০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৫:৫৮:০১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


জাপানের টয়োটা সিটিতে একদিন
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১২-২০২৫
জাপানের টয়োটা সিটিতে একদিন পোর্ট অব টয়োটাতে লেখক


টোকিওর ভোর তখনো পুরোপুরি জাগেনি। শিনকানসেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে গরম কফির কাপ। অপেক্ষা করছিলাম আমার সঙ্গী-গাইড নিকিতার। ট্রেনের রেললাইনে হালকা কুয়াশা আর স্টেশনজুড়ে সেই চিরচেনা যান্ত্রিক নিখুঁত শৃঙ্খলা। নিকিতা এসে দাঁড়াতেই তার পরিচিত হাসিতে যাত্রার শুরুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আজ আমরা যাচ্ছি জাপানি প্রযুক্তির হৃদয় আইচি প্রি-ফেকচার, যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাতা টয়োটা মোটর করপোরেশনের জন্ম। আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি সাম্রাজ্য টয়োটার জন্মস্থান নিজের চোখে দেখার।

টোকিও স্টেশন থেকে নোজোমি শিনকানসেনে উঠতেই জানালার পাশে বসে নিকিতা জানাল, আজ তোমাকে শুধু একটি শহরই দেখাবো না, দেখাবো একটি দর্শন-ধৈর্য, কৌশল, প্রযুক্তি আর মানুষকে কেন্দ্র করে তৈরি এক সাম্রাজ্যের গল্প। জাপানের প্রযুক্তি বুঝতে গেলে আইচি দেখা জরুরি। তখনো বুঝিনি কতটা সত্যি কথা সে বলছে। দুই ঘণ্টার কম সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম নাগোয়া, আইচির প্রাণকেন্দ্রে। তারপর নাগোয়া থেকে ছোট ট্রেনযাত্রা করে পৌঁছলাম Toyota Commemorative Museum of Industry and Technology–এ। লাল ইটের পুরোনো কারখানার দেওয়ালের ভেতর ঢুকতেই নিকিতা ফিসফিস করে বললো, টয়োটা প্রথমে গাড়ি তৈরি করেনি, তৈরি করত তাঁতের যন্ত্র। জাদুঘরের বিশাল হলে স্বয়ংক্রিয় তাঁত যন্ত্রগুলো এখনো জীবন্ত হয়ে ওঠে-মৃদু শব্দে, নিয়মমাফিক চলতে থাকা কর্মশীলতার প্রতীক হয়ে। তারপরই দেখা মেলে গাড়ি তৈরির সেই কিংবদন্তি ইতিহাস-ইঞ্জিন, বডি, রোবটিক আর্ম আর টয়োটার বিখ্যাত lean manufacturing-এর সূক্ষ্ম সব প্রদর্শনী। নিকিতা বলে, টয়োটার আসল শক্তি-মানুষ। এখানকার প্রতিটি কর্মী নিজের কাজকে শিল্পীর মতো করে।

দুপুরের দিকে আমরা চললাম টয়োটা সিটি দেখতে। বিশাল সব কারখানা, পরীক্ষাকেন্দ্র আর এমন রাস্তা যেখানে ট্রাকের চেয়ে প্রকৌশলী বেশি। যদিও প্রধান অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টে নিয়মিত ট্যুর সীমিত। তার আশপাশে গড়ে ওঠা নগরীর উন্নত অবকাঠামো, পরিচ্ছন্ন রাস্তা আর নিখুঁত শিল্পশৃঙ্খলা দেখে বোঝা যায় কেন এ অঞ্চলকে বলা হয়, ‘Japans Industrial Heartland’। দুপুরের একটু পর আমরা টয়োটা সিটিতে পৌঁছলাম। এ যেন একটি শহর না-একটা স্পন্দিত শিল্পভূমি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গবেষণাগার, যন্ত্রপাতির মেলা, ট্রাকের সারি-সবকিছু এত সংগঠিত, এত নিখুঁত যে মনে হলো শহরটাই যেন এক যান্ত্রিক হৃদয়।

আমরা গলা ভেজাতে একটা ক‍্যাফেতে গিয়ে বসলাম। নিকিতা আমাকে শোনাচ্ছিল টয়োটা সাম্রাজ্যের ইতিহাস। ঊনিশ শতকের শেষদিকে ছোট এক কারিগর পরিবারের ভেতরে জন্ম নিলো একটা ধারণা, যা প্রথমে ছিল নিছক একজন মিস্ত্রির চেষ্টা, পরে হয়ে উঠলো বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোটিভ কোম্পানি। টয়োটা মোটর করপোরেশনের উত্তরণ আসলে প্রযুক্তির গল্পই নয়; এটা একজন বাবা ও ছেলের শ্রম, অধ্যবসায় ও দূরদৃষ্টির গল্প। নিকিতা জানায়, টয়োটা পরিবারের ইতিহাস শুরু হয়েছিল একটি তাঁত দিয়ে। ১৮৯০-এর দশক-জাপান তখন শিল্পবিপ্লবের প্রথম ধাপ পার করছে।

একজন মেধাবী ও নীরব স্বভাবের কাঠমিস্ত্রি ছিলেন সাকিচি টয়োদা (Sakichi Toyoda)। তিনি দেখতেন, তাঁতের কারখানায় নারীরা কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শরীর ভেঙে কাজ করছেন। তাদের কষ্ট, ভুল হলে সুতোর ছিঁড়ে যাওয়া-সবকিছু তার মনকে ব্যথিত করতো। একদিন তিনি নিজের ছোট ঘরে ভাবলেন-যদি তাঁত নিজেই নিজের ভুল ধরা বন্ধ করতে পারতো!

আর এই প্রশ্নই পৃথিবীটাকে বদলে দেয়। সাকিচি দিনের পর দিন কাঠ, ধাতু, দড়ি, যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা করতে থাকলেন। অবশেষে তিনি তৈরি করলেন, Toyoda Wooden Hand Loom। এটি ছিল তার প্রথম সফল উদ্ভাবন। তারপর এলো দ্বিতীয় জাত উদ্ভাবন- Automatic Loom, এমন একটি বুদ্ধিমান তাঁতযন্ত্র-যেখানে সুতো ছিঁড়ে গেলে যন্ত্রটি নিজে থেকে থেমে যায়, যাতে কাপড় আর নষ্ট না হয়। এই ভাবনার নাম পরে হয়-Jidoka (Autonomation) অর্থাৎ যন্ত্রের মধ্যে মানুষের মতো ‘জ্ঞান’ যুক্ত করা। এ দর্শন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, আজও টয়োটা কারখানার রোবটগুলো কাজ করে এই নীতিতে।

১৯২৯ সালে ব্রিটিশ টেক্সটাইল জায়ান্ট Platt Brothers সাকিচির অটোমেটিক তাঁত কিনে নিলো এক লাখ পাউন্ড দিয়ে। এটি শুধু একটা যন্ত্র বিক্রি ছিল না-ছিল টয়োটা সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ পুঁজির জন্ম। সাকিচি তার ছেলে কিশোর কিইচিরো টয়োদাকে (Kiichiro Toyoda) বললেন-এই অর্থ দিয়ে গাড়ি বানাও। গাড়ি আমাদের ভবিষ্যৎ। এই কথাই জাপানের অটোমোবাইল বিপ্লবের সূচনা হয়ে যায়।

কিইচিরো ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রকৌশলী। ১৯৩০-এর দশকে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন এবং দেখেন-গাড়ি ভবিষ্যতের পরিবহন। জাপানে তখন মাত্র হাতেগোনা গাড়ি। তিনি দেশে ফিরে এসে শুরু করলেন গবেষণা, ছোট ইঞ্জিন তৈরি এবং পরে Toyota Motor Corporation-এর ভিত্তি স্থাপন। ১৯৩৬ সালে কিইচিরো ও তার দল তৈরি করলেন Model A জাপানের প্রথম সফল যাত্রীবাহী গাড়িগুলোর একটি।

যুদ্ধের পর টয়োটা প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের কর্মীরা কোম্পানির পাশে দাঁড়াল। মানুষ ও ব্যবস্থাপনার পারস্পরিক শ্রদ্ধার ফলে টয়োটা আবার ঘুরে দাঁড়াল। এখান থেকেই টয়োটা তৈরি করে Lean Manufacturing, যা এখন বিশ্বের সব কারখানার পাঠ্যবই। একজন কাঠমিস্ত্রি ও তাঁত উদ্ভাবকের এক টুকরো স্বপ্ন থেকেই আজকের এই বৈশ্বিক সাম্রাজ্য। আমি তন্ময় হয়ে নিকিতার কাছ থেকে টয়োটার জন্ম কাহিনীর গল্প শুনছিলাম। এবার সে তাড়া দিয়ে বললো, চলো এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি আছে। নিকিতা আমাকে নিয়ে গেল একটি উঁচু পর্যবেক্ষণ স্থানে। সেখান থেকে দেখা যায় বিশাল Toyota Plant-এর অংশবিশেষ-অগডুত লাইন, অসংখ্য গুদাম, আর শ্রমিকদের ছোট ছোট চলাচল। সে বললো, এখানে প্রতিটি গাড়িই তৈরি হয় মানুষের চিন্তা, সময়, ভালোবাসা দিয়ে। তুমি যে গাড়ি চালাও তা শুধু ধাতু নয়, মানুষের গল্প বহন করে।

টয়োটা সদর দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে উঁচু ভবনগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল এখানে প্রতিদিন ভবিষ্যৎ তৈরি হয়। নিকিতা বললো, এখানে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করে। তুমি দেখলে অবাক হবে-টয়োটার সেরা শক্তি তার শ্রমিকরা। প্রযুক্তি যত উন্নত হোক, মানুষের হাত এবং মন ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। ফেরার সময় শিনকানসেনের জানালায় দূরের আলোয় ঝলসে উঠছিল কারখানা, ক্রেন, রেললাইন, আর নির্মাণাধীন ভবন। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম দূরে মিলিয়ে যাওয়া প্রযুক্তির শহরটির দিকে।

ফুজির ছায়ায় এক স্বপ্নময় দিন

জাপানের রাজধানী টোকিও এমন এক শহর যা প্রতিদিনই তীব্র ব্যস্ততার মাঝে দৌড়ায়। তবে শিনজুকু বাস টার্মিনাল থেকে হাইওয়ে বাসে উঠে মাত্র দেড় ঘণ্টা এগোলেই সেই ব্যস্ততা বদলে যায় শান্ত পাহাড়ি দৃশ্যে। এই পথেই আজ আমাদের গন্তব্য ইয়ামানাকা লেক, ফুজি ফাইভ লেকসের মধ্যে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত এবং সবচেয়ে নিরিবিলি হ্রদটি। শিনজুকু বাস টার্মিনালে পৌঁছতেই দেখি হালকা বাদামি কোট পরে, কফি হাতে নিকিতা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে সেই চিরচেনা উজ্জ্বল হাসি। যাত্রার শুরুতেই নিকিতা জানিয়ে দেয়, আজ আকাশ পরিষ্কার, ফুজিকে পুরোপুরি দেখা যাবে। বাস চলতে শুরু করলো। একটু পর শহরের চওড়া রাস্তাগুলো থেকে আমরা যেন এক সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে গেলাম- আকাশচুম্বী বিল্ডিংগুলো ছোট হয়ে গেল। গাড়ির ভিড় কমে এলো। দূরে দূরে ছোট ছোট সবুজ পাহাড় চোখে পড়তে লাগলো। নিকিতা জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললো, এই রাস্তাটাকে বলে জাপানের সবচেয়ে সুন্দর হাইওয়ে পথগুলোর একটা। কারণ এ পথেই প্রথমবার মানুষ ফুজিকে দেখতে পায়।

আমিও জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। হঠাৎ এক মুহূর্তে দূরের হালকা মেঘের ফাঁক থেকে উঠে এলো-মাউন্ট ফুজির মাথা। তুষার-ঢাকা সাদা রঙে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চূড়াটি এত নিখুঁত, এত শান্ত, এত অনড়-যেন প্রকৃতি নিজের হাত দিয়ে এঁকে রেখেছে। বাসের জানালা দিয়ে নিকিতা দেখালো, এটা সাগামিহারা এলাকা আরেকটু এগোলে আমরা কান্টো অঞ্চলের বাইরে চলে যাবো। তারপর ইয়ামানাশি।

বাসটি যখন পাহাড়ি অঞ্চলে ঢুকলো, জানালার বাইরে দৃশ্যটা বদলে যেতে লাগলো। শহরের কোলাহল মিলিয়ে গিয়ে একে একে দেখা দিলো ব্যস্ততাহীন ছোট জনপদ, চা-বাগান আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর পাহাড়ের রূপরেখা। নিকিতা জানালার বাইরে তাকিয়ে বললো, এ অঞ্চলটা ইয়ামানাশি আরেকটু পরই আমরা ফুজির ছায়ায় ঢুকে যাবো। বাস থেকে নেমে যখন ইয়ামানাকা লেকের কাছে পা রাখলাম, তখন সকালটা পুরোপুরি জেগে গেছে। চারপাশের নিঃশব্দ প্রকৃতি আমাদের স্বাগত জানালো। হাওয়া ঠান্ডা, কিন্তু কেমন যেন কোমল। লেকের জল একদম আয়নার মতো শান্ত-অবর্ণনীয় নীল। আর তার মাঝখানে পাহাড়ের রূপকথার রাজকন্যার মতো দাঁড়িয়ে আছে মাউন্ট ফুজি। নেমেই প্রথম যে জিনিসটা দেখলাম, লেকের পানি একদম স্থির। এক ফোঁটাও তরঙ্গ নেই। আর সেই নিস্তব্ধ পানির ভেতরে পুরো ফুজি উল্টো হয়ে প্রতিফলিত। নিকিতা বললো, এ সময়কে বলে Perfect Reflection Time। যারা পেশাদার ফটোগ্রাফার, তারা এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। নিকিতা মাউন্ট ফুজিকে পেছনে রেখে আমার ছবি তুলে দিতে চাইলো। আমি না করলাম। বললাম, থাক না-ক্যামেরায় ধরা পড়ে না-এমন কিছু দৃশ্য বেঁচে থাকুক জীবনে।

নিকিতা জানায়, এই লেকটিকে অনেকেই বলে ‘Mirror Lake of Fuji’-কারণ শান্ত দিনে ফুজির প্রতিফলন এত পরিষ্কার হয় যে, বাস্তব আর প্রতিফলনের মাঝে পার্থক্য বোঝা কঠিন। পর্যটক ভিড় তুলনায় কম হওয়ায় এ এলাকায় প্রকৃতি তার স্বাভাবিক, ধীর সৌন্দর্যে নিজেকে মেলে ধরে। নিকিতা বলে, যারা ভিড় এড়িয়ে নিস্তব্ধ সৌন্দর্য খোঁজেন, তারা কাওয়াগুচির চেয়ে ইয়ামানাকাই বেশি পছন্দ করেন।

আমরা ধীরে ধীরে বোর্ডওয়াক ধরে হাঁটতে লাগলাম। পায়ের নিচে কাঠের মসৃণ শব্দ, সামনে নীল লেক, আর অপর প্রান্তে ছবির মতো দৃষ্টিনন্দন গ্রাম। এই দৃশ্যটাকে ভাষায় বর্ণনা করা কোনো লেখকের পক্ষেই সম্ভব নয়- এটা উপভোগ করতে হয় হৃদয় দিয়ে, নিঃশব্দে। অনেকেই সাইকেল চালাচ্ছে, কেউ ধীরে নৌকায় ভাসছে, আর কেউ ছবি তুলছে ফুজির প্রতিটি ভঙ্গিতে। নিকিতা হঠাৎ থেমে বললো, এ জায়গাকে বলে ‘ফুজির আয়না’। পানি যখন শান্ত থাকে, ফুজি ঠিক আয়নার মতো ফুটে ওঠে।

নিকিতা জানায়, ইয়ামানাকা লেক টোকিও থেকে যতটা কাছে, তার সৌন্দর্য ঠিক ততটাই বিস্ময়কর। যারা দিনের ভ্রমণে শান্ত প্রকৃতি, পাহাড়, লেক আর ঐতিহ্যবাহী জাপানি গ্রাম দেখতে চান, তাদের জন্য এটি নিখুঁত গন্তব্য। ফুজির সর্বাধিক পরিষ্কার দৃশ্য দেখার ক্ষেত্রেও ইয়ামানাকা অন্যতম সেরা স্থান বলে মনে করেন স্থানীয়রা। লেকের পাশের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছলাম Hanano Miyako Park-এ। এটি একটি বিস্তীর্ণ ফুলের উদ‍্যান। গোনে দেখা গেল না কত রঙের ফুল। হলুদ, বেগুনি, গোলাপি, লাল রঙ যেন নিজেরাই একে অপরকে আলিঙ্গন করে এক বিশাল ফুলের ক্যানভাস তৈরি করেছে। পেছনে দাঁড়িয়ে তুষারাবৃত ফুজি। সামনে রঙিন ফুলের ঢেউ। মাঝখানে আমি আর নিকিতা হাঁটছি ধীরে ধীরে।

নিকিতা জানায় গ্রীষ্মে সূর্যমুখীর সমুদ্র, শরতে কসমস আর বসন্তে বিভিন্ন রঙের মৌসুমি ফুল-প্রতিটি মৌসুমেই পার্কটি ভিন্নসাজে সেজে ওঠে। পেছনে তুষারাবৃত মাউন্ট ফুজি আর সামনে ফুলের সমুদ-এমন দৃশ্য জাপানের পোস্টকার্ডেও খুব কম দেখা যায়। এ পার্কের সৌন্দর্য হলো এর প্রাকৃতিক খোলামেলা পরিবেশ-অতিরিক্ত নির্মাণ নেই, শুধু ফুল, আকাশ আর ফুজি। আমি বললাম, এত বিশাল বড় জায়গা। কিন্তু এক অদ্ভুত নীরবতা চারপাশকে ঘিরে রেখেছে। নিকিতা হাসলো। বললো, জাপান প্রকৃতি আর নীরবতা একসঙ্গে বাঁচাতে জানে। আমার মনে হলো- জীবনে যদি কখনো শান্তির সংজ্ঞা খুঁজতে হয়, তবে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে তা পাওয়া যায়।

এরপর আমরা গেলাম Oshino Hakkai-এ। এটা এমন এক গ্রাম যার সৌন্দর্য যেন কোনো পুরোনো কাঠের চিত্রপটে আঁকা। এখানকার পানি ফুজির বরফ গলে শত বছর ধরে পরিশুদ্ধ হয়ে তৈরি হয়। একটি পুকুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, জল এত স্বচ্ছ যে, নিচের শৈবাল, মাছ, পাথর-সবই স্পষ্ট, যেন সরাসরি হাতে ছুঁয়ে ধরা যায়। গ্রামটির ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঘর, খড়ের ছাদ ও ছোট সেতুগুলো পর্যটকদের অতীতের জাপানি পরিবেশের অনুভূতি দেয়। নিকিতা বললো, অশিনো হলো সেই জায়গা, যেখানে জাপানের অতীত এখনো বেঁচে আছে। এখানে একটি ছোট জেটিতে দাঁড়িয়ে নিকিতা আমার অনেকগুলি ছবি তুলে দিলো।

বিকেল গড়িয়ে পড়তেই আমরা আবার লেকের কাছে এলাম। এবার লেক আর ফুজি- দুইই যেন অন্যরকম রঙে সাজা। সূর্য ধীরে ধীরে ফুজির পেছনে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। আকাশের রঙ কমলা থেকে সোনালি, সোনালি থেকে লালচে-তারপর আবার হালকা নীল। ফুজির গায়ে নরম আলো পড়ছে, আর লেকের পানি সেই আলোকে ফিরিয়ে দিচ্ছে নিঃশব্দে।

আমি বললাম, এটা কি প্রতিদিন এমন হয়?

নিকিতা মাথা নাড়লো, না। ফুজি তার সৌন্দর্য কাউকে প্রতিদিন দেখায় না। আজ তুমি ভাগ্যবান।

সেই মুহূর্তে মনে হলো, আমিই যেন আজ ফুজির বিশেষ অতিথি।

আমরা দুজন অনেক্ষণ চুপচাপ লেকের ধারে বসে রইলাম। কখনো কখনো প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে শব্দের প্রয়োজন হয় না। মনে হচ্ছিল সম্ভবত আজকের সন্ধ্যাটা জীবনের সেরা সন্ধ্যাগুলোর একটি হয়ে থাকবে। বাস ধরার সময় হলো। ফুজিকে পেছনে রেখে চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না। বাস চলতে শুরু করল। জানালার বাইরে দেখা গেল, ফুজি ক্রমেই ছোট থেকে ছোট হচ্ছে, তারপর একসময় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

টোকিও উপসাগরের সকাল

সকালে টোকিওর আকাশটা ছিল নরম নীল। আমি হোটেলের লবি থেকে বের হতেই দেখি, গাইড নিকিতা আগেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার চিরচেনা হাসি। টোকিও স্টেশন থেকে আমরা ট্রেনে উঠলাম। জানালা দিয়ে সমুদ্রধারার শহরটাকে দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছালাম ওদাইবা। রেইনবো ব্রিজ ধীরে ধীরে আমাদের সামনে বড় হতে থাকে। নিকিতা জানালার দিকে ইশারা করে বলল, এই ব্রিজটায় রাতে আলো জ্বলে উঠলে পুরো উপসাগরটাই অন্য রূপ নেয়। আর পোর্টটা হচ্ছে একদম টোকিও শহরের ফুসফুস। এখান থেকেই প্রতি বছর লাখো পর্যটক টোকিওতে নামে। শহরের প্রথম অভ্যর্থনাটা হয় এই বন্দরেই। ট্রেন থেকে নামতেই ঠান্ডা সমুদ্রের হাওয়া আমাদের ছুঁয়ে গেল। দূরে কয়েকটা বিশাল কনটেইনার জাহাজ- ঘরের মতো উঁচু বক্সগুলো stacked করা। ক্রেনের ধাতব শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল কোনো অজানা সিম্ফনি বাজছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে লাগলাম টোকিও ইন্টারন‍্যাশনাল ক্রুজ টার্মিনালের দিকে। কাচের দেওয়াল ঘেরা আধুনিক ভবন। কাছে যেতেই দেখি, একটা বিশাল ক্রুজ জাহাজ নোঙর করা। যেন ছোটখাটো একটা ভাসমান শহর। আমি থেমে থেমে জাহাজটা দেখছিলাম, মানুষের কোলাহল নেই, কিন্তু সমুদ্রের গভীর গর্জন আছে। মনে হচ্ছিল এই জায়গা শুধু বাডুজ্যের নয়, গল্পেরও জন্মস্থান।

দুপুরে আমরা চলে এলাম Harumi Pier-এর দিকে। পথটা নীরব। পুরোনো পিয়ারের কাঠের ঘ্রাণ এখনো বাতাসে টিকে আছে। সমুদ্রের গা ছুঁয়ে হাওয়া আমাদের চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল। দূর থেকে বন্দরশহর টোকিওর স্কাইলাইন-টাওয়ার, সেতু, কলোসাল কার্গো জাহাজ, সব মিলিয়ে যেন একটা বিশাল পেইন্টিং। বিকেলের আলোয় আমরা হাঁটতে হাঁটতে গেলাম Oi Container Terminal-এর কাছে। বিশাল ক্রেনগুলো একেকটা হাতির মতো নড়ে, আর কনটেইনারগুলো ব্লকের মতো ওপরে ওঠে নিচে নামে।

এগুলোই টোকিওর জীবনরস, নিকিতা হেসে বললো। আমাদের খাবার, গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স-সবই এখান দিয়ে আসে। সমুদ্র নীরব হলেও বন্দর কখনো ঘুমায় না। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অবিরাম যন্ত্রপাতির কাজ দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন এক বিশাল জীবন্ত যন্ত্রের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। সূর্য ডুবতে শুরু করলে আমরা আবার ওদাইবা ঘাটে ফিরে আসলাম। রেইনবো ব্রিজ তখন কমলা আলোয় জ্বলছে। 

শিরাকাওয়া-গো : জাপানের জীবন্ত ঐতিহ্যের গ্রাম

গাইড নিকিতাকে বললাম, জাপানে এসে যতগুলো ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখেছি তার বেশিরভাগই ছিল মন্দির। আমি এবার বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত একটা গ্রাম দেখতে চাই। মৃদু হেসে সে জানালো, টোকিওর কাছেই বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রাম রয়েছে, যার নাম শিরাকাওয়া-গো। এটা দেখে দিনে দিনেই টোকিও ফিরে আসা যায়। আমি সানন্দে সম্মতি জানালাম। ভোরের টোকিও তখনো নিস্তব্ধ, শহরের হাইওয়ে জেগে উঠলেও আকাশে তখনো ঘুমের রঙ। আমি আর নিকিতা উঠলাম শিনকানসেনে-বুলেট ট্রেন ছুটলো বজ্রের মতো শিরাকাওয়া-গোর উদ্দেশে। নিকিতা এবার তার গল্পের ঝাপি খুলে বসলো। জাপানের গিফু প্রি-ফেকচারের পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম শিরাকাওয়া-গো। আধুনিকতার ভিড় থেকে দূরে এই গ্রাম আজও ধরে রেখেছে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য ও জীবনধারা। এ কারণে ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। শিরাকাওয়া-গোর প্রধান পরিচয় এর গাশ্‌শো-জুকুরি ঘর। এ ঘরগুলোর ছাদ খড় দিয়ে তৈরি এবং তীক্ষ্ণ ঢালু, দেখতে দু’হাত জোড় করে প্রার্থনার মতো। এ ধরনের ছাদ ভারী তুষার সহজে ঝরে যেতে সাহায্য করে, কারণ শিরাকাওয়া-গোতে শীতকালে প্রবল তুষারপাত হয়। ঘরগুলো ২৫০-৩০০ বছরের পুরোনো, একসময় এখানে একসঙ্গে একাধিক পরিবার বাস করতো। ঘরের উপরের তলায় রেশমচাষ হতো, নিচতলায় কৃষিকাজ ও দৈনন্দিন জীবনযাপন চলত।

চারদিক থেকে পাহাড়ে ঘেরা শিরাকাওয়া-গো প্রতিটি ঋতুতেই ভিন্ন রূপে সেজে ওঠে। শীতে ঘরগুলো সাদা বরফে ঢেকে যায়, মনে হয় যেন রূপকথার কোনো রাজ্য। বসন্তে চেরি ফুলে রঙিন হয় চারদিক। গ্রীষ্মে সবুজ ধানক্ষেত ঘিরে ধরে খড়ের ঘরগুলোকে। শরতে লাল-কমলা পাতায় গ্রাম সাজে যেন অগ্নিস্নাত স্বপ্নে। শিরাকাওয়া-গো কেবল একটি দর্শনীয় স্থান নয়, এটি এক জীবন্ত গ্রাম। আজও মানুষ এখানে পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখে বসবাস করে। পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত কয়েকটি বিখ্যাত ঘর রয়েছে, যেমন ওয়াদা হাউস (Wada House)-যা সবচেয়ে বড় গাশ্‌শো-জুকুরি ঘর। গ্রামে ছোট্ট চায়ের দোকান, স্থানীয় খাবারের রেস্তোরাঁ ও হস্তশিল্পের দোকান আছে। শীতে আয়োজন করা হয় বিশেষ ‘Light-up Festival’- তখন পুরো গ্রাম আলোয় সাজানো হয়, আর বরফ ঢাকা ঘরগুলো ঝলমল করে উঠে, যেন আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো জাদুর শহর। গল্পে গল্পে আমরা চলে এসেছি শহর থেকে বেশ দূরে। জানালার কাচে ক্রমেই শহরের আকাশছোঁয়া ভবনগুলি হারিয়ে যাচ্ছিল। পরিবর্তে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছিল সবুজ পাহাড়, নদীর ধারা আর ধানক্ষেত। মনে হচ্ছিল আমি আধুনিক জাপান থেকে সরে গিয়ে ধীরে ধীরে এক পুরোনো চিত্রপটে প্রবেশ করছি।

নাগোয়া পৌঁছে ট্রেন বদলাতে হলো। ওখানথেকে তাকায়ামার দিকে যাত্রা। তাকায়ামা নেমে বাস ধরলাম আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে। প্রতিটি বাঁকে মনে হচ্ছিল আমরা যেন আরো গভীরে চলে যাচ্ছি, ইতিহাসের এক গোপন গহ্বরে। জানালার বাইরে ধোঁয়াশামাখা বন, পাহাড়ের গায়ে মেঘের আঁচল, আর নদী যেন অনন্তকাল ধরে আমাদের সঙ্গী হয়ে ছুটছে। হঠাৎই গ্রাম এসে ধরা দিলো চোখে। খড়ের ছাউনি দেওয়া তীক্ষ্ণ ঢালু ছাদ, যেন দু’হাত জোড় করে প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে আছে। নিকিতা জানালো এগুলোকে বলে -গাশ্‌শো-জুকুরি ঘর। এর প্রতিটি কাঠের বিম আর প্রতিটি খড়ের গন্ধে শতাব্দীর গল্প জমে আছে। শীতে যখন তুষার নেমে আসে, এই ঘরগুলো হয়ে ওঠে পরীর দেশের দুর্গ, সাদা মায়াবী চাদরে মোড়া। গ্রামের গলিপথে হাঁটছিলাম। চারপাশে কাঠের দেওয়াল থেকে ধোঁয়া উঠছে, কোনো ঘরে হয়তো আগুনে ভাত বসানো। বাতাসে চালের গন্ধ, ডু কাঠ পোড়ার গাঢ় উষ্ণতা। মনে হচ্ছিল, আমরা এডো যুগের কোনো পথিক, রাত কাটাতে এই গ্রামে এসে থেমেছি। গ্রামের বুকে বয়ে চলা শিরো নদী যেন এক চিরন্তন গান গাইছে। সেতুর নিচে জলের ধারা ছুটে চলেছে, আর পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার সুর। কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, কোথাও পাখির ডানা মেলা-সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নীরব সিম্ফনি। শিরাকাওয়া-গোতে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, মানুষ আর প্রকৃতি এখানে আলাদা নয়, তারা একে অপরের পরিপূরক। একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে ঢুকলাম। বৃদ্ধা মালিক হাসিমুখে গরম মিসো স্যুপ আর ধোঁয়া ওঠা ভাত এগিয়ে দিলেন। বললেন-এখানে জীবন ধীর, কিন্তু শান্ত।

সন্ধ্যায় বাসে ফেরার সময় পাহাড়ের গায়ে সোনালি রোদ পড়েছিল। শিরাকাওয়া-গো তখন যেন শেষ আলোয় নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে। মনে হচ্ছিল- আমি একদিনের জন্য হলেও ইতিহাসের বুকের ভেতর হাঁটলাম, যেখানে সময় চলে না, কেবল বয়ে চলে নদী আর বাতাস। বাসে উঠে ফিরে তাকালাম পিছনে- গ্রামটা যেন এক কবিতার খাতা, আমি কয়েকটি পাতা উল্টে দেখলাম, তারপর আবার রেখে এলাম সময়ের বুকের ভেতর। (সমাপ্ত)

শেয়ার করুন