শাহীনবাগে বিএনপি নিখোঁজ নেতা সাজেদুলের বাসায় যাওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সেই ঘটনার কুলকিনারা হচ্ছে না। ক্রমশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে ওই ঘটনার রেশ। সর্বশেষ ওই ঘটনা গিয়ে ঠেকেছে রাশিয়া-আমেরিকার বাগযুদ্ধে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিশ্বের দুই পরাশক্তির এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে বাংলাদেশ বিব্রত। কীভাবে ওই ঘটনার লাগাম টানা যাবে সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। কারণ বাংলাদেশ ইস্যুতে পরাশক্তির বাগযুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত বাগযুদ্ধে থাকবে তো! দু’পক্ষের কথাগুলো মোটেও সুখকর নয় বাংলাদেশের জন্য। যারা বাংলাদেশ প্রসঙ্গের ওপর দাঁড়িয়ে টেনে নিয়ে আসছে ইউক্রেন প্রসঙ্গও। যা নিয়ে গোটা বিশ্বই এখন তোলপাড়। জাতিসংঘ এটা নিয়ে কত কিছুই না করছে। ইউক্রেনের শষ্য ও পণ্য না পেয়ে বহু দেশে মন্দা চলছে। তৈলের দাম ঊর্ধ্বগতি, আরো কত কি। রাশিয়া এ জন্য যেমন আমেরিকাসহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে দায়ী করে। তেমনি পাল্টা রাশিয়াকে আগ্রাসন থামানোর জন্য এসব দেশসমূহ বিশাল বাজেট নিয়ে নেমেছে। ফলে ওরকম একটা ভীতিকর প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ইস্যুতে কেউ কামনা করবে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের কেউ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চাই না রাশিয়া, আমেরিকা কেউ আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাক, এটা তাদের বিষয় নয়।’ রাশিয়ার দেয়া সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বিরক্ত বাংলাদেশ। সরকার মনে করে আমেরিকা, রাশিয়াসহ অন্য কোনো দেশের অধিকার নেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর।
রাশিয়া কেন বিবৃতি দিচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি তাদের জিজ্ঞাসা করুন। আমরা চাই যে নিয়ম আছে, জেনেভা কনভেনশন আছে, সে অনুযায়ী প্রত্যেক দেশ কাজ করবে এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না। আমরা পরিপক্ব, স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ এটা সবার মনে রাখা উচিত। আমার এই বক্তব্য রাশিয়া, আমেরিকার সবার জন্য প্রযোজ্য। ওইসব ওদের জিজ্ঞাসা করুন, আমার কাছে এত ঘুর ঘুর করছেন কেন?’
বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার নিয়ে কারো মাতুব্বরির সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বলেছি যে তাদের কী রকমের ব্যবহার করা উচিত। তাদের জন্য নিয়ম আছে এবং সে অনুযায়ী তারা কথা বলবে। আমরা আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশ সম্পর্কে বলেছি, অন্য দেশ সম্পর্কেও আমাদের একই বক্তব্য।
আওয়ামী লীগ নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনোভাবে ক্ষমতায় আসেনি। আওয়ামী লীগ সবসময় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদাবোধ সমুন্নত রেখেছে। এসব নিয়ে আমাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। আমি নিশ্চিত নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক।
ঘটনার সূত্রপাত
শাহীনবাগে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুলের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত গিয়েছিলেন, ‘মায়ের ডাক’ নামক এক সংগঠনের আমন্ত্রণে। যে সংগঠনটি নিখোঁজ হওয়া, গুম ও খুনের শিকার হওয়া মানুষের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে গঠিত। সে বাসায় পৌঁছলে মায়ের কান্না নামক আরেকটি সংগঠন রাষ্ট্রদূতের অবস্থান করা সে বাসার সামনে অবস্থান নেয় এবং রাষ্ট্রদূত দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে নিরাপত্তাকর্মীদের পরামর্শে এবং তিনি বাসা থেকে বের হলে তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টা চলে। এ অভিযোগগুলো তিনি করেছেন সেখান থেকে বের হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনর সঙ্গে দেখা করে। ওই ঘঠনার পর যেমনটা বাংলাদেশের সুশীলসমাজের একটি পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতের সমালোচনা করে বিবৃতি দেয়া এবং মন্ত্রিপর্যায় থেকেও রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অভিযোগ তোলা হয়। এ বিষয়টা কঠোরভাবে দেখে খোদ মার্কিন কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উদ্বেগ জানায় যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ফোন করেন তারা, বিবৃতি দেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে তাদের দেশের নাগরিকদের সতর্কতার সঙ্গে চলার পরামর্শ দেন। আবার মার্কিন দূতাবাসে কর্মরতদের নিরাপত্তার দাবি তোলেন। এমন বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য- বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতির মধ্যেই রাশিয়ার বাংলাদেশস্থ দূতাবাস এক বিবৃতি দেয়। এ নিয়েই তোলপাড় শুরু। বসে থাকেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। তারাও তার জবাবে কথা বলেছে।
এদিকে ওই প্রসঙ্গে বিবিসি তাদের ২১ ডিসেম্বর অনলাইনে জানিয়েছে, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে ঢাকার রুশ দূতাবাস এক বিবৃতি দিয়েছে, যাতে পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাকমেইল এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার’ অভিযোগ তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিককে ইঙ্গিত করে রাশিয়ার মতো আরেকটি দেশের দূতাবাস থেকে এধরনের বিবৃতি এক নজিরবিহীন ঘটনা। রুশ দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কিছু দেশ, যারা নিজেদের ‘উন্নত গণতন্ত্র’ বলে দাবি করে, তারা অন্য সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শুধু হস্তক্ষেপই করে না, এমনকি ব্ল্যাকমেইলও করে।’
রুশ দূতাবাস থেকে ২১ ডিসেম্বর দেয়া এই বিবৃতিটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, তারা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। বাংলাদেশকে নিয়ে দুটি দূতাবাসের মধ্যে এরকম কূটনৈতিক বচসার ঘটনার অতীতে দেখা যায়নি। বিবিসি আরো জানায়, ‘ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কিছু মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, সে সময় ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস এই বিবৃতি দিল। রুশ দূতাবাসের বিবৃতিতে আমেরিকার নাম উল্লেখ না করলেও সেখানে যে আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা বেশ স্পষ্ট। এতে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকার কড়া সমালোচনা করা হয়েছে।’
বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়, বিবৃতিতে বলা হয়েছে ‘যেসব দেশ নিজেদের উন্নত গণতন্ত্র হিসেবে পরিচয় দেয় এসব ঘটনা তাদের আধিপত্য বাদের আকাক্সক্ষার চিত্র ফুটে ওঠে। জাতিসংঘের সদস্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা শুধু হস্তক্ষেপই করে না, তারা নির্লজ্জভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে।’ এর ফলে অনেক দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
একইসঙ্গে বিবিসি রাশিয়ার ওই বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, ‘যেসব দেশে নিজেদের বিশ্বের শাসক মনে করে তারা যদি কোনো দেশকে পছন্দ না করে তখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার ছলে সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে।’ রুশ দূতাবাস বলেছে, ‘অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য রাশিয়া প্রতিটি ক্ষেত্রে তার নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
ভারতকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই অনুরোধ
গত ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের জে এম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, তা করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি। তিনি বলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’
ভারত সফরের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছি, আমার দেশে কিছু দুষ্ট লোক আছে, কিছু উগ্রবাদী আছে। আমার দেশ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন না, আপনার দেশেও যেমন দুষ্টু লোক আছে, আমাদের দেশেও আছে। কিছুদিন আগে আপনাদের দেশেও এক ভদ্রমহিলা (মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে নূপূর শর্মার অবমানকর বক্তব্য) কিছু কথা বলেছিলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটি কথাও বলিনি। বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে, আমরা বলিনি। এ ধরনের প্রটেকশন আমরা আপনাদের দিয়ে যাচ্ছি। সেটা আপনাদের মঙ্গলের জন্য, আমাদের মঙ্গলের জন্য। আমরা যদি একটু বলি, তখন উগ্রবাদীরা আরো সোচ্চার হয়ে আরো বেশি বেশি কথা বলবে। তাতে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বিঘœ হবে। আমাদের স্থিতিশীলতা বিঘ্ন হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘ভারতকে বলেছি, আমরা উভয়ে উসকানিমূলক কর্মকা-কে কখনো প্রশ্রয় দেবো না। এটা যদি আমরা করতে পারি, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের মঙ্গল। শেখ হাসিনা আছেন বলে ভারতের যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। বর্ডারে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। ২৮ লাখ লোক আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর ভারতে বেড়াতে যায়। ভারতের কয়েক লাখ লোক আমাদের দেশে কাজ করে। এটি সম্ভব হয়েছে আমাদের সুন্দর অবস্থানের কারণে। সুতরাং আমরা উভয়ে এমনভাবে কাজ করব যাতে কোনো ধরনের উসকানিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়। ভারত সরকারকে বলেছি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে যদি আমরা উভয়ে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দেই।’