহিমান্বিত রাত পাওয়ার উদ্দেশ্যে, শুধুমাএ একটি রাতই নয় বরং রমজানের শেষ দশ রাতের বিজোড় রাএিসমূহে ইবাদতের সুযোগ আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে দিয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে রাসূল (সা.) উম্মাহর জন্য আল্লাহ তা’আলার অশেষ অনুগ্রহ। যারা আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞ, তারা  প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রত্যাশায় রমজানের পবিএতায় প্রশান্তচিত্তে ইবাদত করার একাধিকবার সুযোগ পাওয়ায় অবশ্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কৃতজ্ঞ বান্দা হবেন। যাহোক লাইলাতুল-কদর সম্পর্কে সহীহ মুসলিম থেকে জানা যায় ওবাইয়ে ইবনে কা’ব (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা.) বলেছেন “লাইলাতুল-কদর” সংঘটিত হয় রমজানের ২৭ রাতে।{মুসলিম ২:৮২৮, ইবনে কাসীরের তফসীর, খন্ড ১০, পৃষ্ঠা ৫৪৬}। সহীহ আল-বোখারী এবং অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে আরও অনেক হাদিস রয়েছে যেথায় লাইলাতুল-কদর সম্পর্কে বিভিন্ন বিজোড় রাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সব হাদিসের উপসংহার হচ্ছে আয়েশার (রাঃ) বর্ণিত হাদিস, রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমরা লাইলাতুল-কদরকে রমজানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাএিকে তালাশ কর।{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ২, ১৮৭৪}। তাসত্তে¡ও লাইলাতুর-কদরের সঠিক তারিখ নিয়ে পূর্ববর্তী আলেমদের মতনৈক্য ছিল এখনও আছে তবে সহীহ আল-বোখারী এবং অন্যান্য হাদিস গ্রন্থ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমান পাওয়া যায় যে, রমজানের শেষ দশ রাতে বিশেষভাবে বিজোড় রাতে লাইলাতুল-কদর পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। বিভিন্ন  হাদিস এবং পূর্ববর্তী আলেমদের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ইবনে কাসীর (রাহঃ) তফসীরে এরকম মন্তব্য করেছেন {খন্ড ১০, পৃষ্ঠা ৫৪৬}। 

অতএব মহিমান্বিত রাত কদর পাওয়ার প্রত্যাশায় শুধুমাএ রমজানের ২৭ দিনের রাতেই নয় বরং শেষ দশদিনের বিজোড় রাতসমূহে ইবাদত করার ইচ্ছায়  মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়াই আমাদের একান্ত কর্তব্য। এমন হতে পারে এই রমজানই আমাদের জীবনের শেষ রমজান, তাই বরকতময় রাত লাইলাতুল-কদর পাওয়ার সুযোগ হয়ত আমাদের জীবনের আর আসবে না। রমজান মাসের শেষ দশ দিনে মসজিদে ইতেকাফে বসা অত্যন্ত পূণ্যবান কাজ, তদুপরি আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্য লাভের, পাপ থেকে ক্ষমা এবং লাইলাতুল-কদর পাওয়ার অন্যতম সুযোগ। তাই কারোর যদি শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকে তবে এরকম সুযোগ হাতছাড়া না করই বুদ্ধিমানের কাজ। রাসূল (সা.) প্রতি রমজানেই শেষ দশ দিনে ইতেকাফে বসতেন, শুধুমাএ ইন্তেকালের বছর বিশদিন ইতেকাফ করেছেন। হাদিস থেকে ইতেকাফ সম্পর্কে জানা যায়, নবী-পত্নী আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা.) রমজানের শেষ দশদিনে ইতেকাফে বসতেন। এমনকি (এভাবেই) আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিলেন। তারপর তার পত্নীগণও ইতেকাফ করতেন।; আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা কররেছেন, রাসূল (সা.) প্রতি রমজানে দশদিন ইতেকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তার ইন্তেকাল হল, সে বছর তিনি বিশদিন ইতেকাফ করেছেন। {সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ২, ১৮৮৪, ১৯০১}। ইতেকাফের নিয়মাবলী সম্পর্কে ফিকাহ আস-সুন্নাহ থেকে বিস্তারিতভাবে জানা যায়, এখানে এসম্পর্কে আলোচনা করা সম্ভব নয়। রমজানের শেষ দশদিনে বিশেষভাবে কদরের রাতে বেশী করে দোয়া করা এবং পাপ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এব্যাপারে হাদিস থেকে একটা অতিসহজ ও সংক্ষিপ্ত দো’য়া সম্পর্কে জানা যায়, আয়েশা (রাঃ) একদা জিজ্ঞাসা করলেন, “ও আল্লাহর রাসূল! আমি যদি লাইলাতুল-কদর পাই তাহলে আমার কি বলা উচিত [অর্থাৎ কিভাবে দো’য়া করতে হবে]?” রাসূল (সা.) বললেন, “বল, আল্লাহুমা ইন্নাকা আফুও তুহেব্বু আফ্ওয়া ফা’আফু আন্নি” {অর্থ বল, “ও আল্লাহ! বস্তুত, তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালবাস, সুতরাং আমাকে ক্ষমা কর”}। 

এই সহজ দোয়া দিন-রাতে যেকোন সময়ই করা যায়। “ও আমাদের প্রতিপালক! তোমার অনুগ্রহ, অন্যতম উপহার লাইলাতুল-কদর পাওয়ার মত সুযোগ আমাদেরকে দান কর। এই রাতের মাহাত্ম্যের আতিশয্যে তোমার সান্নিধ্যপ্রাপ্ত বান্দাদের মধ্যে স্থান পাওয়ার সুযোগ আমাদেরকে দিও। শারীরিক ও মানসিকভাবে আমাদেরকে সুস্থ্য রাখ যাতে তোমার ইবাদতে আমরা মশগুল থাকতে পারি। আমাদেরকে ক্ষমা কর, বস্তুত তুমি অতিশয় দয়ালু, তোমার অনুগত পাপী বান্দাদের ক্ষমা করতে ভালবাস। করোনা ভাইরাস থেকে মানবজাতিকে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা কর। আমাদের প্রার্থনা কবূল কর, আমিন। 

শেয়ার করুন