২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৬:৪০:০৬ পূর্বাহ্ন


দেশকে মোশরেফা মিশু
গণঅভ্যুত্থানের গ্রাউন্ড তৈরি হচ্ছে নীরবে
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৮-২০২২
গণঅভ্যুত্থানের গ্রাউন্ড   তৈরি হচ্ছে নীরবে


গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব খারাপ। ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট চলছে। সরকার যে পথে হাঁটছে তাতে মানুষ মহাবিরক্তির মধ্যে আছে। একটা গণঅভ্যুত্থানের গ্রাউন্ড তৈরি হচ্ছে নীরবে।

আমেরিকা থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে মোশরেফা মিশু এসব কথা বলেন। । নিচে রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। 

১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েই সামরিক জান্তা এরশাদের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু করেন মোশরেফা মিশু। ছাত্র জীবনে ‘ছাত্র ঐক্য ফোরাম’ করতেন তিনি। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত তিনি ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ছাত্র ঐক্য ফোরামের আহ্বায়ক ও সভাপতি ছিলেন ১৯৯৫ সালে ছাত্র ঐক্য ফোরামের জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। নেমে পড়লেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এই নেত্রী গার্মেন্টস সেক্টরের শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে রাজপথে লড়াইয়ে। কারণ তিনি মনে করলেন এরা অনেক নির্যাতিত, হচ্ছে অপমানিত।

এর পাশাপাশি সমাজে তারা হচ্ছে নিগৃহীত। কারণ সেসময় জুট টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আছে, মজুরি নির্ধারিত আছে, সাপ্তাহিক ছুটি আছে, কিন্তু গার্মেন্টস সেক্টরে এসবের বালাই নেই। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন গার্মেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা। ১৯৯৫ সালের ২০ অক্টোবর গড়ে তুললেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠন ‘গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম’। কিন্তু এ কাজ করেও রাজনৈতিক ভাবে তৃপ্ত হতে পারছিলেন না তিনি। কোনো সংগঠন নয়, পার্টিতে কাজ করার তীব্র আকাক্সক্ষা তৈরি হয় তার। কেননা জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিষয়লোতে আমাদের অবস্থান তুলে ধরতে পারছিলেন না। এদিকে ছাত্ররাজনীতি করার সময়ই গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ কৃষক ফোরাম, কিষানি ফোরাম ও আদিবাসী ফোরাম। এগুলো ছোট ছোট শ্রেণিগত সংগঠনের গ্রুপ। 

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অল্প বিস্তর  কাজ নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘মাতৃধারা সাংস্কৃতিক কমান্ড’। ১৯৯৭ সালে এসব শ্রেণিগত সংগঠনগুলোর কমরেডদের সাথে  পার্টির প্রসঙ্গটি তুললেন। দীর্ঘ আলোচনা হলো তার নিজেরই মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিলেন এসব শ্রেণিগত সংগঠনসমূহের সমন্বয়ে একটি পার্টি প্রসেস শুরু করা যায়। ১৯৯৭ সালে এই চিন্তার ভিত্তিতে ১৬ই ডিসেম্বর একটি জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করেন।  রুদ্ধদ্বার কনভেনশনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠলো ‘বিপ্লবী ঐক্য ফ্রন্ট’, একটি পার্টি প্রক্রিয়া। বিপ্লবী ঐক্য ফ্রন্ট নিয়ে অন্যান্য বাম দলগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ কাজ শুরু করেন। এরপর একটি সত্যিকার বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে ২০০৮ সালের ৩০-৩১ অক্টোবর ৩ দলের ঐক্য কংগ্রেস করেন। শ্রমিক, কৃষক, সমাজবাদী দল ও শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন ও বিপ্লবী ঐক্য ফ্রন্টের উদ্যোগে ঐক্য কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি’।

দেশ পত্রিকাকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির এ নেতা মোশরেফা মিশু আরো বলেন, জনগণের কোনো রাজনৈতিক অধিকার নেই। এর পাশাপাশি নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি জনগণের জীবনে নাভিঃশ্বাস উঠেছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ সংকট। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে লোডশেডিং চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার সকল বিষয়ের মতো বিদ্যুৎ নিয়েও মিথ্যাচার করছে। তারা বলছেন দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। তাহলে লোডশেডিং কেন? কিছুদিন পর পর গ্যাসের সংকট তীব্র হচ্ছে। অধিকাংশ এলাকায় ভোররাতে গ্যাস আসে তখন রাত জেগে রান্নার কাজ সারেন গৃহিণীরা। পানির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দফায় দফায় পানির দাম বাড়ানো হয়েছে কিন্তু বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা নেই অধিকাংশ এলাকায়। 

জনগণের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’ নামে একটি আইন জারি করেছে সরকার। এই আইনটি চরম স্বৈরতান্ত্রিক। এই আইনের আওতায় শত শত মানুষকে অন্যায়ভাবে জেলে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সরকারকে আরো ফ্যাসিবাদী করে তুলেছে। ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলেও মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এই আইনে পুলিশ যে কোনো মানুষকে যে কোনো সময় গ্রেফতার করতে পারবে। যে কোনো সময় মানুষের বাসায় ঢুকে তল্লাশি করতে পারবে। কম্পিউটারসহ কোন জিনিস তল্লাশি ও জব্দ করতে পারবে। রাজনীতিক, সাংবাদিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, কার্টুনিস্ট যে কেউ এই আইনের শিকার হচ্ছেন, পুলিশ রিমান্ড ও জেল খাটছেন। এই স্বৈরাচারী সরকার যা করছে তা বলতে গেলে বড়ো সড়ো বই লিখে ফেলা যাবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। জেলে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।

দেশ:কিন্তু এর আগে কি দেশের অবস্থা এমন খারাপ থাকেনি?

মোশরেফা মিশু:’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর ’৭২ থেকে ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থা ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে- এই সময়কালের কোন সরকারই মুক্তিযুদ্ধের সাম্য ও গণতান্ত্রিক চেতনা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেনি। কোনো সরকারই  প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার ছিল না। মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা ছিল না। জনগণ শান্তিতে থাকতে পারেননি । কিন্তু অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বর্তমান সরকার। ’৮০-এর দশকে সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আমরা জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছি। এরশাদ সরকার ছিল সামরিক স্বৈরাচারী সরকার আর শেখ হাসিনার সরকার হচ্ছে বেসামরিক স্বৈরাচারী সরকার। এছাড়া এই দুইয়ের মধ্যে আর কোনো তফাৎ নেই, বরং এটা নির্দ্বিধায় স্পষ্ট করে বলা যায়, এরশাদ স্বৈরাচারের চেয়েও বড়ো স্বৈরাচার হলো শেখ হাসিনার বর্তমান স্বৈরাচারী সরকার।

দেশ: শুধু কি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করছেন?

মোশরেফা মিশু:  এটা একটা অর্থহীন কথা। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাথে আমাদের কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করছি তাদের কৃতকর্মের জন্য, স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী তৎপরতার জন্য। 

দেশ: এসরকার কি দেশের উন্নয়নে কাজ করেনি?

মোশরেফা মিশু: পদ্মা সেতুসহ কয়েকটি উড়াল সড়ক গড়া ছাড়া আর কোনো ভালো কাজ দেখা যায় না। তাও আবার এই সেতুগুলোতে ব্যাপক লুটপাট ও দুর্নীতির কলঙ্ক লেগে আছে। অর্থনীতিবিদদের তথ্য মতে দেশের ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন,  ১০ কোটি মানুষের দুই বেলা খাবার জোটে না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব মতে করোনাকালীন সময়ে দেশে ১১ হাজার মানুষ কোটিপতি হয়েছে। এর নাম উন্নয়ন? এর নাম ডিজিটাল বাংলাদেশ?  

দেশ: এসরকারের কি কি সফলতা আপনার চোখে পড়ে?

মোশরেফা মিশু: চোখে পড়ার মতো কোনো সফলতা কি আছে এই সরকারের? কয়েকটা মেগা প্রজেক্ট করে জনগণের চোখে ধুলো দেয়ার চেষ্টা চলছে। এই মেগা প্রজেক্ট দেখিয়ে উন্নয়ন উন্নয়ন রব তুলছে সরকার। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। ব্যাপক জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাচ্ছে না। 

দেশ: দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন। বলছেন গণতন্ত্র নেই। কিন্তু কই আপনাদের এমন দাবির পক্ষে তো জনগণকে সমর্থ দিতে দেখা যায় না।

মোশরেফা মিশু: আমাদের রাজনীতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটা একটা লম্বা সফর। আরো দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। এই চলমান স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থার বিরুদ্ধে আমরাই বেশি আন্দোলন করছি জনগণ এগুলো দেখছেন। তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। এখন মিছিলে লোকসমাগম কম বটে তবে সময় আসবে, সরকার ও শাসকশ্রেণির প্রতি তাদের আস্থা নেই। এই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরাই বেশি লড়ই করছি। আমরা মনে করছি আমাদের আন্দোলনসমূহ একদিন অবশ্যই একটা গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি তৈরি করবে।

দেশ: স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপনার রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল। সেসময়ে আপনাদের ডাকে জনগণ ঝাপিয়ে পড়তো। এখন কেনো তা হচ্ছে না?

মোশরেফা মিশু:ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে দুটোর প্রেক্ষাপট ভিন্ন।  সে সময় স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল। এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ’৮২ থেকে ’৯০, এই সময়কালে শুরুতেই জনগণ ব্যাপক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিল তা নয়। ৯ বছর লেগেছিল ছাত্রগণঅভ্যুত্থান তৈরি হতে। স্বৈরাচারের দমনপীড়ন, খুনের বিরুদ্ধে লাগাতার ৯ বছর তিল তিল করে আন্দোলন করে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে ছিলাম আমরা।

দেশ: দেশে কোনো একটি বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠছে না? জনগণ কি এসরকারের আমলে শান্তিতে আছে বলে রাস্তায় নামছে না?

মোশরেফা মিশু: এতো দমনপীড়নের মধ্যে কীভাবে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠবে। সমাবেশ, মিছিলের উদ্যোগ নিলেই সরকার গ্রেফতার করে, মিথ্যা মামলা দায়ের করে জেলে নিক্ষেপ করে। দেশে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নেই। সরকার যে পথে হাঁটছে তাতে মানুষ মহাবিরক্তির মধ্যে আছে। একটা গণঅভ্যুত্থানের গ্রাউন্ড তৈরি হচ্ছে নীরবে। 

দেশ: এসরকারকে আপনি কি পরামর্শ দেবেন?

মোশরেফা মিশু: সরকারপ্রধানকে বলবো, অবিলম্বে পদত্যাগ করুন এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিন। ইতোমধ্যে আপনারা প্রমাণ করেছেন আপনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক হতে পারে না। অতএব অবিলম্বে বিদায় হোন।


শেয়ার করুন