১৮ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৭:১৯:০৮ অপরাহ্ন


আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল
শরিকদের সাইডলাইনে রেখে অন্য খেলায় ব্যস্ত সরকার
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০৫-২০২২
শরিকদের সাইডলাইনে রেখে অন্য খেলায় ব্যস্ত সরকার


জোটগতভাবে নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আশ্বাসে আস্থা নেই শরিকদের, বরং শরিকরা ভাবছে ও আশঙ্কায় আছে এবার আওয়ামী লীগ তাদেরকে সাইডলাইনে বসিয়ে রেখে অন্য খেলা খেলবে। একলাই চলবে দলটি। 

নীরব নিথর ১৪ দল

নীরব নিথর হয়ে আছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। হচ্ছে না কোনো গঠনমূলক বৈঠক, যা হচ্ছে তাকে বলা চলে ভার্চুয়াল। কিন্তু তা-ও দিবসকেন্দ্রিক। যদিও এবছরের মার্চে গণভবনে ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বলা চলে এক আকস্মিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ তিনবছর পরে অনুষ্ঠিত এমন বৈঠকে অনেক শরিক আশঙ্কা করেছিল প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা শরিকদের কাউকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করবেন। কারণ বেশ কয়েকদিন ধরে শরিকদের কারো বক্তব্য সরকারের খুবই বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছিল।

তাদের আশঙ্কা ছিল বৈঠকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের পক্ষ থেকে কঠোর মন্তব্যের ব্যাপারে হয়তো প্রধানমন্ত্রী কিছু বলবেন। কিন্তু উপস্থিত শরিকদের সে বৈঠকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী  ১৪ দলীয় জোটের ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন আমরা একসঙ্গেই করব। এ জন্য ১৪ দলকে সক্রিয় রাখতে হবে। তার বক্তব্যকে দৃঢ় করার জন্য তিনি বলেন, দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তি এখনও পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। তাই ১৪ দলকে একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে থাকবে, একসঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাড়াতে হবে। 

কিন্তু এরপরেও খোঁজ নেই

গণভবনে সে বেঠকে এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচার ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের  বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে ১৪ দলকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এতে শরিকদের মধ্যে আশা ছিল আওয়ামী লীগ মাঠে ময়দানে তাদের নিয়ে সক্রিয় হতে বলেছেন। আর এজন্য তারা আশায় বুক বেধেছিল, কিন্তু তা হয়নি। এমনকি গণভবনের আন্তরিক পরিবেশে বৈঠকের পরপরই নিজেদের মধ্যে একটি ঘরোয় বৈঠক করেন ১৪ দল নেতারা।

এরপরে পরে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু সারাদেশে জোটের কার্যক্রমকে সক্রিয় ও শক্তিশালী করার ঘোষণা দেন। কিন্তু দিন যায় মাস যায় ১৪দল আর জাগে না, বরং এর বিপরীতে ১৪ দলের এমন গুমোট পরিস্থিতিতেই অনেকটা বিক্ষুদ্ধ হয়ে জোট ছেড়েছে শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ। এমনকি আওয়ামী লীগ কিংবা ১৪ দলকে আনুষ্ঠানিকভাবে না জানিয়েই জোট ছাড়ে দলটি। অপরদিকে এদলটি জোট ছাড়ার পরও আওয়ামী লীগ বা জোটের অন্য কোনো শরিককেও উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। দলটিকে জোটে ধরে রাখতেও আওয়ামী লীগের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। 

তাহলে কেন প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক?

এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, মার্চে গণভবনে ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আকস্মিক বৈঠকের কারণ কি? কেন এমন আয়োজন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে শরকিদের বক্তব্য আসলে আওয়ামী লীগ ভালোভাবে নেয়নি। সরকার এসব বিষয়ে বেশ অস্বস্তিতে ছিল। যদিও সেদিনের বৈঠকে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেননি।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী আসলে এসব বিষয়ে শরিকদের বিরুদ্ধে কিছু বলার ইচ্ছাই ছিল। কিন্তু তাদের মুখে কুলুপ এটে যায় র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণায়। এনিয়ে আওয়ামী লীগসহ ১৪দলের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিকভাবে দেশে বিদেশে একধরনের অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিল। এসব হতাশা অস্বস্তিতে কিছু স্বস্তি দিতেই মার্চে গণভবনে ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে এমন আকস্মিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন।

এতে আওয়ামী লীগ সরকার একঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে। তারা মার্কিনিদের বোঝাতে চেয়েছে সরকারের সাথে তাদের বিরোধী শক্তি সক্রিয়। এতে মার্কিনি মোড়লিপনাকে একটু থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা। অন্যদিকে শরিদেরকে কিছুটা চাঙ্গা রাখা, যাতে করে সরকারকে একেবারে রাজনৈতিক শূন্যতায় আছে বলে মনে না করে কেউ। অন্যদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপির রাজনৈতিক তৎপরতায় সরকারের পাশাপাশি তাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে ছিল এক ধরনের হতাশা। আর তা কাটাতেই গণভবনে ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আকস্মিক বৈঠকে বলতে শোনা যায়, বিএনপিতে নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। ক্ষমতায় গেলে তাদের নেতা কে হবেন? প্রধানমন্ত্রী কে হবেন?

শরিকরা এখনও ধোঁয়াশায়

গণভবনে ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পরও যখন কোনো সাড়া শব্দ নেই, তখন শরিকরা অন্য কিছু আশঙ্কা করছে। শরিকদের কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন আওয়ামী লীগ এবার তাদের সাইডলাইন বসিয়ে অন্য খেলা খেলবেন। তাদের মতো এবার আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই ২০১৮ বা আগেরবারের মতো একটি নির্বাচন নির্বাচন করতে পারবে না। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন পদক্ষেপের পর সরকার এখন অনেক সতর্ক। সেক্ষেত্রে তারা মাঠের অন্যতম বিরোধীদল বিএনপিকে কাছে টেনে নেবে একটু অন্যভাবে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন ১৪দলের শরিকদের এ টার্মে সাইডলাইনে বসিয়ে রেখে অন্যদের কাছে টেনে নেবেন।

এমনকি তারা হেফাজতসহ আরো কয়েকটি ইসলামিক দলকে কাছে টেনে নেবে। আর এব্যাপারে ২৩ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ১৪ দল এখনো প্রাসঙ্গিক বা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ১৪ দলের সংগ্রাম এখনো পুরোপুরি সফলতা পায়নি-এমন কথা যতই বলা হোক না কেন, আওয়ামী লীগ তার শাসনামল পাকাপোক্ত করতে যা যা লাগে তাই করবে। এমনকি অনেকে মনে করেন, এবার আওয়ামী লীগ কৌশলে জামায়াতকেও ব্যবহার করতে পারে আর জামায়াতও সে সুযোগের অপেক্ষায়। যদি রাজনীতিতে একটু গেট ওয়ে পাওয়া যায় আর এসব কারণে ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে আওয়ামী লীগের এমন লুকোচুরি ও নীরবতা আর আকস্মিক বৈঠকের বাহাস।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে নির্বাচনে ১৪ দলের শরিক দলগুলোকে মাত্র ১৬টি আসনে ছাড় দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোটগতভাবে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে অংশ নেয় জোটের শরিকরা। নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে শরিকদের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে প্রতিনিধিত্ব নেই তাদের। বর্তমানে ন্যাপ, জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, গণতন্ত্রী পার্টি, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাসদ, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র এই জোটে আওয়ামী লীগের শরিক। আর বাংলাদেশ জাসদ (আম্বিয়া) সম্প্রতি জোট ছেড়েছে। 

জাপাও বিক্ষুব্ধ

এদিকে ১৪ দলের শরিক না হলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন সরকারের অন্যতম সহযোগী সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঈদের পর আন্দোলনে নামবে বলে জানিয়ে জাতীয় পার্টি (জাপা)। সম্প্রতি দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের উপস্থিতিতে এ ঘোষণা দিয়েছেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। এরপরই দলের নেতাদের উদ্দেশে জি এম কাদের বলেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য থেকে শুরু করে সবাইকে ফেসবুক ছেড়ে রাজপথে থাকতে হবে। জি এম কাদের বলেছেন, দেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তার দল রাজপথে থাকবে। ২৭ রোজার মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান।

শেষ কথা

নানান ধরনের মেরুকরণের কথা শোনা যাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। মাঠে সক্রিয় আছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক। জাতীয় পার্টিতে কোনো পদ-পদবি নেই বিদিশার। তবে তিনি জাতীয় পার্টিকে পুনর্গঠনের ডাক দিয়ে মাঠে নেমেছেন। মাঠে সক্রিয় আছে বেশ কয়েকটি ইসলামি দল ছাড়াও অর্থনীতিবিদ ও গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে নিয়ে গড়ে উঠা ‘গণঅধিকার পরিষদ’-এর নামে নতুন দল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপিসহ এতোসব দলের রাজনৈতিক আন্দোলন, দেশি-বিদেশি কূটকৌশল মোকাবিলা করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে এবারের যাত্রায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শরিকদের সাইডলাইনে বসিয়ে রাখা ছাড়া দলটির আর কোনো উপায় নেই আর একারণে আওয়ামী লীগকে নিয়ে শরিকরা ধোঁয়াশায় থাকলেও করার কিছু নেই।


শেয়ার করুন