২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ৬:৬:০৪ পূর্বাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-০৪-২০২২
কথার কথকতা


ঘটনাটা আমাকে বলেছিলো আমাদের এক জুনিয়র ফ্রেন্ড। সে জানে আমি লেখালেখি করি, তাই আমাকে বললো- বড় ভাই, ওনার বা আমার নাম উল্লেখ করবেন না কিন্তু আমি চাই বিষয়টি লিখিত হয়ে থাক। কারণ এটি এক মর্মান্তিক কাহিনি, আমার জীবনে আমি এমনটি কখনো শুনিনি! আমি কথা দিলাম, নাম উল্লেখ করবো না। ঘটনাটি ওর মুখের ভাষাতেই লিপিবদ্ধ করছি।

‘আমার অফিসের এক সিনিয়র বস, ওনার এক বন্ধুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইফতার করলেন এবং ওদিক সেরে আবার অফিসে এলেন। এখানে এসে যথারীতি চা-নাশতা এবং প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সারতে সারতে রাত বারোটার বেশি হয়ে গেলো। আমাদের অফিসটি রাতেও খোলা থাকে। আমার অফিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওনাকে উবারের গাড়ি ভাড়া করে দেয়ায় কথা ভাবছিলেন। আমি বললাম, স্যারকে আমার গাড়িতে পৌঁছে দেবো। ওনাকে মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই আমি বাসায় পৌঁছে দেই। যাবার পথে আমার অনুরোধে তিনি আমাকে কবিতা শোনান। ছাত্রজীবনে কবিতা পড়েছি, নিজে দু’একবার লেখার চেষ্টাও করেছি, কিন্তু ওনার কবিতা শুনলে আমার মনে হয় আমি যেন আসলেই কোনো নতুন ধরনের অন্য রকম কবিতা শুনছি। এক রকমের ভালোলাগা কাজ করে, মনে হয় যেন মনটাকে স্পর্শ করে যায়। উনি বলেন, আপনার ভেতর একটা ভালো কবি মন আছে। তিনি বড়-ছোট সবাইকে আপনি বলে সম্বোধন করেন।

আপনারা জানেন, নিউইয়র্কের রাস্তায় গাড়ি চালাতে হয় পরিপূর্ণ সচেতনতার সাথে। এখানে সিগন্যাল, স্পিড লিমিটসহ সব নিয়ম দিবারাত্রি নির্বিশেষে মেনে চলতে হয়। না হলে দুর্ঘটনা অথবা জরিমানা অনিবার্য। আপনি মনে করবেন কেউ দেখছে না, কিন্তু সময়মতো ছবিসহ জরিমানার সরকারি স্লিপটি ডাকযোগে বাসায় চলে আসবে। এই কারণে আমিও সচেতন থাকার চেষ্টা করি আর তিনিও রাস্তার দিকে খেয়াল রাখতে বলেন। শুরুর দিকে বলতেন, গাড়ি একখানে রাস্তার পাশে থামান, কবিতা শোনার পর গাড়ি টান দেবেন। আমি বলি- স্যার চিন্তা করবেন না, চালক হিসেবে আমার সুনাম আছে, তারপরও আমি খুব সাবধান থাকবো। কান আপনার দিকে, চোখ রাস্তার দিকে আর হাত স্টিয়ারিংয়ের ওপর।

আমরা জ্যাকসন হাইটস থেকে ব্রুকলিন যাচ্ছি, ওনাকে নামিয়ে দিয়ে জ্যামাইকায় আমার বাসায় যাবো। আজ চারটা কবিতা শুনিয়েছেন তিনি আমাকে। একটা আমার সংগ্রহে নেই, তিনটা আছে। বিষয়গুলো এমনি যে আমার মনে হয় প্রত্যেকেরই ভালো লাগবে, তাই হুবহু তুলে ধরছি। আমার কাছে মনে হয়েছে কবিতাগুলোতে প্রাণ আছে, জীবন আছে। প্রথম কবিতাটির নাম ‘মুক্তি’। কবিতাটি এরকম-

শরবিদ্ধ পাখি যেমন করে

বুঝতে পারে

আরো আগে

উড়াল দেয়া উচিত ছিলো-

তেমন করেই মনে হলো

কিছু কিছু কাজ

সময় থাকতে

করে ফেলা

জীবনের জন্য ভালো ছিলো।

পাখিরে-

তুইতো প্রজ্ঞা নিয়ে

মুক্ত হয়ে গেলি চিরতরে,

আমিতো পারি না

মুক্ত হতে

বিদ্ধ হয়েও

অজ্ঞতার মরচে ধরা শরে!

দ্বিতীয় কবিতাটির কপি পাইনি। তৃতীয় কবিতাটির শিরোনাম ‘বারো লাইন’। কবিতাটি এরকম-

অবয়ব পুড়ে যখন হয়ে যায় তামাটে

জ্ঞানবুদ্ধি পড়ে থাকে সেই স্তরে গাধাটে,

তখন আর চেষ্টা কেন গোলাপটি ফোটাতে

মনোকষ্ট বাজে যেন কারবালা ফোরাতে।

এটুকু নির্গমী কলমটা থেমে যায়

ব্যর্থ প্রেম কোথা যেন করে হায় হায়,

অমতা কান্তি হয়ে রবিবাবুর কাছে যায়

নজরুলের কেতন নারীর চরণে লুটায়।

এরপর আবারো হয় ছন্দের পতন

নুড়িপাথর হয়ে যায় মানিক রতন,

হৃদয় কেঁদে ওঠে পেলেই যতন

পরিণতি সুর করে অব্যর্থ রোদন।

শেষের কবিতাটির নাম ‘মায়ের কথা’। শিরোনামটি তিনি দু’বার উচ্চারণ করলেন আর স্বগতোক্তি করার মতো করে বলে উঠলেন, বাস্তব ঘটনা। মা কথাটা শুনে মনে আমার প্রয়াত মায়ের ছবি ভেসে উঠলো। ‘বাস্তব ঘটনা’ এ শব্দ দুটো শোনার পর আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। তিনি আবৃত্তি শুরু করলেন-


‘মায়ের কথা’

হবে বেতন পাবো টাকা

একটি গাড়ি আমায় নিয়ে

ছাড়বে ঢাকা

যাবো দেশের বাড়ি,

আমার ব্যাগে থাকবে তখন

মায়ের জন্য একটি শাড়ি।

পাইনি বেতন হয়নি যাওয়া

অনিয়ম হয় নাওয়া খাওয়া

ঘর-সংসার তো চলে না আর

কাব্য করে-

তারপরও চলছে জীবন

বদনখানি বেজার করে।

ফোনে যখন খবর পেলাম

হন্তদন্ত গ্রামে গেলাম

মায়ের সাথে দেখা হলো

কথা হলো না...

ঠিক এসময়ে আমার স্যার, সত্তর বছর বয়সী একজন মানুষ, মায়ের জন্য হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। একটা হাত ওনার কাঁধে রাখলাম আর বলতে থাকলাম, স্যার স্যার স্যার...

তিনি নিজেকে সামলে নিলেন, মন্তব্য করলেন, ‘সত্য ঘটনা’। এরপর কবিতার বাকি অংশটুকু আবৃত্তি করলেন-

মায়ের সাথে দেখা হলো

কথা হলো না,

শেষ গোসলের পরে মাকে

রাখা গেলো না।

মাকে আমরা সবসময়

আম্মা ডাকি,

কথা হয়নি এ শোক আমি

কোথায় রাখি!

সত্যি বলতে কি, ছোট ভাইয়ের মতো বন্ধুটির মুখে তার স্যারের এ কাহিনি আর কবিতা শোনার পর দেখি, আমিও কাঁদছি!


শেয়ার করুন