২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৫:৩৬ অপরাহ্ন


মার্কিন রাষ্ট্রদূত বস্টারের টেলিগ্রাম
খালেদ মোশাররফের দাবি ছিল মোশতাককেই প্রেসিডেন্ট রাখার
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-১১-২০২২
খালেদ মোশাররফের দাবি ছিল মোশতাককেই প্রেসিডেন্ট রাখার খোন্দকার মোশতাক


১০ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে পূর্ব সপ্তাহে বাংলাদেশে সংঘটিত তথাকথিত সেনা ষড়যন্ত্রের বিদ্রোহ দমানোর পর তদানীন্তন ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজীন বস্টার (অতঃপর মি. বস্টার) যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরার বর্ণনা দিয়ে এক বার্তা পাঠান। মি. বস্টার ১৯৭৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলেন। তার সময়কালে সংঘটিত ৭ নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহী জনতার বিপ্লব বা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বন্দিত্ব ঘোচানো বা বিদ্রোহী সেনা অফিসারদের সাধারণ সেনাদের হাতে বধ, যাই বলা হোক না কেন সবকিছুকে প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানে অবস্থান করে।

৭ নভেম্বর নিয়ে যেসব ঘটনাবলি বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে, তার মধ্যে জেলহত্যা ও চিফ অব দ্য আর্মি জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের হত্যাকা- ও প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাকের ক্ষমতাচ্যুতি বিশেষভাবে চোখে পড়ে। মি. বস্টারের বর্ণনা প্রায় ৯৫ শতাংশই ৭ নভেম্বর নিয়ে বিভিন্ন অংশগ্রহণকারীর বর্ণনার সাথে মিলে যায়। যেমন ৩রা নভেম্বর সোমবার সকাল থেকে খালেদ মোশাররফ এবং তার সঙ্গী-সাথীরা দ্রত সেনানিবাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ঢাকা নগরীর সর্বত্র আওয়ামী লীগ মিছিল করে, (খালেদ মোশাররফের ভাই রাশেদ মোশাররফ সে মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তার মা-ও উপস্থিত ছিলেন সেখানে, কথাটা মি. বস্টারের বর্ণনায় নেই) মনে হয় ঢাকার মোশাররফের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে, মোশতাকের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব হয়, শক্তি প্রদর্শনের জন্য ঢাকার সশস্ত্র সেনা হেলিকপ্টার ও মিগ ফাইটার ওড়ানো হয়। এসব বর্ণনা দেখা যায়। বিভিন্ন লেখায় দাবি কি ছিল মোশতাকের কাছে সেসব দাবির উদ্দেশ্য কি ছিল, পরিষ্কার নয়। কারণ সব লেখকের বইতে ধরেই নেয়া হয়েছে খোন্দকার মোশতাক তার আশপাশের মেজরদের সরিয়ে মোশাররফকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। শুধু তাই নয় খোন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানকেও বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে কোনো প্রয়াস নিয়েছেন বলেও উল্লেখ নেই। কিন্তু মি. বস্টারের বার্তায় খালেদ মোশাররফের চারটি দাবির কথা উল্লিখিত হয়। 

1. That Mosharraf replace major General Ziaur Rahman his personal rival, as chief of staff;

2. That the Majors be returned to regular army discipline

3. That the tank forces loyal to the government be disarmed; and 

4. That Mostaq remain in office.

অর্থাৎ, 

১. মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, যার সাথে মোশাররফের ব্যক্তিগত বিরোধিতা ছিল, তাকে সরিয়ে নিজেকেই প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ;

২. মেজররা যারা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তাদের আবার নিয়মিত সেনা শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে নেয়া;

৩. যেসব ট্যাঙ্ক ফোর্স সরকারের প্রতি অনুগত তাদের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেয়া এবং 

৪. মোশতাককে তার পদে (অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট পদে) বহাল রাখা।’

এই চারটি দাবি খালেদ মোশাররফ যখন উত্থাপন করেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের কথা চিন্তা করে করেননি বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকা-ের বিচারের জন্যও করেননি, বরং খোন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট পদে রেখে দেয়ার দাবি তুলে মুজিবের হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক নেতাকে বাঁচিয়ে দেয়ার মতলব করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি কারণে খালেদ মোশাররফের নামে গলদঘর্ম হয় তা বোঝা যায় না। তবে খালেদ মোশাররফ একজন মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক যে ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। খালেদ মোশাররফের উত্থান ও পতন উভয়ই কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর। জিয়াউর রহমানের বিচারের কোনো দাবি মোশাররফ করেননি। মোশাররফের দাবি ও হত্যাকা- যখন ঘটছে, তখন জিয়াউর রহমান ছিলেন বন্দি। বস্তুত বলতে গেলে মোশতাকের কারাগারে। কাজেই মোশতাককে জিয়া কখনো সহ্য করেননি। জিয়ার আমলে মাঠে সাপ ছেড়ে দিয়ে বোমাবাজি করে মোশতাকের মিটিং পণ্ড করা হয়েছিল। মোশতাককে আর রাজনীতিতে আসতে না দিয়ে জিয়া তাকে বস্তুত রাজনীতি থেকে অপসৃত করেছিলেন। 

খোন্দকার মোশতাকের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নিলে তা জিয়ার আমলেই নেয়া হয়েছিল। তারপর খোন্দকার মোশতাকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাও মোশতাকের কোনো বিচার করতে পারেননি। রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধু মুজিব হত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তি অর্থাৎ জিয়ার আমলে খোন্দকার মোশতাকের ওপর হয়রানি হয়েছে। সেই ব্যক্তিকেই আজ আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী দোষারোপ করে থাকেন। 

৭ নভেম্বরের আরো ব্যাপক বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। দরকার মুজিব ও জিয়া হত্যার রাজনৈতিক বিচার। কিন্তু যেখানে আজ মানুষকে বোবা বানিয়ে গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে, সেখানে কি তার মূল্যায়ন আছে। 

শেয়ার করুন