২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০২:৩১:২৩ পূর্বাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৫-২০২২
কথার কথকতা


একটা বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে যোগ দেয়ার কথা ছিলো। বইয়ের নাম ‘বাংলাদেশ টু আমেরিকা’, সোনিয়া কাদির রচিত বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা বই। সবার খুবই শ্রদ্ধেয় মানুষ তিনি, অনলাইনে সাড়া দিয়েছিলাম এই মর্মে যে, আমি অনুষ্ঠানে যোগ দেবো। তাছাড়া সাহিত্য অ্যাকাডেমির মোশাররফ সাহেবকেও কথা দিয়েছিলাম, প্রকাশনা উৎসবে থাকবো। বক্তব্য পেশ করার মতো কিছু পয়েন্ট টুকে নিয়েছিলাম একটুকরা কাগজে। অনুষ্ঠানস্থল হলো জ্যাকসন হাইটের জুইস সেন্টার, সময় ঠিক করা ছিলো বিকেল ছয়টা। ব্রুকলিনের বাসা থেকে বেরোতে বেরোতে আমার প্রায় সাড়ে চারটা বেজে গেলো। ঠিক করলাম, আজ ট্রেনে না গিয়ে বাসে যাবো। তাতে ট্রেনের তুলনায় সময় কিছুটা কম লাগবে। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। লিবার্টি অ্যাভিনিউ থেকে জ্যামাইকা অভিমুখী কিউ৮ বাসে উঠলাম, উডহ্যাভেন বুলেভার্ডে গিয়ে বাস পাল্টে কিউ৫৩তে উঠতে হয়, যেটি জ্যাকসন হাইট ক্রস করে উডসাইড পর্যন্ত যায়। ব্রডওয়ে/৭৪ স্ট্রিটে নামলেই জ্যাকসন হাইট।

একটা ফোনকল রিসিভ করার দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে বাস থেকে নামবার কথা ভুলে গেলাম, চলে গেলাম লাস্ট স্টপেজে। ফিরতি বাসের বিলম্ব দেখে ট্রেনে চেপে বসলাম, স্টেশনে ঢুকতে কার্ড থেকে আবার ভাড়া কাটলো, সময়ও নষ্ট হলো। সাকিল সাহেবের গ্রাফিক্স ওয়ার্ল্ডে বাড়তি গরম জামাটা রেখে চলে গেলাম জুইস সেন্টারে। অবশ্য তখনো জানতাম না যে, পরে আরো ভোগান্তি আছে কপালে। এর মধ্যেই কিরন সাহেবকে ফোন করে জানলাম, তিনি বিছানায় গড়াচ্ছেন, অতিসত্বর পৌঁছে যাবেন অকুস্থলে।

শুনলাম, জুইস সেন্টার খালি করে দিতে হবে রাত নয়টার মধ্যে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা বক্তৃতা শোনার পর যখন শুনলাম, আমার বক্তৃতার দৈর্ঘ হবে এক মিনিট, তখন মেজাজটা কেমন হয় বলুন! আমার কথাগুলো চমৎকার করে নিবেদন করতে গেলে প্রায় আধঘণ্টা সময় লাগবে। তাতে পুস্তক প্রণেতার উপকার নিহিত রয়েছে, আমার নয়। সংেেপ বললেও দশ মিনিট সময় লাগবে। ভাবলাম, এলাম কেন! অবশ্য বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে আমি অন্য কৌশল প্রয়োগ করলাম। বললাম, আপনারা এক মিনিটের বেশি সময় কথা বললে যদি আমাকে চাবুকও মারেন তবুও আমি আমার হাতের কাগজে টুকে নেয়া এই পয়েন্টগুলো নিবেদন করবোই। পয়েন্টগুলো একটা এক প্যারা হওয়ার কথা, কিন্তু আমি সবক’টি পয়েন্ট ব্যবহার করে অল্প কয়েকটি বাক্য নিবেদন করলাম। কি ঘোড়ার ডিম বলা হয়েছে জানি না, তবে কেউ কেউ ‘ভালো বলেছেন’ বলে মন্তব্য করেছেন। আমি কিন্তু সন্তুষ্ট হইনি। অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফিরবার আগেও আমি ভাবিনি যে, আরো বিরক্তি আমার জন্য অপো করছে।

এরই মধ্যে আলোচ্য পুস্তকটির দুটো কপি কিনেছেন সাংবাদিক কিরন সাহেব, একটা উনি রেখেছেন, আরেকটি আমাকে উপহার দিয়েছেন। ওনাকে বললাম, লেখক মাসখানেক আগে আমাকে একটা বই দিয়েছেন, এটা আমি একজনকে উপহার দেবো। এবার ঘরে ফেরার পালা।

ট্রেনে বাসায় ফিরতে আমার একবার ট্রেন বদল করতে হয়। লাইন রিপেয়ার কাজের জন্য মাঝেমাঝে ট্রেনের রাউট পরিবর্তন হয়। আমি সাধারণত জ্যাকসন হাইট থেকে ই-ট্রেনে উঠি, ৪২ স্ট্রিট বা ওয়েস্ট৪-এ গিয়ে এ-ট্রেন ধরি। এসে নামতে হয় গ্র্যান্ট অ্যাভিনিউ। গ্র্যান্ট থেকে ওপরে সড়কে আসার সিঁড়ি বেশ খাঁড়া এবং আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়, তাই মাঝেমাঝে আমি আরেক স্টেশনে এগিয়ে গিয়ে ৮০ স্ট্রিটে নামি, ওটি মাটির নিচে নয়, ওপরে। তাই আমার সিঁড়ি বাইতে হয় না, যা করতে ডাক্তার আমাকে বারণ করেছেন। যা-ই হোক, দেখা গেলো, ই-ট্রেন যে স্টেশনগুলো ধরছে এর বেশিরভাগই তার স্বাভাবিক সময়ের স্টেশন নয় আর ইলেকট্রনিক ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে যে, ওয়েস্ট৪ স্টেশন এ-ট্রেন ধরবে না, ধরবে ৪২ স্ট্রিট এবং আরেকটা স্টেশন, যেটার নাম আমার চেনা নয়। তাই বাধ্য হয়েই ৪২ স্ট্রিটে নামলাম, কিন্তু এ-ট্রেন পেলাম না। পথনির্দেশনার লেখাগুলো ধরে ধরে সাবওয়েতে ইঁদুরের মতো এক-দেড় মাইল অতিক্রম করে এ ট্রেনে উঠবার স্থানে এসে দেখি সব ফিতা দিয়ে ঘেরা, অর্থাৎ বন্ধ। কি মুশকিল। কি করি, কি করি করতে করতে আপটাউনগামী এ ট্রেনেই উঠে বসলাম। কারণ ডাউনটাইনের এ-ট্রেন এখানে পাওয়া যাবে না। উল্টাপথে ৫৩ স্ট্রিটে গেলাম এবং সেখানে ইলেকট্রনিক নির্দেশনায় দেখলাম, ডাউনটাউনগামী এ-ট্রেন আসবে। বেশিরভাগ এ-ট্রেনে আবার বৈদ্যুতিক নির্দেশনা থাকে না, কারণ এগুলো প্রাচীন মডেল। অনলাইনে ম্যাপ ডাউনলোড করে দেখলাম, তা আমার স্টেশন স্পর্শ করবার ইঙ্গিত দিচ্ছে না। স্বাভাবিক রাউটের বাইরের স্টেশনগুলো ধরে আসতে আসতে যখন ট্রেন জে-স্ট্রিট থেকে শুরু করে চেনা স্টেশনগুলো দেখাতে শুরু করলো তখন মনে হলো, পথের দিশা বুঝি পেলাম। তবে নিশ্চিত হলাম, পৌঁছার পর। বাসায় আসতে আসতে হয়ে গেলো রাত প্রায় তিনটা। তবুও তো পৌঁছলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না যে, আজকের দিনটি সফল, না কি ব্যর্থ! প্রিয় পাঠক, আপনার কি মনে হয়- দিনটি কি সফল, না বিফল, জানাবেন কিন্তু!

শেয়ার করুন