০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৩:৩৮:০৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি লাগবেই বা কেন
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৪-২০২৪
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি লাগবেই বা কেন ছাত্ররাজনীতির প্রতিবাদে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা


ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ বুয়েট ক্যাম্পাসে। রাতের আঁধারে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের অনুপ্রবেশ নিয়ে দেশ জুড়ে এখন তুলকালাম। কেন কি উপলক্ষে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেটা সবার জানা। একজন সত্তর দশকে ছাত্র রাজনীতি করা গর্বিত বুয়েট আলমনি হিসাবে আমি বিচলিত-উদ্বিগ্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বুয়েট অন্য ৮-১০ প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন। দেশের সেরা মেধাবী ছাত্র ছাত্রীরা মুক্ত স্বাধীন মেধাভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কঠিন ক্যাম্পাস জীবনে কঠোর নিয়ম মেনে পড়াশুনো করেই স্নাতক এবং স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করতে হয়। গড্ডালিকা প্রবাহে গা এলিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবাই জানে দেশে বিদেশে বুয়েট স্নাতকদের কদর। 

কয়েক বছর আগে বুয়েটের শেরেবাংলা আবাসিক হলে আবরার ফরহাদ নামের একজন ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল একটি ছাত্র সংগঠনের এক্টিভিস্টরা। বিচারাধীন সেই ঘটনার জের ধরে বেশ কয়েকজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে বিচারিক আদালত। ওই ঘটনার জের ধরে সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকদের দাবির প্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একটি সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের কিছু নেতা এবং সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী কোন তথ্যের ভিত্তিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসীর লালন করতে দেখলেন? সরকারের কোনো গোয়েন্দা সংস্থা কি রিপোর্ট দিয়েছে? 

আমরা ১৯৭৩-৭৭ বুয়েট ক্যাম্পাসে লেখা পড়া করেছি। ছাত্র লীগার হিসাবেই ছাত্র রাজনীতি করেছি। বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ, ছাত্রশিবিরসহ সকল ছাত্রদলের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান দেখেছি। এখন কিন্তু ছাত্ররাজনীতি পাল্টে গেছে। প্রবাস থেকে সাময়িক সময়ের জন্য দেশে ফিরে খবর পেয়ে আবরার হত্যার পরদিন বুয়েট ক্যাম্পাসে ছুটে গিয়েছিলাম। সেখানে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্ররাজনীতির বীভৎস রূপ আমাদের বর্ণনা করেছিল। আমি বিস্মিত হই। আমাদের সময়ের সহবাস্থানের সেই পরিবেশ এখন নেই। 

বুয়েটে যারা পড়ার সুযোগ পায় তারা সবাই মেধাবী। তাই বঙ্গবন্ধু স্বয়ং বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। ঐতিহ্যগতভাবে বুয়েট ক্যাম্পাসে কিছু ছাত্র তবলীগ-জামাত করে। আমি নিশ্চিত নই সেখানে মৌলবাদিদের কোনো ঘাঁটি গড়ে উঠেছে কিনা..। যদি তাই হয় সরকারের এতো গোয়েন্দা সংস্থা তাদের নজর এড়ানোর কোন কারণ নেই। আমি এই মুহূর্তে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি শুরু করার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ দেখি না। এমনিতেই পেশাদার প্রকৌশলীদের নেতৃত্বে মূলত বুয়েট অ্যালামুনিরা আছেন। তাদের নেতৃত্বে পেশাদার হিসাবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুয়েট ক্যাম্পাস অশান্ত হবে এমন কিছু করবেন না।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরজি বুয়েট শিক্ষার্থীদের

ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চেয়ে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আরজি জানালেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলেছেন, ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব। মৌলবাদী শক্তিকেও রুখে দিতে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ।

প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও বুয়েটকে যাতে ছাত্ররাজনীতির বাইরে রাখা হয়। প্রধানমন্ত্রী যেন তাঁদের পাশে থাকেন। বুয়েটের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে গত ২ এপ্রিল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা একটি খোলাচিঠি পড়ে শোনানো হয়। এই চিঠিতে শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁদের আরজি তুলে ধরেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার শিকার হওয়ার পর ক্যাম্পাসে ২০১৯ সালের অক্টোবরে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। গত ১ এপ্রিল সোমবার আদালতের সিদ্ধান্তের পর এই ক্যাম্পাসে আবার চালু হতে যাচ্ছে ছাত্ররাজনীতি। এমন প্রেক্ষাপটে ১ এপ্রিল সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে উপাচার্যসহ শিক্ষকদের প্রতি বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখতে উদ্যোগী হওয়ার আরজি জানান।

সংবাদ সম্মেলনে খোলাচিঠি পড়ে শোনান বুয়েটের পাঁচ শিক্ষার্থী। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা ত্রাসের রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না; আমরা শুধু দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতে জানি। নিজেদের কাজ দিয়ে তা আমরা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের সবার অভিভাবক, দেশের অভিভাবক। আমরা জানি দেশের কোথাও কোনো দুঃখজনক পরিস্থিতি চললে, কোথাও সংকট চললে আপনার হৃদয়ে গভীর রক্তক্ষরণ হয়।’ চিঠিতে বলা হয়, ‘বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সূচনা ঘটেছে আধিপত্য, দাপট, র‌্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন ও খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মতো ঘটনার। ঘটেছে হত্যাকান্ডের ঘটনাও।’ খোলাচিঠিতে বলা হয়, ‘ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব। মৌলবাদী শক্তিকেও রুখে দিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ।’ চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হওয়ার পর থেকে আজ অবধি প্রতিটি জাতীয় দিবস সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে বুয়েট প্রাঙ্গণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করা হচ্ছে। আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের জাতীয় মূল্যবোধ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনে-প্রাণে ধারণ করি।’ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য যে কতিপয় ব্যক্তি বা গণমাধ্যমের তৎপরতায় ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েট ক্যাম্পাসকে জাতীয় চেতনার বিরোধী মতাদর্শের স্থান হিসেবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে ৷ বিষয়টিতে আমরা অত্যন্ত ব্যথিত। আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের ব্যাপারে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। তাই দেশের যেকোনো স্থানের মতো আমাদের ক্যাম্পাসকে আমরা অবশ্যই যেকোনো ধরনের সন্ত্রাস, মৌলবাদ বা নিষিদ্ধ গোষ্ঠী থেকে নিরাপদ রাখতে সর্বদা তৎপর।’ 

শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা আপনাকে নির্দ্বিধায় বলতে চাই, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেকোনো মুহূর্তে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যেকোনো কার্যকলাপ ক্যাম্পাসে দেখলে শিগগিরই তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেব এবং প্রশাসনকে অবহিত করব। এমনকি ভবিষ্যতে যদি ক্যাম্পাসে এ ধরনের কর্মকান্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সেটার বিরুদ্ধেও আমাদের দৃঢ় অবস্থান থাকবে।’

বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতিহীন চার বছর শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে কাটিয়েছেন বলেও খোলাচিঠিতে উল্লেখ করা হয় ৷ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলা হয়, ‘আমাদের মতো দেশজুড়ে লাখো শিক্ষার্থী এমন একটা ক্যাম্পাসের স্বপ্ন নিয়েই বাড়ি ছাড়ে, যেখানে তাদের ওপর অকারণে জুলুম হবে না, নির্যাতিত হতে হবে না, দিন-রাত কারও ভয়ে তটস্থ থাকতে হবে না, বাবা-মাকে দুশ্চিন্তায় চোখের পানি ফেলতে হবে না। চার বছর আগে আপনার দৃঢ় এবং দ্রুত হস্তক্ষেপে আমরা নতুন করে এই ক্যাম্পাসে বাঁচতে শিখেছি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই ছোট্ট একটা চাওয়ার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি হুমকি, হচ্ছি লাঞ্ছিত ও অপদস্থ ৷ আমরা, আমাদের ছোট ভাইবোনেরা আরও একবার সেই অন্ধকার দিনগুলোর সাক্ষী হতে চাই না। আমাদের মাননীয় উপাচার্য ও সব শিক্ষকের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে ৷ তাঁরা তাঁদের সন্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় সর্বদা সচেষ্ট আছেন এবং থাকবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে সবিনয়ে অনুরোধ, আপনি আমাদের পাশে দাঁড়ান। আপনি সব সময় শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন ৷ আমরা জানি, এই দুর্দিনে আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।’

বুয়েট শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আরও বলেন, ‘বুয়েটকে ছাত্ররাজনীতির বাইরে রাখুন, প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও৷ কারণ, সুবিচারের জন্যই আইনের সৃষ্টি ৷ আমাদের অনুরোধ, আপনি দয়া করে আমাদের ক্যাম্পাসে আসুন। ছাত্ররাজনীতিহীন বুয়েট গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য যে আদর্শ ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে, সেটা আমরা আপনাকে দেখাতে চাই। আমরা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমরা প্রযুক্তিবিদ্যালয় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে দেব শিগগিরই। আমাদের এই পথচলা আপনিই নির্বিঘ্ন রাখতে পারেন। সেই আশাতেই এই চিঠি। আমরা আপনার হাজারো সন্তান, আপনার সহযোগিতার প্রতীক্ষায় আছি।’

শেয়ার করুন