কুমো ভ্যালি ও কুমো ভ্যালিতে লেখক
টোকিওর শিনজুকু স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি, পাশে গাইড নিকিতা। তার কাঁধে ছোট ব্যাকপ্যাক, চোখে চেনা আত্মবিশ্বাস। আজ আমরা আকাশের একটু কাছাকাছি যাব, নাম ফুজি ফিফথ স্টেশন-হালকা হাসি দিয়ে বলল নিকিতা। আমি ভাবছিলাম, নিকিতার মতো একজন গাইড সঙ্গে থাকলে-পাহাড় ও গল্প বলে।
আমি বললাম, একদিনে গিয়ে একদিনে ফেরা.. খুব ছোট ভ্রমণ না?
নিকিতা হেসে বললো, সব ভ্রমণ দূরত্বে বড় হয় না। কিছু ভ্রমণ বড় হয় উচ্চতায়। আমি আর কথা বাড়াই না। নিকিতা জানায়, মাউন্ট ফুজির বুকের ওপর, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত ফুজি ফিফথ স্টেশন শুধু একটি বিশ্রামকেন্দ্র নয়, এটি ফুজির সঙ্গে মানুষের প্রথম গভীর পরিচয়ের জায়গা। এই স্টেশনটি বিখ্যাত মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, এখান থেকেই শুরু হয় মাউন্ট ফুজিতে আরোহণের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। প্রতি বছর হাজারো পর্বতারোহী এখান থেকেই শৃঙ্গজয়ের স্বপ্ন বুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। দ্বিতীয়ত, যারা শৃঙ্গে ওঠেন না, তাদের জন্যও এটি এক স্বতন্ত্র দর্শনীয় স্থান। পরিষ্কার দিনে এখান থেকে ফুজি ফাইভ লেকস এলাকা, উপত্যকা আর দূরের আকাশ-সবই চোখের সামনে মেলে ধরে। মেঘ এখানে আকাশে নয়, দর্শনার্থীর সমান উচ্চতায় ভেসে বেড়ায়।
তৃতীয়ত, ফুজি ফিফথ স্টেশন একটি আধ্যাত্মিক বিরতি। শতাব্দী প্রাচীন কোমিতাকে শবাইন (মন্দির), পর্বত আর প্রকৃতির নীরবতা-সব মিলিয়ে এই জায়গা শুধু ফুজি শুধু পাহাড় নয়, এটি অনুভূতির নাম। শিনজুকু স্টেশন থেকে সকালবেলার JR Ch Line (Rapid) ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছাড়তেই কংক্রিটের সারি জানালার বাইরে পিছিয়ে যেতে লাগলো। নাকানো, মিতাকা, তাকাও স্টেশনগুলো পার হতে হতে শহরটা ধীরে ধীরে গ্রাম হয়ে উঠলো। কাওয়াগুচিকো পৌঁছাতে পৌঁছাতে জানালার বাইরে দেখা দিল মাউন্ট ফুজির আভাস-কখনো মেঘে ঢাকা, কখনো স্পষ্ট, ঠিক যেন লাজুক কোনো প্রাচীন দেবতা। নিকিতা জানাল, ফুজি কখনো পুরোটা একসঙ্গে দেখায় না। ধৈর্য ধরতে শেখায়।
প্রায় দুই ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা নামলাম
Otsuki Station–এ। Otsuki থেকে আমরা ট্রেন বদল করে উঠলাম FujiKzu Railway-এর ছোট ট্রেনে। এটাই যেন প্রকৃতির দরজায় প্রথম পা রাখা। ছোট ট্রেন তবে বড় জানালা-চারপাশে পাহাড়, নদী আর খোলা আকাশ। আমরা নামলাম কাওয়াগুচিকো (Kawaguchiko) স্টেশনে। নেমেই মনে হলো, বাতাস বদলে গেছে। এখানে শহরের গন্ধ নেই-আছে জল আর পাহাড়ের মিশ্র শান্তি। শহরের শব্দ নেই, শুধু শান্তি আর হ্রদের ঝিলিমিলি।
স্টেশনের সামনেই বাস টার্মিনাল। সেখান থেকে আমরা উঠলাম Fuji Subaru Line 5th Station-bound বাসে। বাস যত উপরে উঠতে লাগলো চোখে পড়ছিল ঘন বন, আঁকাবাঁকা রাস্তা, আর হঠাৎ হঠাৎ মেঘ। মেঘের সমতলে দাঁড়িয়ে থাকা ফুজি ফিফথ স্টেশানে (5th Station) বাস থামলো।
বাস থামতেই নিকিতা আগে নেমে গেল। আমি একটু ধীরে নামলাম, যেন এই মুহূর্তটা তাড়াতাড়ি শেষ না হয়ে যায়। ফুজি এখানে আর দূরের কোনো নাম নয়, সে সামনে দাঁড়িয়ে, নিঃশ্বাসের দূরত্বে। এটাই ফিফথ স্টেশন, নিকিতা বলল, চারপাশে তাকিয়ে। তার গলায় গাইডের তথ্য নেই, আছে যেন ব্যক্তিগত পরিচয়ের উষ্ণতা। নিকিতা বল্লো-এখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়কে আর ‘দূরে’ মনে হয় না। মেঘ এখানে পথচারী, বাতাস কথা বলে কানে কানে।
ফুজি 5th Station‑এর খোলা চত্বরের ওপর পা রাখতেই মনে হলো, পৃথিবী যেন দুভাগে বিভক্ত-একটা নিচে শহরের আলো ও কংক্রিট, আর একটা আমাদের পায়ের নিচে, মেঘের সমান উচ্চতায়। মেঘগুলো কেবল আকাশে নেই; তারা এখানে, আমাদের চারপাশে, যেন সাদা শুঁড়ি ভরা নরম কটন। ফুজি এখানে আর দূরের পাহাড় নয়, সে আমাদের ঠিক সামনে, নিঃশ্বাসের দূরত্বে।
নিকিতা পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, এখান থেকেই মানুষ পাহাড়ে ওঠে। আবার এখানেই অনেকের ওঠা শেষ হয়। ফুজি ফিফথ স্টেশন তাই বিখ্যাত। কারণ এটি কোনো চূড়ান্ত গন্তব্য নয়, আবার নিছক পথের মাঝখানও নয়। এখান থেকে শুরু হয়-শৃঙ্গের দিকে সাহসী যাত্রা, আবার এখানেই থেমে দাঁড়িয়ে মেঘের সমান উচ্চতায় পাহাড়কে কাছে পাওয়ার সাহসও জন্ম নেয়। পরিষ্কার দিনে নিচে হ্রদ আর উপত্যকা দেখা যায়; মেঘের দিনে চারপাশ জুড়ে থাকে সাদা নীরবতা। এখানে আকাশ মাথার ওপরে নয়, ধরা দেয় চোখের সামনে।
নিকিতা চারপাশে তাকিয়ে আস্তে বলল, এখান থেকেই মানুষ ফুজিকে শুধু দেখে না, অনুভব করে। এখান থেকেই বেশিরভাগ মানুষ শৃঙ্গে ওঠা শুরু করে। কিন্তু আজ আমাদের গন্তব্য এই জায়গাটাই। পায়ের তলে মেঘ, চারপাশে নীরবতা। শীতল বাতাস, নরম মেঘের স্পর্শ, দূরে লেকের ঝলমল পানি সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল একটা স্বপ্নের মধ্যে আছি।
আমি হাত দুটো জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে বললাম, এত উঁচুতে এসে হঠাৎ ভয় লাগছে।
নিকিতা হেসে ফেললো, ফুজির কাছে সবাই একটু ভয় পায়। না হলে ফুজির সঙ্গে প্রেম হয় না। আমি তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। এই পাহাড়ি বাতাসে, এই নীরবতায় নিকিতার হাসিটা অদ্ভুতভাবে উষ্ণ। আমরা ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে কোমিতাকে শ্রাইনের কাছে যাই। নিকিতা বললো, শত শত বছর ধরে মানুষ এখানে এসে প্রার্থনা করেছে। কেউ শৃঙ্গে ওঠার জন্য, কেউ জীবনের ভার নামাতে।
আমি বললাম, একজন গাইড হিসেবে তুমিও তো অসংখ্যবার এখানে আসো-কী প্রার্থনা করো?” নিকিতা একটু ভেবে নিয়ে বললো, যেন সব ভ্রমণ এমন সুন্দর হয়। আর ভ্রমণ সঙ্গীটা যেন ভালো হয়। আমি হালকা খুনসুটির সুরে বললাম, তার মানে আজকের সঙ্গীটা খারাপ তাই না? সে হাসতে হাসতে বললো, আজকের সঙ্গীটা পাহাড়ের মতোই ভারী। আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম। মনে হলো, আমাদের এই হাসিটা যেন ফুজি পর্বতে গিয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে। আমরা দুজন কোমিতাকে শ্রাইনের সামনে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। এই শ্রাইনটি শতাব্দী ধরে মানুষ আর পাহাড়ের নীরব কথোপকথনের সাক্ষী। হয়তোবা আমাদের দুজনের কথোপকথনেরও স্বাক্ষী হয়ে থাকলো।
চারদিকে শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ আর দূরের উপত্যকার নীরবতা। পাহাড়ের ঢাল ধরে চোখ ঘুরিয়ে দেখি, দূরে কাওয়াগুচিকো (Kawaguchiko) লেক ঝলমল করছে, হালকা সূর্যের আলোতে। তার পানি যেন সোনালি লালিমায় ভাসছে। অন্যদিকে কিছু অংশ মেঘে ঢাকা, যেন লুকোচুরি খেলছে। নিকিতা কোমিতাকে শ্রাইনের দিকে ইশারা করে বললো, প্রতিটি পর্যটক শৃঙ্গে ওঠার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু যারা দাঁড়ায় এখানে, তারা শৃঙ্গের হৃদয় অনুভব করে। আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। চোখের সামনে বিস্তর্ঢু দৃশ্য। শব্দ নেই, শুধু বাতাসের নরম ফিসফিসানি, মেঘের নরম স্পর্শ। একটু পরে একটা কফি শপে ঢুকলাম। এক কাপ গরম কফি হাতে নিয়ে জানালার পাশে বসে দেখি-
মেঘ সরে গেলে নিচে লেক, আবার ঢেকে গেলে শুধু সাদা। কাচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো মেঘের ভেতর দিয়ে কখনো পাহাড়, কখনো হ্রদ উঁকি দিচ্ছে। আমরা দুজন চুপচাপ বসে থাকি। হাতের কাপে গরম কফি, চোখের সামনে বিস্তর্ঢু দৃশ্য। বিকালের আলো ফিকে হতে শুরু করলে নিকিতা বলল-চলো, এবার ফিরতে হবে। আর ফুজির সামনে অন্ধকার নামার আগেই।
আমরা বাসে চড়ি, ফিরে চলি শহরের দিকে। বাস নামতে নামতে মনে হলো, আমরা শুধু পাহাড় থেকে নামছি না, একটা অনুভূতিও সঙ্গে নিয়ে ফিরছি। কাওয়াগুচিকো স্টেশন থেকে আবার টোকিওর ট্রেন ধরলাম। এক সময় শহরের আলো পড়লো ট্রেনের জানালায়। কিন্তু আমার মন তখনো মেঘের ভেতরে। একদিনে গিয়ে একদিনে ফেরা। অল্প কিছুটা সময় তবু কিছু কিছু মুহূর্ত চিরকাল স্মৃতি রেখে যায়। কিছু যাত্রা শেষ হয় না। তারা শুধু নীরবে থেকে যায়, মেঘের সমান উচ্চতায়।
রাতের টোকিও তখন আলোয় ভরা। কিন্তু মেঘের ভেতর ফুজি 5th Station আমার ভেতরে জ্বল জ্বল করছিল। মনটা পরেছিল একটু ওপওে মেঘের কাছাকাছি কোথাও।
তোয়ালের শহর-ইমাবারি
জাপান ভ্রমণ মানেই ইতিহাস, প্রকৃতি আর শিল্পের অপূর্ব সমন্বয়। সেই শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ-ইমাবারি তোয়ালে, বিশ্বের অন্যতম সেরা মানের কটন তোয়ালে। টোকিওর হৃদয় থেকে শিকোকুর ছোট্ট শান্ত শহর ইমাবারিতে গেলে অনুভব করা যায় জাপানের কারুশিল্প কতটা নিখুঁত, কতটা মানবিক। ১২০ বছরের ইতিহাস, অসাধারণ মান আর মানুষের আন্তরিক হাতে তৈরি এই তোয়ালের গল্প দেখতে আমরা রওনা দিলাম টোকিও থেকে। আমার সঙ্গী গাইড নিকিতা। সকালে টোকিও স্টেশনে আমরা উঠলাম Nozomi Shinkansen-এ। নিকিতা জানালার দিকে তাকাতে তাকাতে বলল, ইমাবারির তোয়ালে শুধু পণ্য নয়, এটি মানুষের শ্রম আর ভালোবাসার বুনন।
ওকায়ামা স্টেশনে নেমে আমরা জেআর লাইন ধরে যাত্রা শুরু করলাম Shimanami Kaido-র দিকে-দ্বীপগুলোর ওপর দিয়ে ছুটে চলা এক বিস্ময়কর রেলপথ। সমুদ্র, ছোট দ্বীপ আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেতুর বিশাল বাঁক-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমরা যেন কোনো ক্যানভাসের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছি। নিকিতা মৃদু হেসে বললো, এ পথই ইমাবারিকে জাপানের বিশ্ব দরজা হিসেবে পরিচিত করেছে।
ইমাবারিতে পৌঁছে আমরা গেলাম বিশ্বের সবচেয়ে বড় তোয়ালের প্রদর্শনী কেন্দ্র- Imabari Towel Museum of Art দেখতে। ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো রঙিন ঢেউ আমাকে ঘিরে ধরেছে। সাদা, নীল, প্যাস্টেল, ফুলেল-প্রতিটি তোয়ালের আলাদা গন্ধ আর আলাদা স্পর্শ। নিকিতা বললো, প্রতিটি তোয়ালে তৈরির আগে mineral-rich soft water দিয়ে ধোয়া হয়, যা তুলোর নরমত্ব বজায় রাখে। তোয়ালে বাজারে ছাড়ার আগে পাস করতে হয় এক বিশেষ পরীক্ষায়-Water Droplet Test। পানির ফোঁটা তোয়ালে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে ভিজে যেতে হবে। ১২০ বছরের পুরনো কারুশিল্প, যেখানে হাতে বোনা সূক্ষ্ণতা আজও শিল্পের মর্যাদা ধরে রেখেছে। মিউজিয়ামের একটি অংশে আমরা দেখলাম কারিগররা কীভাবে রঙ তৈরি করেন, কীভাবে সুতো বোনা হয়।
নিকিতা জানায়, ইমাবারি তোয়ালেকে তারা শুধুই পণ্য হিসেবে দেখে না-এটি তাদের ঐতিহ্য, গর্ব, পরিচয়। কারিগরেরা একে বলেন-“A towel that begins with heart, and ends with trust.” নিকিতা আমাকে একটি স্থানীয় বাজারে নিয়ে গেলো। দোকানগুলোতে ইমাবারির নরম তোয়ালে সারি সারি সাজানো। হাতের ছোঁয়াতেই বলে দেওয়া যায় এর মান কতটা উন্নত। টোকিও থেকে ইমাবারি-এই যাত্রা শুধু কারখানা দেখা নয়, এটি ছিল শিল্পের গল্প, এক শহরের নরম ঐতিহ্য এবং একটি তোয়ালের ভেতর লুকানো যত্ন আর ভালোবাসা অনুভব করার অভিজ্ঞতা। নিকিতার সঙ্গ এই ভ্রমণকে আরো গভীর, আরো মানবিক, আরো স্মরণীয় করে তুলেছিল।
আকাশে তখন বিকালের শেষ আলো। সূর্যটা ধীরে ধীরে নামছে শহরের উঁচু ভবনের আড়ালে। আমি আর নিকিতা টোকিও ফিরছি হৃদয়ে জমে থাকা অগণিত স্মৃতির ভার নিয়ে। আমার পাশে বসা নিকিতা। হঠাৎ আস্তে করে সে একটি ছোট প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। ঠোঁটে মৃদু উচ্চারণ- For you, from Japan.
ব্যাগ খুললাম। ভেতরে একটি তোয়ালে। সাদা, নরম, মেঘের মতো হালকা। কোণায় ছোট্ট নীল-লাল লোগো, যেন জাপানের পতাকারই ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। নিকিতা বললো, তোমার জন্য এই ইমাবারি তোয়ালেটা কিনেছিলাম। নিকিতা সর্বক্ষণ আমার পাশেই ছিল। কিন্তু কোন ফাঁকে এটা কিনে নিলো আমি টেরই পাইনি। আমি অনুভব করলাম, এই তোয়াল কেবল কাপড় নয়, এ যেন এক দেশের বিনয়, এক নারীর স্নিগ্ধতা, এক বিদায়ের উষ্ণ স্মারক।
আমরা ততক্ষণে টোকিওর কাছে চলে এসেছি। জানালার বাইরে টোকিওর আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে। আমার কোলে রাখা তোয়ালটি তখনও গরম, নিকিতার হাতের উষ্ণতায় ভেজা। নিকিতার চোখে এক মৃদু দীপ্তি। আমি অনুভব করলাম, এই তোয়াল যেন শুধু তুলো নয়-এতে আছে এক দেশের নীরব শিষ্টাচার, এক নারীর স্নিগ্ধ উপহার আর এক ভ্রমণের মৃদু সমাপ্তি। আমার ভেতরে এক অদ্ভুত নীরবতা।
মনে হচ্ছিল, এই তোয়াল যেন আমার ভ্রমণের সব গল্প জানে-শিনজুকুর রাত্রি, নারার হরিণ, কিয়োটোর প্রাচীন মন্দির, আর এক সাগানো বনের নরম বাতাস। ভাবলাম,জাপানকে আমি পেছনে ফেলে যাচ্ছি। কিন্তু তার সংস্কৃতি, তার বিনয়, তার স্পর্শ-এ ছোট্ট তোয়ালটার মধ্যে ভাঁজ হয়ে থেকে যাবে আমার সঙ্গে। আমি জাপানকে ফেলে যাচ্ছি, কিন্তু জাপান আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে না। এই তোয়ালটার মধ্যে আছে এক দেশের শিষ্টাচার, এক মানুষের কোমলতা, আর এক ভালোবাসা, যার ভাষা বোঝার জন্য অনুবাদ লাগে না। কিছু উপহার শুধু বস্তু নয়, সেগুলো স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকে-স্পর্শে, গন্ধে, আর হৃদয়ের গভীরে।
ওজে ন্যাশনাল পার্ক
টোকিও থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে বিস্তৃত এমন এক নৈসর্গিক ভূখণ্ড রয়েছে, যার নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে জাপানি প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলনের গোড়াপত্তনের কথা মনে পড়ে। সেই ভূখণ্ডই ওজে ন্যাশনাল পার্ক-জলাভূমি, পাহাড়, হ্রদ ও বনভূমির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিশাল এক প্রাকৃতিক নাট্যমঞ্চ। টোকিওর ব্যস্ত রাস্তায় তখন ভোরের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। শহরটা যেন আধঘুমে-মেট্রো লাইনের ওপর ধোঁয়াটে ঠান্ডা বাতাস, আর দূরে কোনো এক রাস্তায় কারো কফির গন্ধ ভেসে আসছে। ঠিক এমন এক সকালের প্রথম ট্রেনে আমি আর নিকিতা চেপে বসলাম Oze National Park –এর পথে। ট্রেনটা যখন ধীরে ধীরে শহরের কংক্রিট থেকে বেরিয়ে গুনমার দিকে এগোয়, বাইরে দৃশ্য পাল্টাতে থাকে দ্রুত। ধূসর দেওয়ালের বদলে দেখা দেয় পর্বতের ছায়া-কখনও সবুজ, কখনও কুয়াশায় ঢাকা নদী, খেত, ছায়া-ঢাকা ছোট ছোট গ্রাম। একসময় পাহাড় ঘনিয়ে এলো। আর ট্রেন যেন এক অদৃশ্য সুতোয় টেনে নিয়ে যেতে লাগলো আমাদের সেই অদেখা পৃথিবীর দিকে।
বাইরে বাতাস যতই ঠান্ডা হচ্ছিল, ট্রেনে তত উষ্ণ হচ্ছিল নিকিতার গল্প। সে জানায়, ১৯৪০-এর দশকে একবার স্বপ্ন দেখা হয়েছিল-এ পর্বতের বুক চিরে বাঁধ বানানো হবে, বিদ্যুৎ তৈরি হবে। কিন্তু হাজার মানুষ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে বলেছিল ‘না’। তাদের কেউ ছিল ছাত্র, কেউ সাংবাদিক, কেউ নিঃশব্দ প্রকৃতিপ্রেমী.. তারা বলেছিল-ওজের নীরবতা ভাঙা যাবে না। নিকিতা বলে, ওজে পৃথিবীর সেই বিরল জায়গাগুলোর একটি, যা মানুষ রক্ষা করেছে লড়াই করে। আজ তুমি যখন সেখানে হাঁটবে, তোমার প্রতিটি পায়ের আওয়াজ সেই লড়াইয়ের স্মৃতি বয়ে নিয়ে যাবে। লক্ষ্য করছিলাম, কথা বলার সময় তার চোখে আলো ঝলমল করছিল।
নিকিতা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, Oze is not a place… its a feeling. When people fought to protect this land, they were actually fighting for silence. Numata স্টেশনে নেমে বাস ধরি Hatomachi-togo পর্যন্ত। আরেক দফা পাহাড়ি পথ, বাইরে তখন সূর্য পাহাড়ের গা বেয়ে উঠছে, যেন আমাদের সামনে সোনার দরজা খুলে দিচ্ছে। বাস পাহাড়ের কোল ধরে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। জানালা খুলতেই ঠান্ডা বাতাস মুখে এসে আঘাত করল, যেন পাহাড়রা আমাদের আগমনে সজাগ হয়ে উঠেছে। নিকিতা আমার হাত ছুঁয়ে বললো, শুনছো? পাহাড় আমাদের ডাকছে! সেই স্পর্শের মধ্যে ছিল রোদমাখা পাহাড়ি বাতাসের মতো উষ্ণতা। বাস পাহাড়ি পথ ধরে যত ওপরে উঠছিল, বাইরের দৃশ্য তত পাল্টাচ্ছিল। কখনো নিচে গভীর উপত্যকা, কখনো পাইন গাছের সারি, আবার কখনো মনে হচ্ছিল আকাশই পথকে ছুঁয়ে ফেলেছে। Hatomachi-toge এসে নামতেই শীতল হাওয়া আমাদের স্বাগত জানালো। চোখের সামনে তখন গাছের সারি, কুয়াশায় ভেজা পথ আর দূর পাহাড়ের ওপর হালকা রোদের ঝিলিক। নিকিতা চলতে চলতে বললো, এখানে আগে যে বাঁধ বানানো হচ্ছিল, এটা তৈরি হলে এই দৃশ্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেত। মানুষ লড়াই করে বাঁচিয়েছে এটা। আমাদের সামনে দাঁড়ানো এই সৌন্দর্যটা কারো হাতের দান নয়, সংগ্রামের ফল। তার কণ্ঠে তখন গর্ব।
নিকিতা বোর্ডওয়াকের শুরুতে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাল। বললো, এই পথটায় গাড়ি চলে না। আমাদের হাঁটতে হবে। বনের কিনারায় কাঠের বোর্ডওয়াক প্রসারিত হয়ে আছে। পথে ঝরা পাতার ওপর নরম আলো পড়ে আছে, আর চারদিকের গাছগুলো যেন মাথা নত করে পথ দেখাচ্ছে। আমরা হাঁটতে লাগলাম বোর্ডওয়াক ধরে। ঘাস দুলছে..পাখি ডেকে উঠছে..মাটি ভেজা..। বোর্ডওয়াক ধরে এগোতেই বাতাসে ঘাসের গন্ধ, জলাভূমির স্যাঁতসেতে সুবাস, আর দূরে কোনো অচেনা পাখির ডাক-সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত, অবর্ণনীয় আবেশ তৈরি করছিল। নিকিতা থেমে ঘাসে হাত ছুঁইয়ে বললো, এখানে প্রতিটি শীত, প্রতিটি বসন্ত, প্রতিটি শরৎ-প্রকৃতি নিজের শরীর বদলায়। আর মানুষ শুধু দেখার সুযোগ পায়।
আমি দেখতে লাগলাম মাটির কাছাকাছি ছড়িয়ে থাকা শুকনো mizubash ফুলের চিহ্নগুলো। বসন্তে এগুলো নাকি পুরো জলাভূমি সাদা করে দেয়, ফুলের আলোয়। আকাশে মেঘ ভেসে যাচ্ছে দ্রুত। দূরের পাহাড়গুলো মনে হচ্ছে জেগে উঠছে, তাদের মাথায় রোদের আলো লেগে লাল হয়ে উঠছে। ওজের নীরবতা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। ওজে নীরবতা মনকে ছুঁয়ে যায়। নিকিতা সবুজ ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসলো। বললো, এখানে দাঁড়ালে মানুষ কথা ভুলে যায়। প্রকৃতির এমন নীরবতা.. শব্দকে অপ্রয়োজনীয় করে দেয়। আমিও তার পাশে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ একটা হাওয়া এসে নিকিতার চুল উড়ালো। সে চুল সরাতে গিয়ে আমার দিকে তাকাল। দৃষ্টি থামলো। কিন্তু কিছু বলা হলো না। চোখের ভিতরে তখন দুই জগতের মধ্যকার এক সূক্ষ¥ সেতুবন্ধন বয়ে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে নিকিতা গাইড নয়, গল্প হয়ে উঠলো।
এরপর আমরা পৌঁছালাম হ্রদের কাছে। Ozenuma Lake। হ্রদের ওপর টানা সাদা কুয়াশা। কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের ছায়া দেখা যায়। ঝিলের ওপর মৃদু ঢেউ এসে নরম আলো ভেঙে দেয়। দূর থেকে মনে হলো-একটা সোনালি সমুদ্র নীরবে পড়ে আছে পাহাড়ের বুকে। শীতের হাওয়া ঘাসগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুলিয়ে দিচ্ছে-মনে হচ্ছিল যেন সোনার ঢেউ উঠছে নামছে।
হ্রদ পেরোতেই পাহাড়ের দিকে ওঠা শুরু। শরতের সোনালি রং আর ছায়া-ঢাকা পথ-সবই একটা চমৎকার দৃশ্যপট তৈরি করেছিল। মাঝপথে উঠে আমরা দাঁড়ালাম এক ভিউপয়েন্টে। সেখান থেকে পুরো ওজেহারা জলাভূমি দেখা যাচ্ছিলো। পাহাড়ের গায়ে আঁকা ছায়া। দিগন্ত জোড়া সোনালি ঘাস। জলাভূমির বুকে বাঁকানো বোর্ডওয়াক। আর ওপরে নীল আকাশ। নিকিতা দূরে সামনে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। বললো, জানো-মানুষ পাহাড়ে ওঠে পৃথিবীকে দেখার জন্য। কিন্তু শেষে বোঝে-সেও পৃথিবীর খুব ছোট্ট অংশ। আমি তার এই দার্শনিক কথা শুনে হাসলাম। ফেরার সময় সূর্যের শেষ আলো পাহাড়ের গায়ে পড়ে রং বদলাচ্ছিল। রাস্তার পাশের বনাঞ্চলগুলি অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। হাঁটার পথে নিকিতা কোনো কথা বলছিল না। তবু মনে হচ্ছিল তার নীরবতা কথা বলছে-খুব নরম, খুব শান্ত, খুব গভীর ভাষায়। টোকিওতে ফেরার সময় দূর থেকে শহরের আলো চোখে পড়ছিল। কিন্তু আমার ভিতরে তখনো ওজেহারার সোনালি নীরবতা, ওজেনুমার কুয়াশা, আর নিকিতার সেই স্থির চোখ দুটি ঝিলমিল করছিল।
হাজার ঘরের শহর, নারাই-জুকু (Narai-Juku)
টোকিওর ব্যস্ত সকালের আলোয় যখন শিনজুকু স্টেশনে পৌঁছালাম, তখনও শহরটা পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। হাতে ছিল ছোট ব্যাকপ্যাক, আর মনে ছিল বহুদিনের স্বপ্ন-এডো যুগের “হাজার ঘরের শহর” Narai-Juku দেখতে যাওয়া। সকালের টোকিও যেন প্রতিদিনই আমাকে নতুন কোথাও ডাক দেয়। কিন্তু সেদিন ডাকটা ছিল একটু অন্যরকম-সময়ের ডাক। এডো যুগের ইতিহাস, কাঠের পুরনো ঘর, নীরব পাথুরে রাস্তা আর পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা সেই কিংবদন্তি “হাজার ঘরের শহর”-নারাই-জুকু। আমার সঙ্গে ছিল সবসময়ের মতো সেই অদ্ভুত শান্ত অথচ প্রাণোচ্ছ্বল গাইড নিকিতা। তার চোখের উজ্জ্বলতা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল-আজ আমরা সত্যিকারের Japan -এর হৃদয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।
টোকিওর শিনজুকু রেল স্টেশন। সকালের বাতাস কফির ঘ্রাণে ভরপুর। নিকিতা আমাকে একটা উষ্ণ হাসি দিয়ে টিকেট এগিয়ে দিলো Limited Express Azusa-তে উঠলেই Nagano-এর পথে। আজ তুমি আমার সঙ্গে খুঁজে পাবে Edo Japan। ট্রেন ছুটে চলতেই শহর ফিকে হয়ে গিয়ে জায়গা নিল নদী, পাহাড়, সবুজ উপত্যকা। নিকিতা জানাল, Narai-juku ছিল Nakasend রুটের সবচেয়ে বড় পোস্ট-টাউন-মানুষ একে ডাকত Naraiji of One Thousand Houses হাজার ঘরের শহর।
শুনেই যেন বুকের ভেতর ইতিহাসের দরজা খুলে গেল। ট্রেন Shiojiri পার হয়ে পাহাড় আর বন আরো ঘন হয়ে উঠলো। Narai Station-এ নামতেই মনে হলো-সময়টা যেন আচমকা পিছিয়ে গেল ২০০ বছর। যেদিকে তাকাই সারি সারি একই রকম কাঠের বাড়ি, কালো লঙ্কার কাঠ, খোলা বারান্দা, ঝুলন্ত কাঠের লণ্ঠন। নিকিতা ফিসফিস করে বললো, প্রতিটি বাড়িই এডো যুগের অক্ষত স্মৃতি। ২০০ বছর আগের মানুষ আজো যেন এখানেই হাঁটে। রাস্তাগুলো এত পরিষ্কার, এত পুরোনো অথচ এতো সুন্দও মনে হচ্ছিল যেন একটি লাইভ মিউজিয়ামে হাঁটছি। সুবাস আসছিল কাঠ আর ল্যাকারওয়্যার দোকানগুলো থেকে। পুরোনো স্যুভেনির, ল্যাকারের বাটি, চায়ের ট্রে-সবই হাতে বানানো। নিকিতা আমাকে নিয়ে গেল একটি পুরোনো চায়ের দোকানে। ছোট কাঠের টেবিলে গরম চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছিল। জানালার বাইরে ছিল একদম নিস্তব্ধ Edo Japan। এ শহর একসময় এক হাজার ঘরের শহর ছিল। ব্যবসায়ীরা, যাত্রী, সামুরাই-সবাই এখানে থামত। নিকিতা বললো।
চা চুমুক দিতে দিতে অনুভব করলাম, টোকিওর দৌড়ঝাঁপকে পিছনে ফেলে ইতিহাস যেন আমার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছে। চা পর্ব শেষ আমরা হাঁটতে হাঁটতে বের হলাম সেই পুরোনো Nakasend পথের দিকে। রাস্তার দুপাশে পাহাড়, ওপর দিয়ে কাঠের ব্রিজ, নিচে ছোট ঝর্ণা-একটা রূপকথার বই যেন চোখের সামনে খুলে যাচ্ছিল। নিকিতা বলল, এক সময় Kzoto থেকে Edo পৌঁছাতে মানুষ এই পথ ধরে শত শত মাইল হাঁটতো। Narai ছিল সেই ক্লান্ত যাত্রীর সবচেয়ে বড় বিশ্রাম স্থান। আমি তাকে বললাম, নিকিতা, এই শহরটা মানুষকে কীভাবে এত নিঃশব্দে ২০০ বছর পেছনে নিয়ে যায়? সে হেসে বললো, হাজার ঘরের শহর তার গল্প কখনো বদলায় না, তাই মানুষ আজও আসে।
বিকালের আলো যখন কাঠের ঘরগুলোতে নরম সোনালি রঙ ছড়িয়ে দিলো, শহরটার সৌন্দর্য যেন আরো গভীর হলো। লণ্ঠনগুলো জ্বলে উঠতেই পুরো রাস্তাটা হয়ে গেল এক জাদুময় দৃশ্য। আমি নিকিতাকে বললাম, এ যেন সত্যি হাজার ঘরের আলোর শহর। সে তাকিয়ে রইলো পাহাড়ের দিকে। বললো, জাপানের ইতিহাস বোঝার জন্য Narai-juku-এর মতো আর কোনো জায়গা নেই। ট্রেনে টোকিও ফিরছিলাম। জানালার বাইরে অন্ধকার পাহাড়গুলো মিলিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মন ভরা ছিল কাঠের ঘরের গন্ধ, চায়ের উষ্ণতা আর ইতিহাসের ফিসফিসানি।
জাপানের খাদ্য স্বর্গে এক সকাল
টোকিওর ভোর যেন সব সময় একটু নরম আলোয় শুরু হয়। সেই আলোয় আমি আর নিকিতা মেট্রোতে উঠলাম, গন্তব্য Tsukiji Outer Market, যাকে বলা হয় জাপানের খাদ্যস্বর্গ। জায়গাটি টোকিও থেকে হিবিয়া লাইনে কয়েক স্টপের পথ। মেট্রো স্টেশন থেকে বের হয়ে একটু হাঁটতেই সরু গলিগুলো চোখে পড়ে। দোকানগুলো সবে শাটার তুলতে শুরু করেছে। বাতাসে ভেসে আসছিল মৃদু সমুদ্রের গন্ধ আর সকালের টাটকা মাছের সুবাস।
একটি ছোটো সুশি বারের সামনে নিকিতা আমাকে নিয়ে গেল। বসার জন্য ছয়-সাতটা টুল। কাউন্টারের ওপরে শেফের দ্রুত হাত। নিকিতা টাটকা টুনা নিগিরি অর্ডার দিতেই দ্রুত তা হাজির হলো টেবিলে। মুখে দিতেই মনে হলো-টোকিওর পুরো সকালটাই যেন আমার জিভে নেচে উঠলো। নিকিতা বললো, এখানকার সুশি মানেই ভোরের সমুদ্রের গল্প। গলি ধরে হেঁটে যেতে যেতে আমরা পেলাম বিখ্যাত তামাগোইয়াকি-মিষ্টি ডিম। কাঠির মাথায় গরম গরম ডিমের নরম টেক্সচার চিবোতে চিবোতে নিকিতা চোখ বড় করে বলল, এটা না খেলে Tsukiji আসাই ধরা হয় না! আরেক দোকানে গিয়ে আমরা খেলাম বাটার-গ্রিলড স্ক্যালপ-বাষ্প উঠছে, রস টুপটুপ করে পড়ছে, আর সমুদ্রের ঘ্রাণ যেন ঠিক সামনে।
Tsukiji Outer Market শুধু খাবারেরই নয়-রান্নার জগতের এক স্বর্গ। ছুরি, গ্রিল, সয়া সস, বিশেষ চা, শুকনো মাছ, মসলা-প্রতি দোকানেই যেন জাপানি সংস্কৃতির কাঁচা গন্ধ। গোলমাল আর গন্ধে ভরা বাজারের শেষে একটি শান্ত চায়ের দোকানে বসে আমরা গরম গ্রিন টি খেলাম। বাইরে সূর্য উঠছে, ভিড় বাড়ছে, আর আমরা রওয়ানা দিলাম টোকিওর পথে।
কুমা ভ্যালির পথে
নারিতা এয়ারপোর্ট থেকে কুমামাটো অভিমুখে উড়াল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টোকিওর ঘন নগরায়ণ নিচে সরে যেতে থাকে। জানলার বাইরে বদলে যায় দৃশ্য-কংক্রিটের শহর গলে গিয়ে জায়গা নেয় মেঘের সাদা বিস্তার আর দূরের নীলাভ সাগর।
নিকিতা জানালার দিকে তাকিয়ে বললো, এই পথটাই আসলে কুমা ভ্যালির প্রথম দরজা। প্রায় দুই ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে বিমান যখন কুমামাটো এয়ারপোর্টে নামল, তখনই মনে হলো-একটি অন্যরকম জাপানে প্রবেশ করেছি। প্রথম যে জিনিসটি চোখে পড়লো তাহলো অপরূপ সবুজ পাহাড়। তখনই বুঝতে পারি, কুমা ভ্যালির যাত্রা হবে একদম ভিন্ন স্বাদের। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমরা বাসে চাপলাম। নিকিতা বলল-আমরা যাচ্ছি দক্ষিণ দিকে। কুমা নদী আমাদের পথ দেখাবে। রাস্তা ধীরে ধীরে সরু হতে লাগলো বামদিকে পাহাড়, ডানদিকে গভীর সবুজ অরণ্য। দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রাম, কাঠের ঘর, আর ধানক্ষেতের সারি-সবকিছুই যেন ছবির মতো শান্ত। বাস দক্ষিণের দিকে নামতে শুরু করলে দুপাশে ধীরে ধীরে ঘন হয়ে ওঠে পাহাড়, আর তার মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা এগিয়ে চলে। পথে চোখে পড়ে কাঠের পুরোনো বাড়ি, ছোট্ট কৃষক গ্রাম আর কোথাও কোথাও উড়তে থাকা কুয়াশার ফাঁকে দেখা মেলে ধানক্ষেতের সবুজে ডোবা উপত্যকা। প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাস্তায় প্রথমবার কুমা নদীর ঝলক দেখা দিলো। স্বচ্ছ পানির ওপর রোদ পড়লে সিলভার রঙে ঝিকিমিকি করে, নিকিতা ফিসফিস করে বললো, এটাই কুমা ভ্যালির প্রাণ।
হঠাৎ নিকিতা থেমে নদীর দিকে ইশারা করে বললো, শোন না, এই যে নদীর শব্দ, এটা তোমাকে এখানে টেনে আনবে বারবার। নদীর পাশে দাঁড়ালে কুমা নদীর স্রোত যেন মনকে ধুয়ে দেয়। কোথাও ঝরনার ঝাপটা, কোথাও শ্যাওলা ঢাকা পাথর-এসব মিলিয়ে ভ্যালিটা হয়ে ওঠে জাপানের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ জায়গাগুলোর একটি। নিকিতা জানায়, এ নদীর পাশেই গড়ে উঠেছে Hitoyoshi kni কুমা ভ্যালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। শহরটিতে নেই কোনো অতিরিক্ত কোলাহল; বরং রয়েছে পুরোনো কাঠের ঘর, কম উঁচু সেতু আর দূরে পাহাড়ের শান্ত অবয়ব।
Hitoyoshiতে পৌঁছে মনে হলো যেন কোনো পুরোনো জাপানি চলচ্চিত্রের সেটে দাঁড়িয়ে আছি। নিচু ঘরবাড়ি, ভেজা কাঠের গন্ধ, আর রাস্তার ওপারে ছোট্ট দোকানে শব্দহীন চা বানানোর দৃশ্য-সব মিলিয়ে শহরটি যেন সময়ের বাইরে অবস্থান করছে। নিকিতা শহরের দিক দেখাতে দেখাতে বললো, এখানকার মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলে। তাই এ জায়গাটি এত শান্ত। নিকিতা আমাকে একটি ছোট রিয়োকানে নিয়ে গেল। দরজায় হাসিমুখে বৃদ্ধা মালকিন-টাটকা মাছ, শোচু, আর স্থানীয় সবজি দিয়ে সাজানো ডিনার। খাওয়ার পর নিকিতা বলল-চলো, অনসেনে যাই। ভ্যালির আসল যাদু ওখানেই। গরম পানিতে শরীর ডুবানোর সঙ্গে সঙ্গেসারা দিনের ক্লান্তি গলে গেল। জানালার বাইরে নদীর শব্দ-কুমা ভ্যালি যেন নিজের হাতে আমাকে শান্ত করে দিচ্ছিলো। বিকালে আমরা গেলাম কুমা ভ্যালিতে। নিকিতা আমাকে নিয়ে উঠলো একটি নৌকায়। নৌকায় চড়তেই মনে হলো আমি যেন পুরোনো কোনো জাপানি চিত্রে ঢুকে গেছি। কাঠের তৈরি নৌকায় কুমা নদীর ওপর দিয়ে ধীরে ভেসে যাওয়া-এ যেন পুরো উপত্যকার আত্মাকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়, হঠাৎ দেখা পাওয়া ঝরনার ধারা, আর নৌকার নিচে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা পানি-সব মিলিয়ে এক ধরনের অদ্ভুত নীরবতা তৈরি হয়। নিকিতা বলে, কুমা নদী জাপানের দ্রুততম স্রোতগুলোর একটি। তবু ভোরে এ নদীর মতো শান্ত কিছু নেই। ভ্যালির শেষ বিকালটিতে পাহাড়ের ওপর আলো ধীরে ধীরে কমে আসে। কুমা নদী রঙ বদলায় সোনালি থেকে কমলা রঙে। আমরা রওয়ানা দিই টোকিওর পথে।