২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ৬:২৩:২৫ অপরাহ্ন


মহাসমাবেশের আড়ালে বৃহত্তর গণআন্দোলনের মহড়া
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-১০-২০২২
মহাসমাবেশের আড়ালে বৃহত্তর গণআন্দোলনের মহড়া খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ


বিএনপি’র গণসমাবেশের কর্মসূচির পেছনে রয়েছে বৃহত্তর গণআন্দোলনে আগাম মহড়া। এসব সমাবেশ করে দলটি একটি দিকে তৃণমূলকে করছে শক্তিশালি। অন্যদিকে সব ভেদাভেদ ভুলে দলকে নিয়ে একটি সত্যিকারের সফল গণআন্দোলন গড়ে তুলতে চায় দলটি। আর এজন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিচ্ছে সে লক্ষ্যেই পৌঁছাতে করে যাচ্ছে দলটি একের পর এক সমাবেশ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। 

বিএনপি ৯টি বিভাগে গণসমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে সরকার অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হলেও দলটি মূলত এখনো সাংগঠনির দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করছে। জানা গেছে, বিএনপি’র নীতিনির্ধারকরা দলের দীর্ঘ দিনের নানানবিধ সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্য করেছে। একদিকে দলের কোন্দাল, নতুন নতুন কমিটি না থাকা, এরপরে বিভিন্ন ধরনের সরকারি হুমকি ধামকিতে বিএনপি মুখ থুপড়ে পড়ে ছিলো। সে অবস্থা থেকে বিএনপি এখন সামনের দিকে এগুচ্ছে সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে। 

সরকার বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশের দশটি সাংগঠনিক বিভাগে গণসমাবেশ শুরু করেছে বিএনপি, যার তিনটি ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। জানা গেছে রাজপথে নামার আগে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ঝালাই করে নিচ্ছে দলটি। এরই অংশ হিসাবে প্রথম গণসমাবেশ হয় চট্টগ্রামে। এরপর করেছে ময়মনসিংহে। এরপর হয়েছে ২২ অক্টোবর খুলনায়।  ২৯ অক্টোবর রংপুরে ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী ও ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়। এসব গণসমাবেশ শেষ করে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় হবে মহাসমাবেশ। 

কেমন হলো তিনটি বিভাগীয় সমাবেশ

গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিএনপি ৯টি বিভাগে গণসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এসব সমাবেশ নিয়ে সরকারের তেমন মাথা ব্যাথা ছিল না। কিন্তু সরকার বিএনপি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য টের পেয়ে এসসব সমাবেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এখনো তা চলমান আছে। চট্টগামে বিএনপি’র সমাবেশে বড়ো ধরনের বাধা পায়নি বিএনপি। আবার একেবারে বাধাহীন ভাবে হয়েছে তা-ও বলা যায় না বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন। তবে চট্টগ্রামের পরে ময়মনসিংহের সমাবেশে নড়ে চড়ে বসে সরকার। মাঠে নানান ধরনের বাধা সৃষ্টিতে নামিয়ে দেয়া হয় দলের নেতাকর্মীদের। ময়মনসিংহে গণসমাবেশে লোক সমাবেশের উপস্থিতি কমাতে  বিএনপির সমাবেশের আগে বিভিন্ন সড়কে বাস বন্ধ করে দেয়া হয়। সমাবেশের আগে অভ্যন্তরীণ রুটসহ ময়মনসিংহ থেকে আন্তঃজেলা রুটে বাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। সরজমিনে দেখা দেখা গেছে নগরের পাটগুদাম আন্তজেলা বাস টার্মিনালেও কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও নেত্রকোনাগামী কোনো বাস ছাড়তে দেখা যায়নি। 

অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের পর এবার বিএনপির গণসমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে আরেক ধাপ কৌশল নেয়া হয় খুলনায়। চট্টগ্রামে প্রথম সমাবেশে যেতে বিক্ষিপ্ত হামলা ও বাধা দেওয়া হয়েছিল। এরপর ময়মনসিংহে হামলা ও বাধার সঙ্গে এক ধাপ এগিয়ে সড়কপথে সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল পূর্বঘোষণা ছাড়াই। কিন্তু খুলনায় সমাবেশের দুই দিন আগেই বাস চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। খুলনায় ছিল ২২ অক্টোবরে গণসমাবেশ। এক্ষেত্রে খুলনায় বাস চলাচল বন্ধের অভিনব কৌশল বলা চলে সরকারকে সহায়তা করেছে খুলনা জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতি। সংগঠনটি গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘সড়ক ও মহাসড়কে অবৈধভাবে নছিমন, করিমন, মাহেন্দ্র, ইজিবাইক ও বিআরটিসির গাড়ি চলাচল করছে। আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে প্রশাসন যদি সড়কে ওই অবৈধ যান চলাচল ও কাউন্টার বন্ধ না করে, তাহলে পরবর্তী দুই দিন ২১ ও ২২ অক্টোবর মালিক সমিতির সব রুটের গাড়ি বন্ধ থাকবে।  তবে এতো কিছুর পরও বিচ্ছিন্ন খুলনা পরিণত মিছিলের শহরে, বাধাবিঘœ উপেক্ষা করে বিপুল জনসমাগম বিএনপির সমাবেশে। ধর্মঘট সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে জনসভায়। জানা গেছে সমাবেশ ছিল শনিবার কিন্তু শুক্রবার রাত থেকেই বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী খুলনা শহরে ঢুকে পড়ে। বিভাগের আসপাশের দশটি জেলা থেকে দুতিনদিন আগে থেকেই শহরের দৌলতপুর ও খালিশপুরসহ অন্যান্য এলাকায় এসে জড়ো হয়ে ছিলো তারা। 

সমাবেশের ইতিবাচক দিক...

এদিকে সমাবেশগুলি ঘিরে বেশ কয়েকটি বিষয় গণমাধ্যমের দৃষ্টি কেড়েছে। সমাবেশকে ঘিরে ছোট ছোট দুটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও বলা যায় শান্তিপূর্ণই হয়েছে। আবার অন্যদিক আইন শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও খুব একটা বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটেনি। তবে চট্টগ্রাম ময়মনসিংহ এমনকি খুলনায় বিভিন্ন পয়েন্টে উপস্থিত পুলিশের সদস্যদেরকে শুধুমাত্র সমাবেশে আগতদের কাছে লাঠি থাকলে তা নিয়ে নিতে দেখা গেছে। 

দেয়া হচ্ছে একের পর এক মামলা

তবে আইন শৃংখলায় নিয়োজিতদের তেমন বাড়াবাড়ি লক্ষ্য না করা গেলেও মামলার ব্যাপারে তৎপরতা ছিল সরকারের। একদিকে এসব সমাবেশে যেমন নানান ধরনের প্রতিবন্ধিকতা সৃষ্টি করা হয়েছে তেমনি কর্মসূচি শেষে বিভিন্ন ধরনের ঘটনায় বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়া হয়। ময়মনসিংহে বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে দলটির কর্মীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে খুলনায় ২ মামলায় আসামী ৪২৯। বিএনপির ওই বিভাগীয় গণ সমাবেশকে কেন্দ্র করে মারধর, হামলা ও ভাংচুরের অভিযোগে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। এতে মোট আসামী করা হয়েছে ৪২৯ জনকে। সমাবেশের দিন যশোর থেকে আসা নেতাকর্মীরা খুলনা রেল স্টেশনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের জড়ানোর অভিযোগে  খুলনা রেল স্টেশন মাস্টার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন।  এই মামলায় ১৫০ থেকে ১৭০ জনকে অজ্ঞাত আসামী করা হয়েছে।  অন্যদিকে খুলনা শহরের দৌলতপুর থানাধীন নতুন রাস্তা মোড় এলাকার ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে ২৫৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ জনের নাম এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন খুলনার নেতারা।

সামনে রংপুর...নতুন কৌশলের সন্ধানে সরকার

বিএনপি ৯টি বিভাগে গণসমাবেশের কর্মসূচির অংশ হিসাবে রংপুরের গণসমাবেশ হবে ২৯ অক্টোবর। ২৯ অক্টোবর রংপুর মহানগরের গণসমাবেশের বিষয়ে এরিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিএনপি অনুমতি পায়নি। রংপুর জিলা স্কুল মাঠে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে বিএনপি গত সপ্তাহে পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন করেছে বলে জানান গেছে, তবে অনুমতি পায়নি তারা। তাই রংপুর বিএনপি নেতারা এখন ভাবছে তিন বিভাগীয় সমাবেশের পর রংপুরে আওয়ামী লীগ ও সরকারের কৌশল কী হবে। আর সমাবেশের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই নেতাকর্মীরা এটাকে প্রেস্টিজ ইস্যু মনে করে এগুচ্ছে। কিন্তু সরকার যেভাবে সমাবেশের পর পর বিভিন্ন ধরনের এ্যাকশন নিচ্ছে তাতে পরবর্তী সমাবেশগুলো সফল করা নিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর স্নায়ু চাপ বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে রংপুরে সমাবেশের আগে বা পরেও মামলা যেমন দেয়া হবে তেমনি পরে আরো হয়রানি করা হবে। তবে বিএনপি’র একজন শীর্ষ নেতা এই প্রতিবেদকে বলেছেন, বাধা উপেক্ষা করেই বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগম বেশি হচ্ছে। আর এতেই আওয়ামী লীগ আতঙ্কিত হচ্ছে। তিনি বলেন, খুলনার সমাবেশ ব্যর্থ করে তোলার সরকারি কর্মকান্ড বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে। কেননা আগের কর্মসূচিতে দেখা গেছে সরকারের  নানামুখী বাধা ও তৎপরতার কারণে বিএনপির মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকেরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উৎসাহী ও মরিয়া হয়ে সমাবেশে গেছেন। কেননা বিএনপি’র নেতাকমীরা এখন মনে করে সমাবেশে উপস্থিতি হওয়া ও একে সফল করে তোলাও তাদের একধরনের বিজয়। জিলা স্কুল মাঠে নয়, রংপুরে বিএনপি সমাবেশ করবে কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে হতে পারে।

শেষ কথা

প্রথমে সরকার এসব সমাবেশের দিকে তেমন নজর দেয়নি। ভেবেছিল সাদা মাটা ভাবে লোক দেখানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দলটি তাদের দৃষ্টি তুলে ধরতেই এমন কর্মসূচি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে যাচাই বাচাই শেষে তারা বুঝেছে বিএনপি একটি বড়ো ধরনের আন্দোলনে প্রস্তুতির অংশ হিসাবে মাঠে এমন তৎপরতা বাড়াচ্ছে। একদফার প্রস্তুতি নিতে সাংগঠনিক কর্মসূচি এটি। আর এজন্য সরকার ভেতরে ভেতরে মরিয়া হয়ে উঠলেও এখন তা প্রকাশ্যে রূপ নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যেই অনেকটা স্পষ্ট, বিএনপির বাকি বিভাগীয় সমাবেশ ও অন্য কর্মসূচি ’সহজ’ হবে না। 

শেয়ার করুন