২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ১০:৩০:৩০ অপরাহ্ন


সুষ্ঠু মনিটরিং ও দক্ষ হাতে পরিস্থিতি সামাল দিলে এ অবস্থা থাকবে না
লোডশেডিংয়ে হঠাৎ করেই চারদিকে শঙ্কা উৎকণ্ঠা
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৭-২০২২
লোডশেডিংয়ে হঠাৎ করেই চারদিকে শঙ্কা উৎকণ্ঠা


ঈদুল আযহাতে রাজধানীতে লোডশেডিং ছিলনা। তবে মফস্বল তথা গ্রামগঞ্জে এর প্রভাব ছিল ব্যাপক। কোথাও কোথাও দিনে ২/৩ বারও হয়েছে লোডশেডিং। কোথাও একেকবার বিদ্যুৎ যেয়ে দুই ঘন্টার উপরেও লোডশেডিং। ঈদের ছুটিতে দেশব্যাপী সকল কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান,অফিস আদালত বন্ধ। এরপরও গ্রামগঞ্জে লোডশেডিং হওয়ার কথা না। দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড বলা হয়েছিল, সে তুলনায় এমনটা হওয়ার কথাই না। তবু কেন হচ্ছে। এটাতে কী নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাহলে ঈদের ছুটি শেষে দেশের সব কলকারখানা,শিল্প-বানিজ্য প্রতিষ্ঠান,অফিস আদালত খুলে গেলে এ লোডশেডিং কী মারাত্মক আকার ধারণ করবে। 

এ ব্যাপারে এক্সপার্টদের মন্তব্যটা ঠিক তেমনই। লোডশেডিং প্রচন্ড আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। বিষয়টি আচ করে প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন। একইভাবে লোডশেডিং কোথায় কখন কতক্ষণ হবে সেটার একটা চার্ট করা যায় কি-না সে ব্যাপারে পরামর্শ রেখেছেন। কিন্তু সেটা আদৌ কী সম্ভব? যেসকল এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠান সেখানে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রয়োজন। বিশেষ করে এক্সপোর্ট ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ যথাযথ না দিলে সে ক্ষেত্রে তাদের কাজে বিঘ্ন ঘটবে। সেটা হলে শিপমেন্ট ফেল হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে। 

এতে করে এক্সপোর্ট যথাসময়ে না হলে অর্ডার বাতিল হবে। গার্মেন্টস অর্ডার হারাবে। বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান একটি পথ ক্ষতির সম্মুখীন হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়বে। কমতে থাকবে। ফলে এক বিদ্যুৎ সঙ্কট দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে- সেটার একটা চিত্র মাত্র। এভাবে শুধু গার্মেন্টস শিল্পই নয়, অন্যান্য সব রপ্তানি পণ্যের উপরই প্রভাব পড়বে। যা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ। কিন্তু এটাও সত্য। বাংলাদেশের কী সে অবস্থা রয়েছে যে সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সাপ্লাই দেয়া সম্ভব। এক্সপার্টদের মতে এ মুহূর্তে সে সমার্থ সত্যিকার অর্থেই নেই। কারণ যে পরিমাণ নগদ বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে তৈল ও তরল গ্যাস ক্রয় করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে।

সে পরিমাণ অর্থ রিজার্ভে নেই। রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। গত বছর ডিসেম্বরেও রিজার্ভ ছিল ৪৬.১৫ বিলিয়ন ডলার। সেটা সর্বশেষ, নেমে এসেছে চল্লিশেরও নিচে। অর্থাৎ ৩৯.৮০ মিলিয়ন ডলারে। এর অর্থ এখান থেকে অর্থ নিয়ে তৈল ও গ্যাস ক্রয় করে সেটা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া চ্যালেঞ্জিং। এটাই এখন দেশের প্রধান সঙ্কট হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। 

অনেকেই ক’দনি আগেও বলেছিলেন, বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কার মত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি ঠিক শ্রীলঙ্কার মতই এগুচ্ছে কি-না এটা নিয়েই যত শঙ্কা। কারণ শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এখন এ পর্যায়ে নামলেও এর শুরু কিন্তু বহুদিন থেকেই। 

শ্রীলংকার স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া এখন কিভাবে দেশ ছেড়ে পালাবেন সে দুশ্চিন্তায়। কারণ ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষ তার প্রাসাদ দখল করে নিয়েছে। তিনি নিজেও প্রাসাদ থেকে পালিয়ে অজানা স্থানে গিয়ে অবশেষে পদত্যাগ করে ফেলেছেন। এরপরই তিনি পালাতে চাচ্ছেন। কিন্তু বিমানযোগে সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সর্বশেষ, নৌযোগে পালানোর চেষ্টা করছেন বলে খবর বেড়িয়েছে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ তাকে ট্রেস করতে পারছেন না। পারলে কঠিন একটা পরিস্থিতি তার জন্য অপেক্ষা করছে।

শ্রীলঙ্কার এই দ্বীপ-রাষ্ট্রের জ্বালানি প্রায় ফুরিয়ে গেছে। কারণ তাদের আর জ্বালানি আমদানি করার মতো সামর্থ্য নেই। দেশটির স্কুলগুলোতে ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অতি জরুরি সেবা ছাড়া আর সবকিছুর জন্য জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট রাজাপাক্ষে রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় জ্বালানি তেল কেনার জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। বিদ্যুৎ এর অভাবে হাসপাতালের অপারেশন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জরুরি অনেক কাজকর্ম সীমিত হয়ে একটা হ- য- ব- র- ল পরিস্থিতির অবতারণা। নতুন কেউ দায়িত্ব নিয়ে সহসাই যে কিছু করতে পারবেন সেটাও মনে হচ্ছেনা। তবে বিচক্ষণ কেউ দায়িত্ব পেলে হয়তো উত্তরণের চেষ্টা চালাবেন। কিন্তু দেশটির যে পরিমাণ লোন রয়েছে। সেটা পরিশোধ করাও বড় চ্যালেঞ্জ। এটা তো গেল শ্রীলঙ্কার কাহিনী।

বাংলাদেশ ওই অবস্থানে না থাকলেও কিছু কিছু বিষয় বাজে অবস্থার ইঙ্গিত তো দিচ্ছে। সেটা নিয়েই যত দুশ্চিন্তা। তবে সুষ্ঠু মনিটরিং ও দক্ষ হাতে পরিস্থিতি সামাল দিলে এ অবস্থাটুকুও থাকবে না। কিন্তু সেটা তো করতে হবে। কারণ যে অবস্থার তৈরি হয়েছে, এটা কিন্তু নীতিনির্ধারকদের জানারই কথা। কিন্তু কেন সেটা অনুধাবন বা পর্যালোচনা করলেন না। এখানে কোনো অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ড হলো কি-না সেটা নিয়েও কথা উঠছে। কারন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছেন। এটাতে তিনি সফল। কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ার ব্যাবস্থা করলেও এখন কেন সেটাতে বিশাল বিঘ্ন ঘটছে? এ প্রশ্নটা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। 

এদিকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বেগতিক দেখেই কী উন্নয়নসহযোগীরা ব্যস্ত হয়ে গেছেন। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে তাদের পছন্দের নেতৃত্ব বেছে নেয়ার জন্য? 

বেশকিছুদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ বাংলাদেশের উন্নয়নসহযোগী বা দাতাদেশসমূহ বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠুধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কেননা তারা কোনোভাবেই বাংলাদেশের বিগত দুইবারের (২০১৪ ও ২০১৮ ) নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকে সমার্থন দেয়নি। উপরন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে তাদেরও অনেক স্বার্থ। কারণ এ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ তৈরি পোষাক তাদের দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এটা তাদের বড় একটা স্বার্থ। এছাড়াও ভৌগলিক দৃষ্টিকোন থেকে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশ যেন চায়না ব্লকে চলে না যায় সে দিকে তাদের তিক্ষè নজর।

একই সঙ্গে চীনের উত্থান ঠেকাতে কোয়াডে যোগ দেয়া বা সেটাকে যাতে সাপোর্ট করে বাংলাদেশ সেটাও প্রত্যাশায় উন্নয়ন সহযোগীদের। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন সুখ,দুঃখে এসব উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতার হাত সবসময়ই প্রসারিত থাকে। ফলে বাংলাদেশের জন্য কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ সেটা যদি তারা পর্যবেক্ষণ করেন সেটা তাদের ভাষায় খারাপ তো কিছুনা। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থেই তারা কাজ করছেন বলেই মন্তব্য তাদের। যেমনটা মানবাধিকার প্রসঙ্গে র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। যাদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ গুম-খুনের। 

এদিকে বছরব্যাপী সংঘটিত গুম-খুন তথা স্পর্শকাতর ঘটনাগুলো এবং এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে তথ্য দিয়ে সহায়তাকারী ব্যক্তি এবং মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য বা অবস্থান জানতে চেয়েছে  জাতিসংঘ। এ সংক্রান্ত এক চিঠিতে বলা হয়, সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা ওই সব কেসের বিষয়ে আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের বক্তব্য পাওয়া জরুরি। অন্যথায় হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মহাসচিব যে বাৎসরিক রিপোর্ট পেশ করতে যাচ্ছেন তাতে বাংলাদেশের ভাষ্য অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে না। 

চিঠিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়, মহাসচিবের রিপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত তারিখের পর কারও কোনো বক্তব্য দেয়ার অবকাশ নেই বরং তা দিলেও গৃহীত হবে না। ২৭ জুন নিউ ইয়র্কস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনকে লেখা অফিস অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর)-এর ওই চিঠিতে বলা হয়, জাতিসংঘ মহাসচিবের রিপোর্টে ১লা মে ২০২১ থেকে ৩০শে এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত সময়কালে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর ঘটনাগুলো স্থান পাবে। ওই সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার সংবেদনশীল কিছু ঘটনা রয়েছে, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য দেয়ার সুযোগ রয়েছে। ওএইচসিএইচআর আশা করে ঢাকা সেই সুযোগ গ্রহণ করবে। 

কিন্তু বাংলাদেশ সে রিপোর্ট যথাযথভাবে দিতে পারবে কিনা এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এর আগেও এসব বিষয়ে তথ্য দেয়া হলেও তাতে সন্তুষ্ট হয়নি তারা। এবারও যথার্থ তথ্য না পেলে সেটা জাতিসংঘের বার্ষিক রিপোর্টে কতটা সমন্বয় করা হবে সেটা দুশ্চিন্তার কারণ। এটাও জাতিসংঘের তরফ থেকে ঢাকার উপর স্পষ্ট একটা চাপ। 

এর পাশাপাশি আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন কিভাবে হবে সেটা নিয়েও উন্নয়ন সহযোগীদের রয়েছে প্রচন্ড চাপ। যার সংক্ষিপ্ত রুপ হলো- সকল দলকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। যা হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। কিন্তু এ প্রসঙ্গে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে যেতে যে শর্ত দিচ্ছে সেটা আওয়ামী লীগ উড়িয়ে দিচ্ছে। কারন বিএনপির দাবী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন।

নতুবা আরেকটি নির্বাচন হবে যা হয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সনের মত। যা দেশ ও মানুষ চায় না। ফলে এ ইস্যুটি কিভাবে মিটমাট হবে এ নিয়েও একটা চাপ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের উপর। কিন্তু এ প্রসঙ্গে নিজেদের যে প্লান বা নীতি সেটাতে অনঢ় তারা। ফলে এর সুষ্ঠু সমাধান কী সেটা নিয়েও মানুষের মধ্যে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। কিভাবে বিদ্যুৎতের সমাধান, কিভাবে রাজনৈতিক ঝামেলার অবসান ঘটবে সেটা নিয়েই মানুষের নিত্য যত আলোচনা।   

শেয়ার করুন