১৪ মে ২০২৫, বুধবার, ০২:৩১:৫৫ পূর্বাহ্ন


আমেরিকার রাজনীতি ও সমাজকে পুনর্গঠনে ট্রাম্পের বিতর্কিত কৌশল
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০১-২০২৫
আমেরিকার রাজনীতি ও সমাজকে পুনর্গঠনে ট্রাম্পের বিতর্কিত কৌশল ডোনাল্ড ট্রাম্প


প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ১৭৮৯ থেকে ১৮শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের কিছু পুরোনো আইন পুনঃব্যবহার করার মাধ্যমে আমেরিকানদের আবেগিক ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছেন। তার উদ্দেশ্য হলো, ঐতিহাসিক আইনগুলোকে ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে দেশের ভেতরে শত্রু নির্মূল করা এবং অনথিভুক্ত অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে বহিষ্কার করা। ট্রাম্প এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সমর্থকদের কাছে শক্তিশালী আমেরিকার চিত্র তুলে ধরতে চান। তবে তিনি এই আইনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা হুমকির মুখে ফেলছেন। এসব প্রচেষ্টা এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে, যা ভবিষ্যতে দেশের সাংবিধানিক কাঠামোকে বিপর্যস্ত করতে পারে। বিশেষত, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং জন্মগত নাগরিকত্ব নিয়ে তার পরিকল্পনাগুলি দেশটির আইনি পরিমণ্ডলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের এই উদ্যোগগুলো ১৭৮৯ থেকে ১৮০০ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে প্রণীত কিছু পুরোনো আইন পুনরায় ব্যবহারের প্রস্তাব। এসব আইন মার্কিন ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে।

ট্রাম্পের শাসনকালে যেসব আইন তিনি পুনরুজ্জীবিত করতে চান, তা দীর্ঘদিন ধরে অপ্রচলিত ছিল। এর মধ্যে ১৭৯৮ সালের অ্যালিয়েন এনিমিস অ্যাক্ট রয়েছে। এ আইনটি একসময় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বিদেশি শত্রু রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল, এবং ১৭৯৪ সালে হুইস্কি বিদ্রোহের পর প্রণীত আরেকটি আইন। আইনগুলো প্রেসিডেন্টকে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনী ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এছাড়া ১৮৭৩ সালের চ্যাস্টিটি আইনসহ আরো কিছু প্রাচীন আইনও তিনি পুনঃপ্রবর্তন করতে চান, যার মাধ্যমে তিনি ডাকযোগে গর্ভপাতের ওষুধ পাঠানো নিষিদ্ধ করতে চান। এসব আইনের মাধ্যমে ট্রাম্প আমেরিকার এক শক্তিশালী অতীতকে পুনরুদ্ধার করতে চান।

অবশ্য এই আইনগুলোর পুনর্ব্যবহার একাধিক আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছে, তা শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আইনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমেরিকার সামাজিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ট্রাম্প তার প্রচারে এ আইনগুলোকে তার রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন, যা তার সমর্থকদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

ইমিগ্রেশন এবং অন্যান্য নীতি

ইমিগ্রেশনই একমাত্র ক্ষেত্র নয় যেখানে এই আইনগুলো ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। কিছু সহযোগী, যেমন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত জেডি ভ্যান্স, ১৮৭৩ সালের চ্যাস্টিটি আইন প্রয়োগের পক্ষে মত দিয়েছেন। এ আইনে প্রশাসন ডাকযোগে গর্ভপাতের ওষুধ পাঠানো নিষিদ্ধ করতে পারে। ট্রাম্প এই আইনগুলোকে আমেরিকার রাজনীতির একটি ‘শক্তিশালী যুগের’ স্মারক হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে তিনি জন অ্যাডামস, থমাস জেফারসনসহ অন্য প্রেসিডেন্টদের সময়ে প্রণীত আইন ব্যবহার করতে পারেন। তার মতে, এই আইনগুলো ‘দেশের ভিতরে শত্রু’ মোকাবিলার জন্য এবং অনথিভুক্ত অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে বহিষ্কার করতে সহায়ক হবে।

‘তখন আমরা কোনো খেলা খেলতাম না’

১৭৯৮ সালের অ্যালিয়েন এনিমিস অ্যাক্টের কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেছেন, এটি ব্যবহার করে আমেরিকার মাটিতে সক্রিয় প্রতিটি অভিবাসী অপরাধী নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা সম্ভব। তিনি বলেন, এই আইনটি এতো পুরোনো যে এটি প্রমাণ করে আমরা তখন খেলাধুলা করতাম না। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের আইন ব্যবহার করা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। আইনটি সর্বশেষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল, যখন জাপানি নাগরিকদের আটক করা হয়েছিল।

১৮৭৩ সালের চ্যাস্টিটি আইন এবং গর্ভপাত

ট্রাম্প প্রশাসন ১৮৭৩ সালের চ্যাস্টিটি আইন ব্যবহার করে ডাকযোগে গর্ভপাতের ওষুধ পাঠানো বন্ধ করতে পারে। যদিও ট্রাম্প বলেছেন যে তিনি সাধারণভাবে এই আইন ব্যবহার করবেন না, তবে তার বিচার বিভাগ এই বিষয়ে চাপের মুখে পড়তে পারে।

সামরিক বাহিনী মোতায়েন

ট্রাম্প অভ্যন্তরীণভাবে সামরিক বাহিনী ব্যবহারের পরিকল্পনার কথাও বলেছেন। বিশেষ করে ইনসারেকশন অ্যাক্ট ব্যবহার করে লক্ষাধিক অনথিভুক্ত অভিবাসীকে বহিষ্কার করার কথা উল্লেখ করেছেন। এই আইনটি প্রেসিডেন্টকে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা মোকাবিলায় ব্যাপক ক্ষমতা দেয়।

জন্মগত নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক

ট্রাম্প ১৮৯৮ সালের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়কে চ্যালেঞ্জ করতে চান, যা জন্মগত নাগরিকত্বকে নিশ্চিত করে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টে এটি টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। আইন বিশেষজ্ঞ রজার্স স্মিথ বলেছেন, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এটি ট্রাম্পের পক্ষে যাবে না।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রশাসনের শুরুর দিকে ১৮০০ শতকের আইনি কৌশলগুলোর ওপর নির্ভর করে যে নীতি প্রণয়ন করছেন, তা শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টিকোণ আনার চেষ্টা নয়, বরং এটি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপে আইনি চ্যালেঞ্জ আসবে এবং সামাজিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাগুলি, বিশেষ করে জন্মগত নাগরিকত্ব এবং অভিবাসন সংক্রান্ত বিতর্কিত আইনগুলোর ব্যবহার, যেন এক ধরনের মানসিক চাপ বা ব্ল্যাকমেইল হিসেবে কাজ করছে, যা আমেরিকান জনগণের স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকারগুলোর প্রতি হুমকি হতে পারে। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা অর্জনের এই প্রচেষ্টা দেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি এবং আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। যদিও ট্রাম্প এবং তার সমর্থকরা মনে করেন, এসব পুরোনো আইন তার পক্ষে কথা বলবে, তবে এটি বাস্তবে দেশটির আইনি পরিসরে বিশৃঙ্খলা এবং সংকট তৈরি করতে পারে। ট্রাম্পের এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি যদি দেশের সাধারণ নাগরিকদের অধিকার এবং স্বাধীনতার ওপর আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়, তবে তা একটি বিপজ্জনক পথে পরিণত হতে পারে, যা ভবিষ্যতে আমেরিকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংবিধানিক কাঠামোকে ধ্বংস করতে পারে।

শেয়ার করুন