অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছয় মাসের কার্যকালে জনজীবনের মৌলিক সমস্যাগুলোর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কন্ট্রোল করা যায়নি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি, মুদ্রাস্ফীতি আগের মতোই আছে, সব পর্যায়ে ঘুষ-দুর্নীতি কিছুটা কমলেও একেবারে বন্ধ হয়েছে বলা যাবে না, চাঁদাবাজির ধরন এবং প্রকৃতি পাল্টে গেলেও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য কমেনি।
সরকারের কাছে জনগণের চাহিদা ছিল দ্রুত কিছু মৌলিক সংস্কার এনে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনে কিছুটা স্বস্তি আনা। কিন্তু বলার মতো এখনো কিছু হলো না। আইএমএফের শর্ত মেনে ভ্যাট, করের বোঝা বাড়ানো হলো। এমনিতেই আমদানি-রফতানি কমে গেছে, প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে, বিনিয়োগ মারাত্মক হারে নিম্নমুখী, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হয়ে বেকারত্ব বাড়ছে। জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার গ্রীষ্মকালে মারাত্মক লোডশেডিং হতে পারে। সরকার শিল্পগ্রাহকদের মানসম্পন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না, অথচ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে। এতো শত সমস্যা সংকটের মধ্যে সরকার জনগণকে সংস্কারের বাণী বিতরণ করছে। সরকার ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী বলে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ বিচারের আগেই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু নির্বাচন নিয়ে দ্বিধাবিভক্তিতে পড়েছে। তবে দেশ-বিদেশে বিদগ্ধ জনগণ বুঝতে পারছে অনির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের সমস্যাসহ এবং সংকট কখনো সমাধান করতে পারবে না। এ সরকারঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ১৯৭২ সংবিধান নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর কথা বলে জাতিকে বিভক্ত করেছে। এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে কখনো জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ সবাই চাইছে অবিলম্বে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন। অথচ সরকারের ভূমিকা থেকে নির্বাচনের সঠিক সময় বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকার এখন পর্যন্ত জুলাই-আগস্ট ২০২৪ আন্দোলনের সময়ে নিহত-আহতদের তথ্যনির্ভর সঠিক তালিকা প্রণয়ন করতে পারেনি। আন্দোলনের সময় ছাত্র, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। সে কথা কিন্তু আলোচিত হচ্ছে না। সামাজিকমাধ্যমে নানাভাবে আসছে স্নাইপারদের গুলিতে অনেকের মৃত্যু হয়েছে, অনেক মৃত্যু ঘটেছে সন্ত্রাসীদের বুলেটে। সঠিক নিরপেক্ষ বিচার করতে হলে আগে আন্তর্জাতিক মানের বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু একটি বিশেষ দলের কৌঁসুলিকে চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে পদায়ন করে প্রথমেই বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের একজন উপদেষ্টা থাকলেও প্রতিদিন নানাজন বিচার নিয়ে নানা কথা বলছে। প্রকৃত অপরাধীদের সঠিক বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক, সেটি সবার দাবি। সরকার এযাবৎ বিগত সময়ে সাড়া সাজানো কিছু হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করতে খুব কার্যকর কিছু করতে পারেনি। মার্চ-এপ্রিলের পর থেকে সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ তীব্রতর হবে। সবকিছু এলোমেলো রেখে সরকারকে তখন দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। সরকার বিএনপি, জামায়াত ছাড়া অন্য যেসব প্রান্তিক জনবিচ্ছিন্ন দলগুলোর সঙ্গে কথা বলাকে সংলাপ বলার চেষ্টা করছে তারা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
বাংলাদেশে দুই ধারার রাজনীতি আছে-একপক্ষ স্বাধীনতার আদর্শে অনুপ্রাণিত, অন্যপক্ষ স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী। নির্বাচন হলেই দুই পক্ষ পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেবে। অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে নির্মোহ অবস্থান না নিলে বিপদে পড়বে। ২০২৫ সালের জনগণ অনেক সচেতন। ছেলে ভোলানো গালগল্পে কিন্তু সবাইকে ভোলানো যাবে না। সাধারণ মানুষ নিরাপদে ভোট প্রদানের সুযোগ পেলে সঠিক নেতৃত্ব বেঁচে নেবে। জনগণ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির শাসন, কুশাসন, অপশাসন, দুঃশাষণ সবই দেখেছে। জামায়াতের অপকর্ম বিষয়েও ধারণা আছে। কিছু অর্বাচীন মানুষের অতিকথনে জাতি বিভ্রান্ত হবে সেই অবস্থা এখন আর নেই।
সরকার সুবিবেচক হলে নির্মোহভাবে সব রাজনৈতিক দল এবং পক্ষকে সম্পৃক্ত করে সম্মত সংস্কারের একটি পথনকশা তৈরি করতে পারে আগামী ৬ মাসের মধ্যে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন দ্রুত নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পাদন করে নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০২৫ নির্বাচন করে সঠিক হবে। ইতিমধ্যেই অনেক সরকার বলে দিয়েছে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী তারা। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো দল বা ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ করতে পারে না। সংবিধানসহ দেশের কোনো মৌলিক অবকাঠামো পরিবর্তন করতে পারে না।
সরকারে কয়েকজন সম্মানিত বিদগ্ধজন আছেন। আশা করি, প্রধান উপদেষ্টাসহ তাদের বোধোদয় হবে বা হয়েছে। বাংলাদেশ দীর্ঘসময় পরিচালনার মোট দক্ষতা এবং যোগ্যতা তাদের সীমিত। সীমিত সময়ের ড্যামেজ কন্ট্রোল হয়েছে এখন শুরু হোক নির্বাচিত সরকার গঠন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের কার্যক্রম। সরকার যেন নিরপেক্ষতা না হারায়।