ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীন কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার যে পুরোনো সিদ্ধান্ত বিএনপির, সেটাতে এখনো অক্ষুণ্ণ বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পর অনেকেই বিএনপির ওই সিদ্ধান্তকে বোকামি বলে উল্লেখ করে। এমনকি বিএনপির মধ্যেও অনেকে এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কিছুটা অসন্তুষ্ট। কিন্তু বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এ সিদ্ধান্ত যে পারফেক্ট সেটা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ইশারা ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এমন প্রেক্ষাপটে আসছে উপজেলা নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দল বিএনপিকে অন্তত উপজেলাতে ভেতরে ভেতরে ভীষণভাবে চাইলেও বিএনপি এ ব্যাপারেও কঠোর। কোনোভাবেই উপজেলা কেন কোনো পর্যায়ের নির্বাচনেই অংশ নেবেনা বলে কঠিন সিদ্ধান্তে তারা।
শুধু তাই নয়, বিএনপির অভ্যন্তরেও এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে, যে কেউ যদি দলের এমন সিদ্ধান্ত ব্রেক করে উপজেলাতে অংশ নেয়, তাহলে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এমন নির্দেশনাতে যারা স্বতন্ত্র বা বিভিন্নভাবে নির্বাচন করার কথা চিন্তাভাবনা করছিলেন, তারাও এখন নিশ্চুপ। দেড়যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থেকেও দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপারে শৃঙ্খলাটা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে দলটির সাংগঠনিকভাবে। ফলে যাদের সামান্যতম ইচ্ছেও ছিল তারাও এ থেকে সরে গেছেন। দলের ওই সিদ্ধান্তের কথা আরেকবার প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
সোমবার (১৫ এপ্রিল) নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে রিজভি বলেন, ‘আমাদের আগের সিদ্ধান্তই (উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেওয়া) বহাল আছে।’ ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনের পরে উপজেলা নির্বাচনও বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। ওই সময়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে রিজভি বলেন, আমরা এই সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলছি। সেখানে...। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে সিদ্ধান্ত তা হচ্ছে- শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা যাবো না। কারণ, তার অধীনে কোনো নির্বাচন কখনো অবাধ সুষ্ঠু হয় না। তিনি বলেন, আমরা বরাবরই বলেছি, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন কখনো শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু হবে না। সুতরাং তার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না... সেই সিদ্ধান্ত আমাদের আগেই নেওয়া আছে। বিএনপি এখনো সেই সিদ্ধান্তেই অটুট রয়েছে।
প্রথম ধাপের ১৫২টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সোমবার (১৫ এপ্রিল) শেষ দিন। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী আগামী ১৭ এপ্রিল পর্য়ন্ত মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই, ২২ এপ্রিল প্রার্থিতা প্রত্যাহার এবং ২৩ এপ্রিল প্রতীক বরাদ্ধ করা হবে। প্রথম পর্বের ভোট গ্রহণ হবে ৮ মে।
‘দেশ পরাধীন শৃঙ্খলে বন্দি’
রিজভি বলেন, আপনারা আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি- সব কিছু ওরা ধ্বংস করে দিয়েছেন। এমনকি কোথায় আমাদের স্বাধীনতা? একই দিনে ভারতের বোম্বে যে সিনেমা রিলিজ সেটা ঢাকাতেও রিলিজ হয়... এটা কি স্বাধীনতার নমুনা? ওবায়দুল কাদের সাহেবরা স্বাধীনতার কথা বলেন। আপনারা ক্ষমতায় আসার পর থেকে মনে হয়েছে যে, আমরা বোধহয় একটা পরাধীন দেশে বাস করছি, আমরা একটা পরনির্ভরশীল দেশে বাস করছি। এই কারণেই আজকে দেশের এই করুণ অবস্থা, জনগণের চরম দূরাবস্থা, অর্থনীতির ভঙ্গুর। ‘বাঙালি জাতিসত্তাকে যারা অস্বীকার করে বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধকে তারা অস্বীকার করে’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এরকম বক্তব্যের সমালোচনা করে রিজভি বলেন, বাঙালি জাতিসত্তা বলতে আপনি কি বুঝাচ্ছেন। বাঙালি বাংলাদেশ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে আছে... তারা কি মুক্তিযুদ্ধ করেছে? অন্যান্য দেশে যে বাঙালিরা বসবাস করেন তারা তো মুক্তিযুদ্ধ করেনি, তারা তো ভাষা আন্দোলন, রাজনৈতিক সংগ্রাম করেনি। তাহলে আপনি (ওবায়দুল কাদের) কি বুঝাতে চাচ্ছেন? আমাদের যে বাংলা সেটার একটা স্বতন্ত্র রূপ পেয়েছে। আমার জাতিসত্তার মধ্যে যে বাংলা, আমার জাতি সত্ত্বার মধ্যে যে ভাষা, আমাদের কৃষ্টি, আমাদের সংস্কৃতি যেটা একভাবে গড়ে উঠেছে... আমাদের খাদ্যাভাস, আমাদের পোষাক-পরিচ্ছেদ, আমাদের পরস্পরের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় একধরনের গড়ে উঠেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু অঞ্চলে সেখানে বাংলা ভাষা আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে পার্থক্য হয়ে গেছে। রিজভি বলেন, আমাদের জাতিসত্তার মধ্যে যে বাংলা ভাষা আমরা সেটাকেই আপহোল্ড করবো। আমাদের এই অঞ্চলের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে সাংস্কৃতিক যে ধারা আমরা সেটাকে আমরা লালন করি। আপনি তো বিভ্রান্তি তৈরি করছেন ওবায়দুল কাদের সাহেব। আপনি বাংলাদেশের মানুষের বাংলা ভাষা, কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন...আপনি বির্তক তৈরি করার জন্য এ কথাগুলো বলছেন। আপনার কথা যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা থাকে না, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখাকে অস্বীকার করতে হয়। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিএনপি বাংলাদেশে বিশ্বাস করে, বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে... পাসপোর্টের মধ্যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ..এটা রাখা হয়েছে।
বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন, তলে তলে আমরা আঁতাত করছি, ওমুক করছি... এই তলে তলের মধ্যে তাদের (আওয়ামী লীগের) অন্য উদ্দেশ্য আছে। এই বাংলাদেশের অস্তিত্ব বাংলার সীমানাম, বাংলাদেশের যে স্বাতন্ত্র সেটাকে তারা ম্লান করে দিতে চায়, বিলিন করে দিতে চায়। অন্য কারো সঙ্গে তারা মিলিয়েয় দিতে চায়... এটা একটা গভীর দুরভিসন্ধির মধ্যে ওবায়দুল কাদের সাহেবদের আছেন। ওবায়দুল কাদের সাহেবদের বক্তব্য উদ্দেশ্যেমূলক, বিভ্রান্তিকর, ইতিহাসবিরোধী, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী, দেশের গণতন্ত্র বিরোধী।
এ সময় বিএনপি যুববিষয়ক সহ-সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, ঢাকার সাবেক কমিশনার আনোয়ার পারভেজ বাদল, বিএনপি নেতা সাঈদ হোসেন সোহেল আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের জামিন না দিয়ে কারাগারে প্রেরণের ঘটনার নিন্দা জানান রিজভী বলেন, সরকারের নানাবিধ জুলুম-নিপীড়নের যে নকশা সেই নকশা অনুযায়ী তাদের কারা অন্তরীণ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক, আবদুস সালাম, সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিম ভুঁইয়া, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, স্বাস্থ্য বিষয়ক সস্পাদক রফিকুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।