২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৪:৫৫:৫৪ অপরাহ্ন


রাশিয়ার জাহাজে মার্কিনিদের জয়
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০১-২০২৩
রাশিয়ার জাহাজে মার্কিনিদের জয় ‘উরসা মেজর’ নামের রাশিয়ার পতাকাবাহী এই জাহাজটি রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের পণ্য নিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল।


বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক ঘটনা এখন সবার মুখে মুখে। বিশ্বের দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়া বাংলাদেশের এক ইস্যুতে পরস্পরের মুখোমুখি হলে একটা বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয় বাংলাদেশের জন্য। শেষ পর্যন্ত ওই লড়াইয়ে জিতলো কে? এ বিশ্লেষণই সর্বত্র! অবশ্য দু’দেশের ওই ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশের বিরক্তিটা প্রকাশও করেছেন। ভেতরেই যা-ই থাকুক, প্রকাশ্যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে বাগযুদ্ধ বা অন্য কোনো ইস্যুতে সমালোচনা করুক এটা বাংলাদেশের কাম্য না। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তেজগাঁওয়ের শাহীনবাগে একজন নিখোঁজ ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের খবরাখবর নেয়ার পর থেকে যে ঘটনার অবতারণা হয়, সেটা নিয়ে মার্কিনিদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাদের উদ্বেগের কথা জানান দেয় বাংলাদেশকে। কারণ বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক’জন মন্ত্রী ও কতিপয় সুশীলসমাজ পিটার হাসের নিখোঁজ ব্যক্তির বাড়িতে যেয়ে খোঁজ নেয়াটাকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর শামিল মনে করছিলেন। 

যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিক জানিয়ে দেয়, সারাবিশ্বেই তারা মানবাধিকার সংরক্ষণ ও মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সেখানে তারা সোচ্চার ভূমিকা রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শাহীনবাগের ঘটনা তেমনই একটা বিষয় ধরে নিয়ে তাদের রাষ্ট্রদূতের সেখানে যেয়ে খোঁজ নেয়াটা যৌক্তিক ও মার্কিন নীতির বহিঃপ্রকাশ জানিয়েছেন। কিন্তু বিপত্তি নিখোঁজ ব্যক্তি বাংলাদেশের সরকারের প্রতিপক্ষ একদলের হওয়ায় বিষয়টা প্রতিবাদকারী কেউ কেউ বিরোধীদলের কিছু অন্যায় দাবি ও যুক্তি (বিএনপি ও অন্য দলের কথিত প্রায় শ’খানেক গুম খুন নিখোঁজ লোকদের খোঁজ দেয়ার দাবি করা সংগঠন মায়ের ডাক) সঙ্গে সঙ্গতি প্রকাশ মনে করেন। এটাই সমস্যার মূলে। 

তবে এ প্রসঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসে নিযুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিরাপত্তা দাবি করে মার্কিন প্রশাসন থেকে ফোন করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন ও বিবৃতি দেয়। মূলত ওই বিবৃতিদানের পরই হঠাৎ করে ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস এক বিবৃতি দিয়ে সরাসরি আমেরিকার নাম উচ্চারণ না করলেও সেখানে যা বলা হয়, সেটা বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ যে রাশিয়া করে না, সেটা প্রচার করে। সাথে সাথেই ওই প্রসঙ্গ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা বিবৃতি দেয়। এরপরই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের ইস্যুতে অন্য কোনো দেশের নাক গলানোটা যে বিরক্তিকর সেটা প্রকাশ করে।

ঘটনা এর পরের 

ইউক্রেন সংকট শুরুর পর রাশিয়ার ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা এমন একটি জাহাজে করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম বাংলাদেশের সীমানায় নিয়ে আসে রাশিয়া। এ জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে তৈরি হয় জটিলতা। ‘উরসা মেজর’ নামের রাশিয়ার পতাকাবাহী একটি জাহাজে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য নিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। তবে তার আগেই ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জানায় যে, ওই জাহাজটি আসলে ‘উরসা মেজর’ নয়। এটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ‘স্পার্টা ৩’ জাহাজ। রঙ ও নাম বদল করে তাদের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজটি রূপপুরের পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে আসছে। জাহাজটির আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থার (আইএমও) সনদ নম্বর ৯৫৩৮৮৯২, যা প্রকৃতপক্ষে ‘স্পার্টা ৩’ এর সনদ নম্বর। 

বিষয়টি যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে নিষেধ করে দেয় বাংলাদেশ। জাহাজটি মোংলা বন্দরের বহির্নোঙরে ছিল। এ ঘটনায় জাহাজটিকে বন্দরে পণ্য খালাসের অনুমতি দিতে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাশিয়া। তবে তাতে রাজি হয়নি পররাষ্ট্র এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। পরে বিষয়টি নিয়ে ২২ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলমের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকার রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি। রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়, নিষেধাজ্ঞায় থাকা জাহাজ বাংলাদেশ বন্দরে ভিড়তে দেবে না।

পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ রূপপুরের পণ্য খালাসের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সকল সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রকল্প এলাকায় পণ্য পরিবহনের দায়িত্ব স্থানীয় এজেন্টের। তারা কীভাবে পণ্য নিয়ে আসবে এটি তাদের বিষয়। ফলে এ সুনির্দিষ্ট জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের জন্য অন্য ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞায় থাকা জাহাজ ভিড়তে দিয়ে ঝুঁকি নেবে না ঢাকা। আর নিষেধাজ্ঞা যেহেতু রাশিয়ার ওপর, ফলে বিষয়টি তাদের সমাধান করতে হবে।

এরপর সচিবালয়ে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি মেগা প্রকল্প। আমরা সেটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার আওতায় জাহাজটি আছে- বিষয়টি জানা ছিল না। এখন যেহেতু নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানা হয়েছে, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

পরে জানা গেছে জাহাজটি পরবর্তীতে ভারতের উদ্দেশে বাংলাদেশের জলসীমা ত্যাগ করে। স্থানীয় এজেন্ট ভারত থেকে পণ্য খালাস করে অন্য জাহাজে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকাস্থ রাশিয়া দূতাবাস জানায়, এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র অথবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। 

বিষয়টি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ উভয় সংকটে পড়েছে। মার্কিন পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের নিষেধাজ্ঞায় থাকা কোনো জাহাজকে তৃতীয় দেশ সুযোগ-সুবিধা দিলে সেই দেশও নিষেধাজ্ঞা ঝুঁকিতে পড়বে। আবার রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জাহাজটি খালাস না করলে তা দু’দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যেহেতু এটির দায়িত্ব স্থানীয় এজেন্টের, তাই জাহাজটি ভিড়তে দেয়া হয়নি।

পণ্য ভারতে খালাস হতে পারলে বাংলাদেশে কেন খালাস করা গেল না- এমন প্রশ্নে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে কয়েকজন বলেছেন, মার্কিন ও রুশ স্নায়ুযুদ্ধের যে চাপ বিশ্বের ওপর রয়েছে, তাতে ভারতের সক্ষমতা রয়েছে সেই চাপ সামাল দেয়ার। ফলে তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জাহাজটিকে বন্দরের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে দিতে পারে। তবে সেই সক্ষমতা এখনো বাংলাদেশের তৈরি হয়নি। তবে সেটা যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের নীতি প্রসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঠান্ডা একটা লড়াই চলছিল বলে দেখা গেছে। যদিও ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিন ও জাতিসংঘের নীতির সঙ্গেই ছিল বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির ইস্যুতে অনেক মন্ত্রীই তারা সরাসরি মার্কিনিদের বিভিন্ন নীতির কঠোর সমালোচনা করে গেছেন। এতে করে ধারণা করা হয়েছিল, সরকার মার্কিন বিষয়ে কিছুটা ক্ষুব্ধ রয়েছে। ফলে রাশিয়ার ওই ঘটনায় বাংলাদেশ কোন পথে যায়, সেটা দেখার বিষয় ছিল। 

কিন্তু অন্তত রাশিয়া ইস্যুতে মার্কিনিদের দেয়া তথ্য ও তাদের নির্দেশনাই শেষ পর্যন্ত ফলো করাতে সরকারের নীতিতে যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ ইস্যুতে রাশিয়া যে পিছিয়ে পড়েছে সেটারই প্রমাণ মিলেছে, যা এক ধরনের দুই পরাশক্তির মধ্যে বাংলাদেশ ইস্যুতে লড়াইয়ে মার্কিনিদের জয়জয়কারই মনে করছেন অনেকে! বিশেষ করে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন ও  পশ্চিমা দেশসমূহের (উন্নয়ন সহযোগী দেশসমূহের) যে তৎপরতা যেমনটা সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রচেষ্টা তারা করে আসছেন ২০১৪ ও ২০১৮ সনের জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপট সামনে রেখে তাতে দেশের একটি পক্ষ মার্কিনসহ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশসমূহের প্রচেষ্টা ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে ভালো নজরে দেখছিল না। সে প্রেক্ষাপটে সরকার যখন মার্কিনিদের পরামর্শটাই মেনেছে রাশিয়া ও ওই পক্ষের এক দাবি উপেক্ষা করে, তখন চলমান ইস্যুর অনেকেই অনেক রকম যৌক্তিক, অযৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছেন। কেউ বলছেন বাংলাদেশে মার্কিন ও তাদের মিত্রদের প্রভাবটাই এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হলো বৈকি!   

শেয়ার করুন