০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৬:৩৮:৩৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


পাঁচজন বাংলাদেশি কর্মীর বকেয়া মজুরি ও বঞ্চনার ক্ষতিপূরণ
বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টের ৩০ লাখ ডলার জরিমানা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১২-২০২৫
বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টের ৩০ লাখ ডলার জরিমানা রেস্টুরেন্টের সামনে অবস্থান


নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনের পার্ক স্লোপের অভিজাত ও শান্তিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশী মালিকানাধীন জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট ‘ইন্ডিয়ান স্পাইস’ দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক ও এলাকাবাসীর পছন্দের খাবারের স্থান হিসেবে পরিচিত। অনলাইন রিভিউ, স্থানীয় গাইডবুক ও ট্রিপঅ্যাডভাইজরের অভিমতে রেস্টুরেন্টটি এলাকাবাসীর কাছে ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারের গন্তব্যগুলোর একটি। কিন্তু এই খ্যাতনামা রেস্টুরেন্টটি এবার আলোচনায় সম্পূর্ণ উল্টো কারণে। নিউইয়র্ক স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের তদন্তে রেস্টুরেন্ট মালিক বাংলাদেশী মারিয়াম খন্দকারকে গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে অর্ডার টু কমপ্লাই’ নথির মাধ্যমে অবহিত করে প্রায় ৩০ লাখ ডলার বকেয়া মজুরি, জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ- বহু বছর ধরে বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়মিত বেতন, ন্যূনতম মজুরি, ওভারটাইম বা বাধ্যতামূলক বিরতি ছাড়াই টানা কাজে লাগানো হয়েছে। তদন্তের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রেস্টুরেন্টে কাজ করা পাঁচজন কর্মী ২০১৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ধারাবাহিকভাবে শ্রম আইন লঙ্ঘনের শিকার হন। এদের মধ্যে ছিলেন একজন ডিশওয়াশার, একজন বাসার বা বাসবয়, একজন ওয়েটার এবং দুইজন শেফ। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, তাদের প্রায়ই সপ্তাহে ৭৫ থেকে ৮০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো হতো এবং বহু ক্ষেত্রে দিনে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত টানা শিফটে থাকতে হতো। কোনো কর্মীকেই নিয়মিত ছুটি দেওয়া হয়নি। বহুজনের ক্ষেত্রে সপ্তাহে সাত দিনই কাজ করতে হয়েছে, যা নিউ ইয়র্ক স্টেট লেবার ল’-এর সরাসরি লঙ্ঘন। ওয়েটার ও ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রাজু আহমেদ, যিনি সর্বোচ্চ বকেয়া পাওয়ার তালিকায় রয়েছেন। বলেছেন, তিনি বছরের পর বছর ধরে প্রতিদিন কাজ করেছেন, শুধু ঈদ, থ্যাঙ্কসগিভিং বা বড় কোনো উৎসবে ছুটি মিলত। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমার কোনো অফিসিয়াল ছুটির দিন ছিল না। প্রতিদিনই কাজ করতে হতো। রাজু আহমেদের পাওনা পরিমাণ শুধু তার জন্যই ৩,০৮,০০০ ডলার, যা এই মামলার সবচেয়ে বড় একক দাবির অঙ্ক হিসাবে বলা হয়েছে । আরো যারা শ্রম শোষণের শিকার তাদের মধ্যে রয়েছেন ফয়েজ উল্যাহ, নেয়াতম উল্যাহ, মোহাম্মদ হাসান ও খোরশেদ আলম। জানা গেছে, ঐ রেস্টুরেন্টের মালিক মারিয়াম খন্দকারের বাড়ি বাংলাদেশের সোনাইমুড়ি। আবার ৫ জন কর্মচারির মধ্যে ৩ জনের বাড়িও নোয়াখালি। মারিয়াম খন্দকার নোয়াখালির সোনাইমুড়ি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যানের সন্তান। আরো জানা গেছে, গত ২ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী কর্মচারিরা, কাউন্সিলওম্যান শাহানা হানিফ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত রেস্টুরেন্টের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় কাউন্সিলওম্যান শাহানা হানিফ বলেন, যারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন আমরা তাদের পাশে রয়েছি এবং অর্থ না পাওয়া পর্যন্ত থাকবো। আরো যারা এই ধরনের প্রতারণার শিকার তারা আমাদের অফিসে যোগযোগ করতে পারেন।

শ্রম দফতরের দাখিল করা অর্ডার টু কমপ্লাই নথি অনুযায়ী, ৩০ লাখ ডলারের এই দাবির মধ্যে রয়েছে ৯১৫,০০০ ডলার বকেয়া বেতন এবং ওভারটাইম, সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে শ্রমিকদের জন্য, সেই সঙ্গে ১৬ শতাংশ সুদ এবং এক মিলিয়ন ডলারের বেশি সিভিল পেনাল্টি। তদন্তকারীরা জানান, দীর্ঘ সময় ধরে রেকর্ডবিহীনভাবে কর্মীদের বেতন দেওয়া, ওভারটাইম না দেওয়া, ন্যূনতম মজুরির নিচে মজুরি প্রদান, কর্মীদের জন্য নির্ধারিত খাবারের বিরতি বা সাপ্তাহিক ছুটির ব্যবস্থা না করাই এই মামলাকে বহুগুণ গুরুতর করে তুলেছে। নিউ ইয়র্ক আইনে দীর্ঘমেয়াদি ও ইচ্ছাকৃতভাবে শ্রম আইন লঙ্ঘন করলে জরিমানা, জরিমানা-পরবর্তী ক্ষতিপূরণ ও সুদের অংক দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। উপরন্তু, মালিক বেতন ও কাজের কোনো রেকর্ড না রাখায়, আইনি প্রমাণের ক্ষেত্রে কর্মীদের কষ্ট আরও বেড়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আদেশ অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ না করলে সরকার সম্পত্তিতে লিন আরোপ, ব্যবসা বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা বা সংগ্রহের জন্য স্টেট এটর্নি জেনারেলের কাছে মামলা পাঠানোর ক্ষমতা রাখে ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার। নিউ ইয়র্ক স্টেটে নতুন শ্রম আইন কার্যকর হওয়ায় এখন স্টেট আরও দ্রুত ও কঠোরভাবে এই ধরনের বকেয়া আদায় করতে পারে।

এই ঘটনার একটি বিশেষ দিক হলো, ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচজন শ্রমিকের সকলেই বাংলাদেশি অভিবাসী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রে বহু বছর ধরেই কাজ করলেও অধিকাংশেরই ইমিগ্রেশন কাগজপত্র এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। তাদের অভিযোগ, বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে মালিক অনিয়মিত ছিলেন, ওভারটাইম কখনও দেওয়া হয়নি, এবং ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস নিয়ে কর্মীদের মাঝে অস্পষ্টতা বা ভয়ের সুযোগও নেওয়া হয়েছে। ওয়ার্কার্স জাস্টিস প্রজেক্ট নামে একটি শ্রমিক অধিকার সংগঠন এই কেসে সহায়তা করেছে। তারা জানায়, নিউ ইয়র্ক সিটির বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে তারা একই ধরনের অসংখ্য ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন, যেখানে বেতন দাবির প্রতিবাদ করলেই শ্রমিকদের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের হুমকি দেওয়া হয়। তবে নিউ ইয়র্ক স্টেট আইনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস যাই হোক না কেন, শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি আদায়ের অধিকার রয়েছে এবং এ বিষয়ে কোনো ধরনের ভীতি প্রদর্শন বা হুমকি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

ঘটনাটির আরেকটি অংশ হচ্ছে রেকর্ডের অভাব। যেহেতু রেস্টুরেন্টটি কখনোই শ্রমিকদের বেতন বা কর্মঘন্টার সঠিক রেকর্ড রাখেনি, তাই শ্রমিকদের আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিটস পাওয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। ব্রুকলিন লিগ্যাল সার্ভিসের আইনজীবী নিকোল স্যাল্ক বলেন, শুধু বেতনই তারা পাননি তা নয়, বেকারভাতা পাওয়ার ক্ষেত্রেও কয়েকমাস দেরি হয়েছে, কারণ নিয়োগকর্তা তাদের কাজ এবং মজুরি যথাসময়ে রিপোর্ট করেননি। তার ভাষায়, তারা আসলে দ্বিগুণ শাস্তি পেয়েছেন। প্রথমত তাদের বেতন দেওয়া হয়নি, দ্বিতীয়ত বেকারভাতা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ভোগান্তিতে পড়েছেন।

ব্রুকলিন কাউন্সিল সদস্য শাহানা হানিফ, যিনি এই মামলায় শ্রমিকদের সহায়তা করেছেন, বলেন যে শ্রমিক শোষণ ও শ্রম আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে নতুন অভিবাসীরা যখন পুরনো অভিবাসীদের মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তখন এই ধরনের শোষণ ও বঞ্চনার ঘটনা আরও বেশি ঘটে। তার মতে, এই ঘটনার খবর আরও বেশি প্রকাশ হওয়া উচিত। আমাদের শহরের আরও শ্রমিকরা যেন জানতে পারে- তাদের অধিকার রক্ষার জন্য কোথায় যেতে হবে।

এলাকাবাসীর কাছে রেস্টুরেন্টটির জনপ্রিয়তা কখনোই প্রশ্নের বিষয় ছিল না, কিন্তু একটি ব্যবসা কতটা সফল বা জনপ্রিয় তা তার নৈতিকতা বা আইন মেনে চলার নিশ্চয়তা দেয় না, এই ঘটনা সেই সত্যকে একদম স্পষ্ট করে দিয়েছে। গত দশ বছরে নিউ ইয়র্ক স্টেটে প্রায় ৩০টি ব্যবসা এক মিলিয়নের বেশি বকেয়া পরিশোধের নির্দেশ পেয়েছে। তবে ইন্ডিয়ান স্পাইসের কেস বিশেষভাবে নজিরবহীন। এর কারণ অভিযোগগুলোর ব্যাপকতা, দীর্ঘ সময় ও ইচ্ছাকৃততা বিষয়টিকে অস্বাভাবিকভাবে গুরুতর করেছে।

এই মামলার ফল এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে মালিকের ওপর, তিনি আপিল করবেন কিনা, কিংবা জরিমানা পরিশোধ করবেন কি না। আর যদি তিনি তা না করেন, তবে রেস্টুরেন্টটি বন্ধ হয়ে যাওয়া, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়া বা সম্পদ জব্দের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। পার্ক স্লোপের বাসিন্দা, গ্রাহক এবং ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের অনেকেই এজন্য বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে লিখছেন, জনপ্রিয়তা থাকা মানেই একটি রেস্টুরেন্ট নৈতিকভাবে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা নিশ্চিত নয়। ইন্ডিয়ান স্পাইসের ঘটনা তাই শুধু একটি রেস্টুরেন্টের শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ নয়, বরং এটি নিউ ইয়র্ক সিটির অভিবাসী শ্রমিকদের জীবন, শ্রম অধিকার, আইনি নিরাপত্তা, ব্যবসায়িক নৈতিকতা এবং সম্প্রদায়ের ভেতরের সম্পর্কের জটিল বাস্তবতা তুলে ধরে।

শেয়ার করুন