২৮ মার্চ ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৬:৩২:৪১ অপরাহ্ন


আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিলের দাবি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৩-২০২৩
আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিলের দাবি


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) ভারতের আদানি গ্রুপের নিকট থেকে বাংলাদেশ কর্তৃক বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবি জানিয়েছে। এর পাশাপাশি বাপা ও বেন আমদানিকৃত বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা পরিহার করার দাবি জানায়। 

বাপা ও বেনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে এ দাবি করা হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি সুলতানা কামাল এবং বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন)-এর বৈশ্বিক সমন্বয়কারী খালেকুজ্জামান। বিবৃতিতে আরো বলা হয় যেখানে বাংলাদেশের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক অলস থেকে যাচ্ছে, সেখানে বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদ্যুৎ আমদানি মোটেও যৌক্তিক নয়। তদুপরি, আদানি কোম্পানির কাছ থেকে যেসব শর্তে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনতে যাচ্ছে তা বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রতিকূল। উদ্বেগের বিষয় যে, বাংলাদেশ বর্তমানে যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুসরণ করছে তাতে বিদ্যুৎ আমদানির পরিমাণ ভবিষ্যতে ক্রমাগতভাবে বাড়ার কথা। আদানি কোম্পানির সঙ্গে বর্তমান অভিজ্ঞতা এই পরিকল্পনার অবিমৃষ্যকারিতা প্রমাণ করেছে।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের উল্লেখ করে বলা হয়, এতে জানা যায় যে, ভারতের ঝাড়খন্ডে গোড্ডায় নির্মিত আদানি গ্রুপের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এ বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাণিজ্যিকভিত্তিতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনবে। যেসব শর্তে এই বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে তা বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রতিকূল। এসব শর্তের অধীনে আদানি কোম্পানিকে যেসব আর্থিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তা বাংলাদেশের অন্য কোনো কোম্পানিকে দেয়া হয়নি। সংবাদ মাধ্যমে এই চুক্তির যেসব বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তার কয়েকটি নিম্নরূপ। 

প্রথমত. যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ইউনিটপ্রতি কয়লা ব্যবহারের পরিমাণ এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের সব মাত্রার জন্য একই ধরা হয়েছে, সেখানে আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য উৎপাদন ক্ষমতা কম ব্যবহৃত হলে ইউনিটপ্রতি কয়লা ব্যবহারের পরিমাণ বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু এ কারণেই বাংলাদেশকে বছরে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হতে পারে। দ্বিতীয়ত. বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) চার মাস পর পর আদানি কোম্পানির কাছে বিদ্যুতের চাহিদাপত্র পাঠাতে হবে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে যদি পিডিবি এর চেয়ে কম বিদ্যুৎ কিনে তবুও চাহিদাপত্রে উল্লিখিত পরিমাণের পুরো দাম বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে। তৃতীয়ত. বাংলাদেশকে আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত ক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণের বিদ্যুৎ কিনতেই হবে; নইলে জরিমানা দিতে হবে। চতুর্থত. যদি পিডিবির চাহিদা-স্বল্পতার কারণে আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া বিলম্বিত হয়, তবে বাংলাদেশকে পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে। পঞ্চমত. আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা ব্যবহারে সিস্টেম লসের দায়ভার বাংলাদেশকে বহন করতে হবে। ষষ্ঠত. আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য বিদেশ থেকে যে কয়লা আমদানি করা হবে তার দাম নির্ভর করবে আদানির নিজের ওপর, কারণ এই কোম্পানি বিদেশে কয়লাখনিতে উত্তোলন থেকে শুরু করে পরিবহন, সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। সপ্তমত. আদানির সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ২০১৭ সালের নভেম্বরে। কিন্তু ভারত সরকার কর্তৃক ২০১৯ সালে ঝাড়খন্ডকে ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে ঘোষণা করার ফলে আদানি কোম্পানি বহু ধরণের কর সুবিধা পাচ্ছে। অথচ আদানি কোম্পানি এ বিষয়ে কোনো তথ্য পিডিবিকে জানায়নি এবং বাংলাদেশকে এসব কর সুবিধার অংশীদার করায় প্রয়াসী নয়। অষ্টমত. এই প্রকল্পের সব ঝুঁকি বাংলাদেশের ওপর চাপানো হয়েছে এবং বহু বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। 

আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তির উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের ভোক্তা সমিতি এই চুক্তির জালিয়াতি সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে-বলে অভিমত প্রকাশ করেছে। বাপা ও বেন এই চুক্তি বাতিলের দাবিকে সমর্থন করছে। এ প্রসঙ্গে বাপা ও বেন আরো লক্ষ করে যে, বাংলাদেশ সরকার প্রথমে টোকিও ইলেকট্রিক কোম্পানি এবং পরে ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস, জাপান কর্তৃক প্রণীত এমন একটি বিদ্যুৎ পরিকল্পনা অনুসরণ করছে যা শুধু কয়লানির্ভর নয়, বিদেশনির্ভরও বটে! এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ সরবরাহে আমদানিকৃত বিদ্যুতের অংশ ২০২১ সালের ৫ শতাংশ থেকে ২০৫০ সনে ১৫ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ আমদানির বর্তমান হার আফগানিস্তান ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাপা এবং বেন কর্তৃক আয়োজিত ‘জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন, ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন’ বিষয়ক সম্মেলনে এই পরিকল্পনার সমালোচনা করা হয় এবং কয়লার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা বাড়িয়ে এবং আমদানিকৃত বিদ্যুৎ পরিহার করে নতুন বিদ্যুৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং অনুসরণের দাবি জানানো হয়। আদানি চুক্তির বিশেষ বাপা-বেন সম্মেলনের উপযুক্ত দাবি সঠিকতাই নতুনভাবে প্রমাণ করলো। এই দাবির প্রতি মনোযোগী হওয়ার জন্য বাপা ও বেন সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছে।

শেয়ার করুন