২৩ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ১০:৩৩:৫১ অপরাহ্ন


বাংলাদেশের ‘ইমেজ’
মাহমুদ রেজা চৌধুরী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৪-২০২২
বাংলাদেশের ‘ইমেজ’


দু’দিন আগে (২৭ মার্চ)  বাংলাদেশের ‘চ্যানেল আই’-এর ‘তৃতীয় মাত্রা’র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে আরো দু’জন অতিথি ছিলেন। লন্ডনপ্রবাসী- ব্যবসায়ী এনাম আলী আর ছিলেন অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রবাসী সাংবাদিক এবং শিক অজয় দাশগুপ্ত। আলোচনার বিষয় প্রবাসীদের চোখে এই তিন মহাদেশ- অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার মানুষদের চোখে বাংলাদেশের ‘ইমেজ’ এখন কেমন। আমরা যে যেই দেশের অভিবাসী বা নাগরিক, সেসব দেশের দৃষ্টিকোণে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি উপস্থাপক জিল্লুর রহমানের জিজ্ঞাসায়। শ্রোতা এবং দর্শক এটা কে, কীভাবে দেখেছেন সেটা অবশ্য জানি না।

আমাদের আলোচনায় একটা বিষয় ছিল সেটা কেবল রাজনীতির বাইরে প্রবাসী বাংলাদেশি যে যেখানেই আছেন, মোটামুটি ভালো আছেন। অনেকটা সফল জীবনের কর্মেেত্র এবং বিভিন্ন পেশাতেও। যেটুকু মন্দ হয় বা দেখা যায়, সেটা মূলত রাজনীতির কারণেই। আমাদের আলোচনায় এনাম আলী বলেছেন, প্রবাসে বা বিদেশে বসে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে চর্চা করা অথবা সেটা নিয়ে কোন্দল বাঁধানোটা একেবারেই অর্থহীন। অজয় দাশগুপ্ত বলেন, আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রে ‘না’ বলবার পরিবেশ এবং অধিকার সীমিত। যেটা সবসময়ই সবচেয়ে বেশি জরুরি। সত্যি বলেছেন অজয় দাশগুপ্ত। কখনো কোথাও না যদি বলিও, সেটা খুব জোরেশোরে বলি না। বলতে পারিও না। এই না পারার অনেক কারণ আছে। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আমরা ‘না’ বলি কম অথবা বলতে সুযোগ পাই কম। প্রথমত. নিজের স্বার্থের কারণে। দ্বিতীয়ত. চলমান স্রোতে ভেসে যাওয়া, এটা আমাদের এখন অভ্যাস হয়েই আছে। তৃতীয়ত. ‘না’ শব্দের বিপরীতে যা বা যাদের ব্যাপারে ‘হ্যাঁ’ বলবো অথবা বলতে পারি, সেই জায়গাগুলিও খুব সঙ্কুুচিত এখন। আমাদের ইতিবাচক প্রত্যাশার জায়গাগুলি গত ৫১ বছরে বাড়েনি, বরং সেটা কমেছেই। আমরা ভুলে গেছি গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য ‘না’ বলাকেও উত্সাহিত করা, সবার অধিকারকে নিরাপদ রাখা ও করা। সেটা আমরা কেউই করি না। 

যে কোনো রাষ্ট্রের সরকার কিন্তু রাষ্ট্র না, রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান মাত্র। প্রতিটা ইনস্টিটিউশনের যেমন কিছু ‘শৃঙ্খলা’ থাকে, নিয়ম-কানুন থাকে। ইনস্টিটিউশনের সব সদস্যরা সেটা মেনে চলার কথা ইনস্টিটিউশনের স্বার্থেই। অধিকাংশ রাষ্ট্রের ‘সরকার’ সেটা করেন না। সরকার মনে করেন, তাঁরাই তো কেবল রাষ্ট্র। একমাত্র তাঁদেরই অধিকার আছে রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার বা ভাববার। এখানে অন্য কারো ‘না’ বলার ব্যবস্থাপনা কম। কোথাও এই স্বাধীনতা থাকলেও সেই ‘না’কে গ্রহণ করার সংস্কৃতির অনুশীলন থাকে না। কারণ রাষ্ট্র প্রধানত পরিচালনা করেন, সমাজের ‘মধ্যবিত্ত’ শ্রেণির কিছু মানুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মধ্যবিত্তরা স্বার্থপর এবং সংকীর্ণ চিন্তার গণ্ডিতেই বিচরণ করতে বেশি ভালোবাসি আমরা। এই আমরা ‘মধ্যবিত্ত’ দল কুয়াশাকেও ‘আগুনের ধোঁয়া’ বলেই মনে করি, স্বার্থে আঘাত লাগলে। কখনোবা সেই আগুনের ধোঁয়াকে ‘কুয়াশা’ বলেও মনে করি ওই একই কারণে। এই উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একধরনের ‘অস্বচ্ছতার’ দৃষ্টান্ত থাকে বেশি। 

যে কোনো রাষ্ট্রের সরকারের প্রধান কাজ দেশের নাগরিকদের দুটি অধিকারের ব্যাপারে তার ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করা, দায়িত্ব পালন করা। একটা হচ্ছে, নাগরিকদের সব মৌলিক অধিকার রা, অপরটা নাগরিকের সামাজিক এবং রাজনৈতিক সব ধরনের নিরাপত্তাকেও নিশ্চিত রাখা। এককথায়, সরকারের প্রধান কাজ তার ওপর অর্পিত নাগরিকদের দেয়া দায়িত্ব বেশি পালন করা, নিজেদের অধিকার ভোগ করাকে অগ্রাধিকার না দেয়া। সেটা ইতিহাসে খুব কমসংখ্যক সরকার করেন বা করেছেন। অধিকাংশ দেশেই ল করি, নির্দিষ্ট দেশ অথবা সরকারের অথবা সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের প্রতি একধরনের অন্যায়, অবিচার এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য নিরসনে তেমন কোনো ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করেন না। দায়িত্ব তো না-ই। 

এই কথাটা সেদিন এনাম আলী সাহেব ‘তৃতীয় মাত্রা’ অনুষ্ঠানে তার আলোচনাতেও বলেছেন। লন্ডন থেকে ঢাকা আসছেন তাঁরা বাংলাদেশ বিমানের ফার্স্ট কাসের প্যাসেঞ্জার হয়ে। সেই বিমানের সার্ভিস ছিল অত্যন্ত হতাশাজনক। বিমানের ‘ওয়াইফাই’ কাজ করছিল না, এমনকি যাত্রীদের এক্সট্রা একটা ন্যাপকিন দেবার ব্যাপারেও বিমান তাঁদের অপরাগতা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি আমরা ল করলে দেখবো, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের ভ‚মিকা কোনো অর্থেই খাটো করে দেখা যায় না। সেই প্রবাসীদের কেউ যদি দেশে আসেন, সেখানে যদি তাদের ‘ভোগান্তিই’ বাড়তেই থাকে। সেখানে সরকার যতই বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্টের জন্য বলেন বাইরে বাংলাদেশিদের অথবা বিদেশিদের, সেটা কার্যকর হবে না। বাংলাদেশে বিদেশি ইনভেস্টমেন্টের যেটুকু দৃষ্টান্ত দেখি অধিকাংশ তার রাজনৈতিক কারণ। সরকারের নিজস্ব স্বার্থের কারণে তারা কিছু কিছু কাজ করেন। এটা সরকারের আবশ্যিক কর্তব্য। এর জন্য সরকারকে ‘বাহবা’ দেবার কিছু, তেমন কিছু দেখিও না।

আমরা প্রায়ই একটা বিষয় ভুলে যাই, যা সত্য তাকে কখনোই বিলবোর্ড দিয়ে ঢাকা যায় না, একইভাবে যেটা সত্য সেটা কখনোই তার পথ পরিবর্তন করে না। পরিবর্তন হয় কেবল মিথ্যার। এটা ব্যক্তিগত জীবনেও সত্য। আমাদের মধ্যে যা সত্য অথবা সত্য হয়, সেটা সবসময়ই অপরিবর্তনীয় থাকে। যা সত্য না, সেটাই ঋতু পরিবর্তনের মতোই পরিবর্তিত হয়। বদলে যায় ব্যক্তির অনুভ‚তি এবং দৃষ্টিভঙ্গিও। কেবল সত্যের দৃষ্টিভঙ্গিটাই টিকে যায়। কেউ সেটা মানুক বা না মানুক সত্যটা সত্যই থেকে যায়। ইদানীং আমাদের মধ্যে সত্যকে মিথ্যা বানানোর নানা রকমের অজুহাত এবং কৌশলের চর্চা করি আমরা অনেকেই, কেবলই ব্যক্তিগত স্বার্থে। কেউ এটাকে স্বীকার করি, কেউবা অস্বীকার করি। কথাগুলি ব্যক্তিজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলা। তাই এখানেও লেখা। এটাতো এক অর্থে ব্যক্তি জীবনের জার্নাল। জীবনে যা দেখছি এবং দেখি, আমার লেখাতে তার একটা প্রাধান্য থাকবেই। সব ঘটনাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। 

অনেক সময় অনেক বন্ধুদেরও বলি, কোনো মানুষকে পারতপে ‘অ্যাভয়েড’ কিংবা ‘ইগনোর’ করাটা কোনো কোনো সময় একটা মানুষকে খুন করার মতোই নির্মম হতেই পারে। কিন্তু এই নির্মম কাজটা আমরা অনেকেই কখনো জেনেও করি, কখনো না জেনে করি, কখনো ‘ব্যক্তিগত ইচ্ছায়’ করি। এটা ব্যক্তি থেকে শুরু হয় সমাজ এবং রাষ্ট্রেও ছড়ায়। যখন এই বিষয়টা রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়, তখন রাজনীতিতে সুবাতাস কমতে থাকে, ‘দুর্গন্ধ’ এবং ‘দুর্বৃত্তায়নটাই’ বাড়ে। বিষয়টার সত্যতা এখন আর কাউকেই ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। চোখ-কান খোলা থাকলেই বোঝা যায়। কে অথবা কারা এর জন্য দায়ী? এককথায় কম-বেশি আমরা সবাই। 

বিশ্বে আমাদের সময়টা এখন পৃথিবীর বহু দেশেই একদল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্ত এবং দুর্নীতিবাজদের দাপটেই আছে ও চলছেও। তাঁরাই এখন সমাজ এবং রাষ্ট্রের পরিচালক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এখনকার সমাজ ও রাষ্ট্রে ‘সুশাসনের’ বদলে মানুষ নামের ‘দানবদের’ দুশাসনেই প্রাণে বেঁচে আছে সাধারণ মানুষ। আমরা এখন যে যেখানেই আছি, তাঁরাও নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য এক তাঁবুর নিচে আসতেও পারছি না। এই কারণে রাষ্ট্রের প্রধান ‘অয়েল অর্গানাইজড’ শ্রেণিশক্তি ‘সরকার’ আমাদেরকে নানাভাবে বিভক্ত করে তাঁদের ব্যক্তিগত হালুয়া-রুটিকে সবকিছুর আগেই নিরাপদ রাখতেই চেষ্টা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিশ্বে এখন এমন দেশ কমই আছে, যাকে ‘গণতান্ত্রিক’ দেশ বলা যায় বা বলতে পারি, অথবা যেখানে নির্দিষ্ট সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রান্তিক পর্যায়ের নাগরিকদের ন্যূনতম সামাজিক এবং তাঁদের রাজনৈতিক অধিকারকে সুনিশ্চিত রাখতে, নিরাপদ রাখতে কোনো সরকার এটাকে তাদের নৈতিক কর্তব্য বলেও মনে করেন এবং সেই দায়িত্বটা পালন করেন। এখন এই সময়। বর্তমান বিশ্ব, নানান রকম বৈষম্য, অরাজকতা, দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়নের প্রতিদিনের মিশ্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। 

প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের একটা লেখাতে বহুদিন আগে পড়েছি, যার মর্মকথা ছিল রাষ্ট্র, এখনো অধিকাংশ েেত্রই তার নাগরিকদের বন্ধু হতে পারেনি। লোকে তাই চেয়েছে রাষ্ট্রের পাইক বরকন্দাজদের কাছ থেকে যতটা পারা যায় দূরে থাকতে। অনেক েেত্র মনে হয়েছে, পালাতে পারলেই বাঁচে। চেয়েছে মনের দরজা বন্ধ করতে, ঘরের দরজা তো বটেই; কিন্তু পারেনি। ভেবেছে মায়ের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেবে, কিন্তু মায়ের কি সাধ্য সন্তানকে নিরাপত্তা দেয়। রাষ্ট্র তার আইন-আদালত, দারোগা-পুলিশ, আমলা, টাউট নিয়ে নাগরিকের দরজায় গিয়ে ভিড় করেছে। রাষ্ট্রের এই তত্পরতার জন্যই বাঙালির জীবনে রাজনীতি এতো জরুরি বিষয়। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন এ জি স্টক সাহেব। ’৪৭-এর পরপরই। তাঁর একটি স্মৃতিকথায় মিস্টার স্টক লিখেছেন, বাঙালির জীবনে কবিতা ও রাজনীতির জরুরি জায়গাটা সম্বন্ধেও। এটার একটা মূল কারণ লেখক বলেছেন, আমাদের ‘দারিদ্র্য’। মিস্টার স্টকের কথায় এটা বাঙালির অনেক কষ্ট। বাধ্য হয়েছে এভাবে থাকতে এবং সুখে না। দুঃখেই সে কবিতা লেখে, গান গায় এবং রাজনীতি করে।

যাই হোক, আমার যে কোনো লেখাতে তাই রাজনীতি-সংক্রান্ত ভাবনা চলেই আসে জীবনের নানান কষ্ট এবং দুঃখের অভিজ্ঞতা থেকেই। তাই কালি ও কলমের ছোঁয়া পেলেই এসবের কথাই লিখি যত্রতত্র। সেটা ভালো-মন্দ যাই হোক না অথবা প্রাসঙ্গিক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

মার্চ ২৯ ২০২২, নিউইয়র্ক

শেয়ার করুন