২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৪:২৮:৩৩ পূর্বাহ্ন


স্মৃতিতে অম্লান ২৬ মার্চ ’৭১
খন্দকার সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৪-২০২২
স্মৃতিতে অম্লান ২৬ মার্চ ’৭১



২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে এখন অনেক কথাই বলছেন কেউ কেউ। তবে এটাও ঠিক এতো বিশাল ঘটনা একেক জনের স্মৃতিতে একেক রকম হবে এটা স্বাভাবিক। তবে সমস্যা হয় যার অভিজ্ঞতাই নেই বা ভুল তথ্য উপস্থাপন। 

‘মানুষের জীবনে কিছু কিছু দিনের স্মৃতি চিরদিন শাশ্বত স্মৃতি হয়ে জেগে থাকে। মনে হয় যেন এই তো সেদিনের ঘটনা। আমরা যারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম তাদের সবার কাছেই ২৬ মার্চ ১৯৭১ এমনি চিরদিনের এক স্মরণীয় দিন। কি হয়েছিল ২৫ মার্চ? মাঝ রাত থেকে ২৬ মার্চ ১৯৭১ তা নিয়ে অনেক মন গড়া কথাও শুনি। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। হয়তো বিবিসি বাংলা সার্ভিসের আর্কাইভ থেকে আমার নিজ কানে শোনা কথাগুলোর প্রমাণ মিলবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারো দয়ার দান ছিল না। অনেক বঞ্চনার নিষ্পেষণে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের সম অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। প্রথমে ভাষায় আঘাত করা হয়েছিল। অধিকতর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাঙালিদের মেধা ভিত্তিক চাকরির অধিকার, ক্রীড়াঙ্গনে সমান সুযোগ দেয়া হতো না।  

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ৬দফা, ছাত্রদের ১১দফা, আগরতলা মামলা, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন বাংলাদেশি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। ভাত-মাছে টোস্ট শান্তিবিলাসী নিরস্ত্র জাতিকে তিলে তিলে স্বাধীনতার মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়ার মুজিব ভাই, কারো কারো মুজিব দাদা। ২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তান সেনাদলের অপারেশন সার্চলাইট পাকিস্তান নামের দেশটির কবর রচনা করেছিল, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধুর বরাতে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল। ২৬ তারিখ বহু কষ্ট করে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী কেন্দ্র নাম একটি বেতার তরঙ্গ থেকে মরহুম আব্দুল হান্নান মহোদয়ের কোনোটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মৃদু আওয়াজে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলাম খুলনা মুন্সিপাড়া বাসায় বসে। দেখলাম ছাত্রনেতা, শ্রমিকনেতাদের ব্যস্ততা। গভীর উৎকণ্ঠায় সময় কাটলো। তখন এই সময়ের মতো সেলফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণীর সংবাদ ছিল প্রধান ভরসা। মাঝে মাঝে মৃদু আওয়াজে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঘোষণা শোনা যাচ্ছিলো। ২৭ মার্চ দুইবার মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনলাম। একজন সেনা কর্মকর্তার কণ্ঠে এমন ঘোষণা শুনে কিশোর বয়সে ভরসা পেয়েছিলাম।  

স্বাধিকারের জন্য জনমনে অসন্তোষের বারুদ জ্বলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর টালবাহানা চলছিল ক্ষমতা হস্তান্তরে। ১৯৭১-এর সূচনা থেকে বাঙালির প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু আঁচ করতে পারছিলেন সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। তাই ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ সভা স্থগিত হবার সাথে সাথেই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এরপর আসলো সাতই মার্চের সেই কালজয়ী আহ্বান। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধুর  ৭ মার্চের ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা ভাষণ শেষে ঢাকা থেকে ফরিদপুর হয়ে মমতাময়ী মায়ের নির্দেশে বড় ভাইয়ের খুলনা বাসায় চলে যাই। ভাই-ভাবির খুলনার মুন্সিপাড়া বাসাটি ওই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ প্রস্তুতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। খুলনার ছাত্র, যুব নেতারা ভাইয়ের বাসায় সমবেত হয়ে মিটিং-মিছিলের পরিকল্পনা করতেন। নজরুল ভাই, বালু ভাই, টুকু ভাই, সিঁড়ি আপাদের কথা মনে আছে। খুলনা জেলা স্কুল মাঠে একজন ইপিআর সুবেদার আমাদের হালকা অস্ত্র চালনা, গ্রেনেড নিক্ষেপ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। ছাত্রনেতা বড় ভাই-বোনদের সাথে স্কুল- কলেজের ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশবিশেষ অনুকরণ করতাম। অন্যান্য সময় বন্ধু-সাথীদের সাথে মিলে খালিশপুর বিহারিদের এলাকা পাহারা দিতাম, যাতে ওরা এলাকায় বাঙালিদের অত্যাচার না করতে পারে। দেশজুড়ে যুদ্ধ প্রস্তুতি, থমথমে পরিবেশ। বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে ছোটখাটো সংঘাত চলছিল। পঁচিশে মার্চ কালরাতের গণহত্যার খবর রাতেই আমরা পেয়ে যাই। মনে আছে, ভোররাত থেকেই বিবিসি শুনছিলাম। সকালে ৭:৩০ মিনিট বিবিসি বাংলা খবরে প্রথম শুনলাম ,‘পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। অজানা বেতার কেন্দ্র থেকে মৃদু কণ্ঠে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে’। বড় ভাই প্রয়াত খন্দকার মালেক, ভাবি আমাদের ৩ মাস বয়সী ভাতিজি মালাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শুরু হলো আমাদের প্রস্তুতি। মনে আছে, ৬ এপ্রিল ছাত্র-জনতা খুলনার নেতা সবুর খানের বাসা ঘেরাও করে ভাঙচুর করেছিল। আমি উপস্থিত ছিলাম। বাসার ফাল্গ স্ট্যান্ড থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে পুড়িয়েছিলাম এবং বাসায় থেকে বিদেশি কুকুরটি নিয়ে এসে টিক্কা খান নাম দিয়ে পালাতে শুরু করেছিলাম। 

ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই ঢাকায় বড় বোনের আজিমপুর কলোনির বাসায় ছিলাম উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। ১৯৬৬ আপার বিয়ের পর প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর ঢাকায় যেতাম ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল, ক্রিকেট দেখার জন্য আর ১৯৭১ আমাদের কলেজের টেস্ট পরীক্ষার পর অবকাশ ছিল। কখনো পুরোদস্তুর ছাত্রনেতা না থাকলেও রাজনীতি সচেতন ছিলাম। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬দফা, ছাত্রদের ১১দফা, আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন, ১৯৭০ জাতীয় নির্বাচন বিষয়গুলো নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা এবং কিছুটা সম্পৃক্ততা ছিল। নানা কারণে বঙ্গবন্ধুকে রোল মডেল মনে হতো। তোফায়েল ভাই, নূর আলম সিদ্দিকী ভাইয়ের ভাষণের দারুণ ভক্ত ছিলাম। ৭ মার্চের পর সম্ভবত ১০ মার্চ ফরিদপুর হয়ে খুলনা চলে যাই। খুলনায় ভাই-ভাবি নিবিড়ভাবে আন্দোলন এবং যুদ্ধ প্রস্তুতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭০ জন্ম নেয়া ভাতিজি মালাকে যত্ন নেয়ার দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়। বড় ভাই প্রয়াত খন্দকার মালেক, ভাবি আমাদের ৩ মাস বয়সী ভাতিজি মালাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শুরু হলো আমাদের প্রস্তুতি। 

নিজের কানে শোনা সত্যি উচ্চারণগুলো মতিভ্রম হওয়ার কারণ নেই। বাঙালি জাতি কিন্তু ৭ মার্চের পর থেকেই নানাভাবে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েছিল। গাজীপুরে মেজর সফিউল্লার নেতৃত্বে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল সম্ভবত ১৯ মার্চ বা ২০ মার্চ, ইপিআর বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীও প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল (তখন নাম ছিল ইকবাল হল) ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তাই ২৫ মার্চের কালরাতে পৈশাচিক বর্বরতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছিল পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং গোটা ঢাকা শহরজুড়েই। 

২৫ মার্চ, ১৯৭১ মধ্যরাতের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান নামের দেশের মৃত্যু হয়েছিল। আক্রান্ত হয়েই আগের প্রস্তুত রাখা স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছিলো বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে। আমি নিজেকে ২৬ মার্চ সকালে বিবিসি বাংলা সংবাদে স্বাধীনতা ঘোষণা শোনার সৌভাগ্য হবার জন্য গর্ব বোধ করি। 


শেয়ার করুন