০৯ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০১:০৬:০৩ পূর্বাহ্ন


মুসলিম শিশুকে ডুবিয়ে হত্যা চেষ্টা : এলিজাবেথে ৫ বছরের কারাদণ্ড
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-১০-২০২৫
মুসলিম শিশুকে ডুবিয়ে হত্যা চেষ্টা : এলিজাবেথে ৫ বছরের কারাদণ্ড ধর্মীয় বিদ্বেষে মুসলিম শিশুকে আহত ও হত্যাচেষ্টার দায়ে দোষী এলিজাবেথ উলফ


নর্থ টেক্সাসে মুসলিম শিশুকে ডুবিয়ে হত্যাচেষ্টা এবং আরেক শিশুকে আহত করার দায়ে ইউলেস শহরের বাসিন্দা এলিজাবেথ উলফ (৪৩) দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। টেক্সাসের ট্যারান্ট কাউন্টির ফৌজদারি জেলা আদালত নম্বর ৪-এর বিচারক অ্যান্ডি পোর্টার গত ১ অক্টোবর বুধবার এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে উলফকে হত্যাচেষ্টার জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং শিশু নির্যাতনের জন্য আরো দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে আদালত জানিয়েছে, এই দুই সাজা একসঙ্গে চলবে।

আদালতের নথি এবং পুলিশের অভিযোগপত্র অনুযায়ী, গত ২০২৪ সালের ১৯ মে বিকালে ইউলেস সিটির একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের সুইমিং পুল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সময়টা ছিল বিকাল ৫টা ৪৪ মিনিট। মিসেস এইচ নামে এক ফিলিস্তিনি মুসলিম মহিলা তার ৬ বছর বয়সী ছেলে ও ৩ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে পুলের ধারে বসেছিলেন। তখন হঠাৎই উলফ তাদের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ শুরু করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উলফ প্রথমে ওই মহিলার জাতীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তুমি আমেরিকান নও।

ঘটনার একপর্যায়ে উলফ প্রথমে ওই মহিলার ৬ বছর বয়সী ছেলেকে ধরে ফেলার চেষ্টা করেন। ছেলেটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তাকে ধাক্কা দেওয়ার ফলে শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এরপর উলফ সেই মহিলার তিন বছরের মেয়েকে তুলে নিয়ে গভীর পানিতে ডুবিয়ে রাখেন। কর্তৃপক্ষ জানায়, শিশুটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে পানির নিচে ঠেলে রাখা হয়েছিল, যা সরাসরি হত্যাচেষ্টার শামিল।

এ সময় পুলের আশপাশে থাকা কয়েকজন দ্রুত এগিয়ে আসেন। এক ব্যক্তি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছোট্ট মেয়েটিকে টেনে তুলে আনেন। শিশুটি শ্বাসকষ্টে ভুগলেও চিকিৎসকদের দ্রুত হস্তক্ষেপে প্রাণে বেঁচে যায়। পুলিশ ক্যাপ্টেন ব্রেন্ডা আলভারাডো বলেন, যদি উপস্থিত লোকজন দ্রুত ব্যবস্থা না নিতেন, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারতো।

সাক্ষীদের বরাতে পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থলে উলফ মুসলিম মহিলাকে লাথি মারেন, তার হিজাব টেনে খুলে ফেলেন এবং শারীরিকভাবে আঘাত করেন। পুলিশ যখন তাকে গ্রেফতার করতে আসে, তখন তিনি উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি তাকে হত্যা করব এবং তার পুরো পরিবারকে হত্যা করবো।’ এ বক্তব্য পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে আরও বাড়িয়ে দেয় এবং মামলায় ঘৃণাভিত্তিক অপরাধের অভিযোগকে শক্তিশালী করে।

ঘটনার পরপরই ইউলেস পুলিশে ৯১১ কল যায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে প্রথমে উলফকে জনসমক্ষে মাতাল অবস্থায় থাকার অভিযোগে আটক করে। পরে তদন্তে তার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও শিশু নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ আনা হয়। শুরুতে তিনি অল্প সময়ের জন্য জামিনে ছাড়া পেলেও পরে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ট্যারান্ট কাউন্টি গ্র‍্যান্ড জুরি উলফের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করে। অভিযোগে ঘৃণাভিত্তিক অপরাধ (হেট ক্রাইম) যুক্ত করা হয় এবং অতিরিক্ত শাস্তির সুপারিশ করা হয়। প্রসিকিউটররা মামলাটিকে ‘ক্যাপিটল মার্ডার’ অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য হত্যাচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। তবে আদালতে উলফ নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেন এবং জুরি ট্রায়ালের পরিবর্তে বিচারকের রায় মেনে নেন।

বিচারক অ্যান্ডি পোর্টার রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বলেন, এটি ছিল এক ভয়ংকর ঘটনা। শিশুদের লক্ষ করে এভাবে ঘৃণাভিত্তিক আক্রমণ আমাদের সমাজে অগ্রহণযোগ্য। উলফকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলেও, শিশু নির্যাতনের জন্য দেওয়া দুই বছরের সাজা একইসঙ্গে কার্যকর হবে। আদালত আরও উল্লেখ করে, উলফ ইতিমধ্যেই যে সময় জেলে কাটিয়েছেন, তা তার সাজার অংশ হিসেবে গণনা করা হবে।

এ ঘটনার পর উত্তর টেক্সাসে স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটিতে তীব্র ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম নাগরিক অধিকার সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস এক বিবৃতিতে জানায়, এটি কেবল শিশুদের ওপর হামলা নয়, এটি ছিল স্পষ্ট ইসলামবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী আক্রমণ। সংগঠনটি আদালতের রায়কে স্বাগত জানালেও একই সঙ্গে দাবি জানিয়েছে যে, ঘৃণাভিত্তিক অপরাধে আরো কঠোর শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।

এ মামলার মাধ্যমে আবারও সামনে এসেছে মার্কিন সমাজে বিদ্যমান ইসলামবিদ্বেষ ও অভিবাসীবিরোধী মনোভাব। বিশেষ করে মুসলিম পরিবারগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। স্থানীয় কমিউনিটি নেতা এবং মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম ও অভিবাসী পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের ঘটনায় শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার নয়, পুরো সমাজের নিরাপত্তা ও বিশ্বাস নষ্ট হচ্ছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এলিজাবেথ উলফের মামলাটি ভবিষ্যতে ইসলামবিদ্বেষমূলক অপরাধের বিচারে একটি নজির হিসেবে কাজ করবে। যদিও পাঁচ বছরের সাজা তুলনামূলকভাবে কম বলে অনেকেই মনে করছেন, তবে আদালতে অপরাধ স্বীকার করায় রায় হালকা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, ঘৃণাভিত্তিক অপরাধ প্রতিরোধে শুধু আইন কঠোর করলেই হবে না, বরং সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।

নর্থ টেক্সাসের ইউলেস সিটির এ ঘটনায় তিন বছর বয়সী এক শিশু অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও এটি মার্কিন সমাজে এক অন্ধকার বাস্তবতার প্রতিফলন। এলিজাবেথ উলফের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড মুসলিম কমিউনিটিকে সাময়িক স্বস্তি দিলেও ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। কমিউনিটি নেতারা জোর দিচ্ছেন, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, আদালত এবং সাধারণ নাগরিক তাই সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

শেয়ার করুন