২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৯:১৮:৪৭ পূর্বাহ্ন


সাক্ষাৎকারে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ
আমি মনে করি নিয়তি আছে এবং নিয়তি নাই
মিলা মাহফুজা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৭-২০২২
আমি মনে করি নিয়তি আছে এবং নিয়তি নাই


অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। দেশের সবচেয়ে আলোচিত সংগঠন বিশ্বসাহিত কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বাঙালিরসংগঠন টেকে না এমন অনুযোগ উড়িয়ে দিয়ে যে প্রতিষ্ঠান সগৌরবে এগিয়ে চলেছে ৪২ বছর। তিনি একজনশিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, সাহিত্যিক। আরো অনেক পরিচয় রয়েছে তাঁর। এ দেশে তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তিনি। তাঁরসম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল অনির্বেয় আলোক শিখার মতো।

মহামারী কোভিড সংক্রমণের কারণে তিনি প্রায় দুই বছর স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে ঘরেই থেকেছেন। তাঁর মতো কর্মযোগীর পক্ষেএই কর্মহীন বন্দিত্ব কেমন ছিল? এই দীর্ঘসময় তিনি কীভাবে কাটালেন? তাঁর কৌতূহলী অনুরাগীদের জন্য এই প্রশ্নেরউত্তর জানতে তাঁর সাথে দেখা করতে যেতে চাইলাম।ভেবেছিলাম রাজি হবেন না। কোভিডের প্রতাপ কমে গেলেও তিনি এখনো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। আমার সৌভাগ্য তিনি সময় দিতে রাজি হলেন। নির্দিষ্ট দিনে চলে গেলাম তাঁর সেন্ট্রাল রোডের বাসায়। দরজা খুললেন তিনি নিজেই। গত ২৫ জুলাই ২০২২ তিনি ৮২ পার করে ৮৩ বছরে প্রবেশ করেছেন। তাঁকে দেখে বলা যায়, বয়স পরাবভ মেনেছেতাঁর কাছে। হাসিটি তেমনি প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল এবং প্রত্যয়দীপ্ত।

বহুদিন পর তাঁর বাসায় গেছি এবার। কিন্তু বাসার সেই সাদামাটা চেহারার কোনোই পরিবর্তন নেই। ছোট বসার ঘরটায়এক সেট সোফা, একটা সেন্টার টেবিল। মাথার ওপরে পুরোনো ফ্যান ঘুরছে। আমরা বসলাম বেশ দূরত্ব বজায় রেখে।তাঁর সাবধানতার কথা মনে রেখে আমি মুখের মাস্ক খুলিনি। তিনি বললেন, করোনার অতোটা দাপট নেই এখন, আমরা মাস্ক ছাড়াই কথা বলতে পারি বোধহয়। সময় বেশি দিতে পারবো না। বারোটায় আমার অন্য কাজ আছে। বাড়ির বাইরেযাই না তবে কোনো কাজই পিছু ছাড়েনি। প্রচুর লেখালেখি করছি।আমরা বসার পর একটু পরেই ভেতর থেকে তাঁর স্ত্রী রওশন আরা, যাঁকে ‘ভাবি’ সম্বোধন করি বরাবরই, এলেন। অতি সজ্জন মানুষ। আমরা যারা কেন্দ্রে কোনো সময় সংশ্লিষ্ট ছিলাম, তাদের সকলের সাথেই তাঁর হার্দ্য সম্পর্ক। আমরা কুশলবিনিময় ও অন্যান্য কথায় মেতে উঠলে ‘আসছি’ বলে স্যার উঠে ভেতরে গেলেন। ভাবি বরাবরই আমার পেন নেম পুরোটাধরে ডাকেন। তিনি বললেন, মিলা মাহফুজা, আপনার বয়স বেড়েছে তবে খুব বেশি বদলাননি। ভালো লাগলো আপনাকেদেখে।আমি হাসতে হাসতে বললাম, এটা স্যারের প্রভাব। মনে তারুণ্য ধরে রাখা।ভাবিও হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ, আপনাদের স্যার কোনোদিন বুড়া হবেন না। ৮৩ বছর বয়স হলেও মনে যথেষ্ট তরুণ।

এসময় স্যার ফিরে এলেন। আমি আবারো লক্ষ করি সম্ভবত দীর্ঘদিন ঘরে খানিকটা সুস্থির জীবন কাটানোর কারণে স্যারেরচেহারায় বেশ একটা উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে। আগের পরিশ্রমক্লান্ত ভাবটা নেই। চা, বিস্কিুট, ফল এলো। চায়ে চুমুক দিয়েস্যার সবল সতেজ গলায় বললেন, আমরা শুরু করতে পারি।

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, নির্দিষ্ট সময়ের বিশ মিনিট পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ভাবি বললেন, তাহলে আপনারা কথাবলেন, আমি ভেতরে যাই।তিনি চলে যেতে স্যারের আগের কথার রেশ ধরে জানতে চাইলাম-

প্রশ্ন:আপনি বলেছেন করোনায় অবরুদ্ধ সময়টা আপনার ব্যক্তিগতভাবে খারাপ কাটেনি। আপনার একটা কষ্ট ছিল, আপনিএকজন লেখক কিন্তু লেখার সময় পেয়েছেন কম। করোনায় বাইরে যাওয়া যায়নি, তাই কি এই সময়টা লেখার কাজে ব্যয় করলেন?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:করোনায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে প্রায় সব কর্মসূচি বন্ধরাখতে হয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে করোনায় আমার কিছু উপকার হয়েছে। লেখালেখি করেছি। প্রচুর লিখেছি তা নয়,নতুন চারটে বই লিখেছি। তবে ৩৮টা বই পরিমার্জন ও সংশোধন করেছি, দুইবার করে। প্রথম লেখার পর ওই লেখাগুলোআর দেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু বইগুলো ওই অবস্থায় বাজারে থাকুক, পাঠকের হাতে যাক, সেটা ঠিক না। বইয়েরপরিশীলিত চেহারা দেয়ার কথা ভেবেছিলাম, এবার সেটা করতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব লেখাই বহুবার সংশোধনকরতেন।

প্রশ্ন:এই বইগুলো কি কেন্দ্র সম্পর্কিত?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:না, সবগুলো কেন্দ্র নিয়ে নয়। গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, আত্মজীবনী আছে। আত্মজীবনীই ২২০০ পৃষ্ঠা। নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, আমার উপস্থাপক জীবন- এ ধরনের গোটা দশেক বইয়ের মধ্যে পড়ে। এখন একটা লিখছি, নাম ‘আলোর ইস্কুল’।এটা কত বড় হবে জানি না। আমি বইয়ের ওপর লিখে দেবো ‘পড়িবার জন্যে নহে। নাড়াচাড়া করিবার জন্য’। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি- এ বইটা হচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আইডিয়া। আর আলোর ইস্কুল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সুখ-দুঃখময় যাত্রাও সংগ্রামের গল্প।

প্রশ্ন:আলোর ইস্কুল বই শুরু করেছেন কোথা থেকে?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:কেন্দ্র গড়ার একেবারে প্রথমদিকে একদিন সাংবাদিক আবেদ খানের বাসায় আড্ডা দিতে দিতে আমি কেন্দ্রের স্বপ্নেরকথা বলি। সেই স্বপ্নের পথ ধরে একদিন আমরা দশজন সভ্য জোগাড় করে নায়েম অডিটোরিয়ামে জড়ো হই। ঠিক হলোপরের সপ্তাহে প্রত্যেকে পড়ে আসবে একটা বই। বইটি হলো জসীমউদদীনের নকশী কাঁথার মাঠ, প্রতিটি বইয়ের দামসাড়ে তিন টাকা। অর্থাৎ দশজনের জন্য দশটা বই কিনতে হলে আমাদের লাগবে পঁয়ত্রিশ টাকা। কিন্তু এতো টাকা আমাদেরনেই। অনুষ্ঠানে ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান। সেকালের ঢাকার খুব বিখ্যাত মানুষ। তিনি কিনে দিলেন বইগুলো। উনিছাড়াও আরো কয়েকজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা উপস্থিত ছিলেন সে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তারপর কত কষ্ট, কত দুঃখ, কতআনন্দের মধ্যদিয়ে চলছে আমাদের যাত্রাপথ।

প্রশ্ন:৪২ বছর হয়ে গেল কেন্দ্রের বয়স।

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:হ্যাঁ, তা হলো। এ সময়ে আমরা ২ কোটি ছেলেমেয়েকে বই পড়িয়েছি। আমার মনে হয় এর ১ শতাংশও যদি অল্পকিছুঅবদান রাখে তাহলেও তো একটা সফলতা।

প্রশ্ন:এই ২ কোটির কত পার্সেন্ট ভালো মানের কিছু করবে বলে আপনার মনে হয়?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:সেটা এভাবে বলা যাবে না। পৃথিবীর সব জায়গায় দেখা যায় ৫থেকে ৭ শতাংশ লোক হচ্ছেসক্রিয়, সৃজনশীল ও ক্ষিপ্র।যারা তাদের চারপাশে একটা ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করতে পারে। পৃথিবীতে এরাই মানব সমাজের মূলকেন্দ্র। বাকিরা ঘোরে এদেরউঞ্ছবৃত্তি করে। আমেরিকায় প্রত্যেকের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, আরো অনেক কিছু আছে। তারা নিজেরা কিন্তু এসবকরেনি। ওই ৫-৭ শতাংশ লোক, যাদের আমরা বলি সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে, তারাই করেছে। তাদের কাজেরউচ্ছিষ্ট দিয়েই বাকিদের জৌলুস।

প্রশ্ন:এই জন্যেই কি সমাজতন্ত্র টেকসই হয়নি?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:সমাজতন্ত্র প্রাকৃতিক নয়। মানুষ সমষ্টির জন্যে জীবন দেয়, কিন্তু ব্যক্তি মানুষ তার কাছে আরো বেশি প্রিয়। এ দুইয়েসমন্বয় দরকার। তার ওপর সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্র কাঠামো হয়ে পড়লো কর্তৃত্ববাদী। যদি ওটার নতুন কাঠামো বের করা যেতো,তবে হয়তো এটা টিকতো। পুঁজিবাদ থাকবে। কিন্তু বড়কে অতো বড় হতে দেয়া যাবে না। ছোটকে অতো ছোট রাখা যাবেনা। এখানেও কাঠামোর একটা নতুন বিন্যাস দরকার। আসলে সম্পদ যদি বেড়ে যায়, তাহলে ছোটোর ছোট হওয়ার একটাসীমা থাকে। আমেরিকায় ছোট অতো ছোট নয়।

প্রশ্ন:আমরা কথা বলছিলাম সক্রিয় লোক নিয়ে।

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:এই যে কোভিড হলো, সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। কথা বলছে দু’জন, দু’জনারই মাস্ক আছে,কিন্তু দু’জনারই মাস্ক নাকের নিচে। কিন্তু সবাই তা নয়। দেখা যাবে ৫-৭ শতাংশ ঠিকই সচেতন। তারা ঠিকমতোই মাস্ক পরছে। তাই ৫-৭ শতাংশ লোককেও যদি ঠিকমতো শক্তিমন্ত করে তোলা যায় তাহলেই হয়। আমরা একটা বড় ঝাঁকিজাল ফেলি, তাতে টেংরা পুঁটির সাথে দুই একটা বড় মাছও ওঠে। যদি বাঘা বাঘা দুই-তিনটা মাছ ধরা যায়, তাহলেবাকিগুলো ফেলে দিলেও অসুবিধা নেই।এই দুই কোটি ছেলেমেয়েকে আমরা বড় কিছুরস্পর্শ চেষ্টা করেছি তাদের শৈশব-কৈশোরে। যখনতাদের মন স্পর্শকাতর,তারা অনুভূতিশীল, তারা কচি, তারা গ্রহণক্ষমতাসম্পন্ন তখন। যখন তারা স্বপ্নে ভরা, যা দেখে তাই নিয়ে কৌতূহলী, যাদেখে তাই নিয়ে উৎসাহী। উৎসাহ যদি একবার রক্তের ভেতর কল্লোলিত হয়ে ওঠে তবে তার মত্ততা জীবন থেকে আর মরেনা। মানুষের শৈশব কিন্তু তার মধ্যে চিরদিনই বেঁচে থাকে। যদি অল্প বয়সে তাদের একবার উৎকর্ষময় বা স্বপ্নময় করেতোলা যায়, তবে তাদের ঝংকার তার মধ্যে চিরদিন থেকে যাবে।একটা সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে আমাদের মধ্যে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে। আমরা ওই সমুদ্রে ঝাঁপ দিই আর না দিই নীল নোনাজলের বিশালতা আমাদের মধ্যে একটাপরিবর্তন আনে। আমার লক্ষ,আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সমুদ্রের এই স্পর্শ দেয়া। হয়তো তার মধ্যে অনেকেইঝরে যাবে। মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবদের যুদ্ধে কত অক্ষৌহিনী সৈন্য যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু জয়ের পর হস্তিনা নগরে প্রবেশকরেছিল পাণ্ডবদের ক’জন!তবু শেষপর্যন্ত যদি ১ শতাংশও থাকে, তবে হয়তো তারা এই সমাজের কিছুটা পরিবর্তন ঘটাবে। কারণ সবকিছু ঝেড়েমুছে এই যে ১ শতাংশ- এ অন্তহীন সম্ভাবনাময়। এই ১ শতাংশ থেকে প্রধানমন্ত্রী হতে পারে। সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারীমানুষও হতে পারে। যদি এমন ২০০জন লোকও বের হয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই স্বপ্নের পিছনে আমি আছি।প্রত্যেকেই মহান হবে, আলোকিত হবে তা নয়। চর্যাপদের হরিণীকে যেমন পাওয়া যায় না। তাকে শুধু খোঁজা যায় আরএই খোঁজাটাই যেমন তাকে পাওয়া। তেমনি আমাদেরও চেষ্টা আলোকিত মানুষ জন্মের জন্য।

প্রশ্ন:বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ে কী সবাই আলোকিত মানুষ হবে?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:সবাই আলোকিত মানুষ হবে না, কিন্তু পৃথিবীর কোনো কাজই তো পুরো ব্যর্থ নয়। ব্রাউনিং লিখেছিলেন:

Fail I alone, in words and deeeds?

Why, all men strive and who succeeds?

Look at tha end of work, contrast

the petty done, the undone vast.  

তবে প্রত্যেকেই নিজের থেকে একটু এগোবে। যে পাঁচ ছিল সে সাত হবে। যে সাত ছিল দশ হবে। আবার যে বিশ ছিলসে হয়তো পঁচাত্তর হয়ে যেতে পারে। অঙ্ক দিয়ে এর হিসাব মেলে না। কে অনুপ্রাণিত হবে, কে কতটুকুজ্বলে উঠবে-

আমরা এসবের কতটুকু জানি! সে কারণে এটাকে সম্ভাবনার হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো। গজ ফিতা দিয়ে এ মাপা সম্ভব না।

প্রশ্ন: মোবাইল লাইব্রেরিতে সাড়া কেমন?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:মোবাইল লাইব্রেরির অবদান অনেক। এটা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো পাঠক তৈরি কার্যক্রম। আমরা স্কুল-কলেজে পাঁচবছরে ১০০টা নির্বাচিত বই পড়াই। কিন্তু মোবাইল লাইব্রেরিতে গাড়ি ভর্তি বই পাঠকদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।আর ওই বয়সে বই ভর্তি এরকম একটা গাড়ি পাওয়া! গাড়ি থেকে আলো আমার আলো গানটা কানে এসে বাজে।চারপাশের ঘরবাড়ি থেকে ছেলেমেয়েরা দৌড়ে আসে। বই নেয়, এভাবে বছরের পর বছর পড়ে। এতে ভালোছেলেমেয়েদের ছোট ছোট সংঘ গড়ে ওঠে একসঙ্গে তারা অসম্ভবের স্বপ্ন দেখে। ওই ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে পড়াশোনাঋদ্ধ একধরনের ছেলেমেয়ে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া যাদের প্রতিভা আছে, তারা যদি এই সুবিধা পায় তাহলেতো কথাই নেই। প্রতিভাবানদের অনেক সময় অতো পড়তেও হয় না। তবে আরো বড় ট্যালেন্ট হতে গেলে, রবীন্দ্রনাথহতে গেলে পড়তে হবে। মাইকেল, বঙ্কিম, রামমোহন হতে গেলে পড়তে হবে। বড় প্রতিভাবানদের এগুলো না পড়েউপায় নেই।

প্রশ্ন:বর্তমানের তরুণ লেখকদের লেখা পড়েন?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:তরুণদের লেখা কিছু কিছু পড়ি। মাশরুরের আগস্ট আবছায়া পড়লাম। কিছুদিন আগে এটার জন্যে সেআইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছে। ওর অনুবাদ করা জার্মান লেখক ফ্রানৎস কাফকার গল্পসমগ্র পড়েছি। খুব ভালোলেগেছে।

প্রশ্ন:অনুবাদটা মূলের কাছাকাছি মনে হয়েছে?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:সেটা বলতে পারি না। কারণ জার্মান জানি না। তাছাড়া ও জার্মান থেকে অনুবাদ করেছে কিনা তাও জানি না। তবেওর বাংলাটা ভালো। আহমদ মোস্তফা কামালও সুন্দর বাংলা লেখে। খুব ঝরঝরে। ওর চাউনি বেশ নতুন।কী গল্পে, কীপ্রবন্ধে। জাকির তালুকদারের গল্প আমার খুব প্রিয়। বেশ কয়েকজন তরুণ কবিও আশাজাগানিয়া। এখনকার অনেকতরুণই ভালো বাংলা লিখতে পারছে না। হয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা, নয়তো ভালো মানের সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগেরঅভাব- যে কোনো কারণেই হতে পারে।

প্রশ্ন:এখনকার কোনো কোনো লেখক মনে করেন তিনি লেখার ফর্ম ভেঙে নতুন ফর্ম তৈরি করছেন। এ বিষয়ে আপনার মতকি?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:ফর্ম যে ভাঙতে পারেনি, সে তো লেখকই হয়নি। ওটাই তো লেখক জীবনের হাতেখড়ি। তবে ভাঙাচুরা যাই হোকলেখার একটা নিজ বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। ফুটবল খেলতে গেলে উন্মুক্ত জায়গায় খেলা যায় না। সুতরাং চারদিকে দাগদিয়ে একটা আয়তক্ষেত্র বানিয়ে নিতে হয়। যতো কালোয়াতি আর কারুকাজ এই ক্ষেত্রের ভেতরে। সারা পৃথিবীময় তোছবি আঁকা যায় না তার জন্যে আলাদা করে ইজেল লাগে, একটা ক্যানভাস লাগে, এই যে আটকে দেয়া হলো চারদিক,এতে ইমাজিনেশনের চূড়ান্ত প্রয়োগের সুযোগ করে দেয়া হলো। তা না হলে সব প্রতিভা তরল পদার্থের মতো ছড়িয়েযাবে। ভাষাও তাই। নদীর যেমন দুটো পাড় থাকে এ-ও তেমনি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিলের পানিকে গ্রামের কেউ মূল্য দেয় না। বলে বোবা জল। কিন্তু নদীর পানিকে মূল্য দেয়, কারণ ওর পাড় আছে বলে ওর ধৌত আছে, ধৌত আছে বলেওর প্রাণপ্রবাহ আছে। প্রাণপ্রবাহ আছে বলে ওর ঝংকার আছে এবং তার একটা অর্থ হয়। লিখতে গেলে ফর্মভাঙতেই হবে। না হলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল বা জীবনানন্দের পার্থক্য হবে কী করে! না হলে সাহিত্য তো স্থানুরমতো একখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। যেখানে চারপাশের সমাজ আর পৃথিবীর মধ্যে অহর্নিশ ভাঙচুর চলছে সেখানে কি সাহিত্য একঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?

প্রশ্ন:পশ্চিমবঙ্গে কি সাহিত্যের মান পড়ে যাচ্ছে?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:পশ্চিমবঙ্গ এখন পেরিফেরিতে চলে গেছে, প্রান্তিক একটা প্রদেশ। যেমনটা পাকিস্তান আমলে ছিলাম আমরা। ভারতেব্যাপারটা আরো প্রচণ্ড। এতো বিশাল দেশ, সেখানে একপ্রান্তে কে কী করছে কে তার খোঁজ রাখে। সেখানে জীবনের গতিনাই, মানুষের স্বপ্ন নাই, একদম প্রায় আকরিক জীবন। বড় শক্তি, বড় আন্দোলন কিছুই নাই। তবু দীর্ঘদিনের বৈভব আরঅস্তিত্বের কারণে কলকাতার চোখে আজো একটা স্বপ্ন বেঁচে আছে, সৃজনশীলতায় কলকাতা আজো কারো চেয়ে পিছিয়েনেই। কিন্তু ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর তুলনায় আজকের কলকাতা কোথায়? এদিকে বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র। এখানে কতউত্থান হবে, পতন হবে, কত রাজদ্রোহ হবে, কত দমন কত বিজয় স্তম্ভ হবে। কত মহানুভব মানুষ আসবে একদিন এখানে।ন্যায়ের জন্য কত মানুষ আত্মোৎসর্গ করবে। না, এই মুহূর্তে এসব হবে না। এখনই হবে না, একেবারে প্রথম অবস্থা তো,এখন আমাদের ছলেবলে কৌশলে দুই পকেট ভরার সময়। এখন আমরা বিশ্ববাণিজ্যায়নের দিকে এগোচ্ছি। পৃথিবীজুড়েআজকে বিত্ত-সম্পদের জোয়ার এসেছে। তবে আজকের বিশ্ববাণিজ্যায়নের এই উন্মাদনা একশ বছরের বেশি টিকবে বলেমনে হয় না। হয়তো একটা সময় আসবে যখন আজ যারা বিত্ত সঞ্চয় করছে, তাদের উত্তরপুরুষেরা এই টাকা জনগণকেফিরিয়ে দেবে। টাকার জন্যে আজকের যে ক্রেজ তা হয়তো তখন থাকবে না। অ্যাবার একটা গান আছেÑ মানি মানি মানিমাস্ট বি ফানি ইন এ রিচম্যানস ওয়ার্ল্ড। টাকা বেশি হলে টাকা হাস্যকর হয়ে যায়। সামনের পৃথিবীতে এমন একটা ঘটনাঘটার সম্ভাবনা আছে বলে আমার আশঙ্কা হয়।এই মুহূর্তে সব মূল্যবোধ পিষ্ট হয়ে একেবারে বিনষ্ট হয়ে আছে, একমাত্র কাক্সিক্ষত এখন অর্থ। তবুএই অবস্থাটা এরকমথাকবে না। অর্থ আরেকটু বাড়লে দেখা যাবে নতুন কালের গৌতম বুদ্ধরা রাজপ্রাসাদ থেকে নেমে আসবে। এইসর্বস্বত্যাগীদের জন্মের জন্যে রাজপ্রাসাদ লাগে। রাজপ্রাসাদ ধ্বংস করার জন্যও রাজপ্রাসাদ লাগে।

প্রশ্ন:সুতরাং আমরা হতাশ না হয়ে অপেক্ষায় থাকি।

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:শুধু এই অপেক্ষায় নয় সক্রিয়ও থাকতে হবে। সংস্কৃতিতে একটা প্রবাদ আছে- চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখাংনিচ দুখানিচ। সুখ-দুঃখ চাকার মতো ঘুরছে। কখনো সুখ ওপরে, কখনো দুঃখ ওপরে থাকে। আমাদের এখন দুঃখ ওপরে উঠে গেছে। তবুচাকা কিন্তু ঘুরছে। এখন আমি যদি শুধুতাকিয়ে ওই ঘোরাটাই দেখতে থাকি, তাহলে তো ওর ঘোরাটা জোরালো হবে না।যদি আমরা দু’হাতের ধাক্কায় চাকাটাকে আরো জোরে ঘুরিয়ে দিতে পারি, তাহলে আমরা সুখের দিন অনেক আগে পাবো।

প্রশ্ন:এককথায় আপনি আপনার কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে পছন্দ করেন?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ : আমার পরিচয় নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। কেউ ভাবেন আমি মাস্টার, কেউ ভাবেন সাহিত্য আন্দোলন নিয়েকাজ করা লোক, কেউ ভাবেন টিভির লোক, কেউ ভাবেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করি। কেউ দেখেন পরিবেশ আন্দোলনকারীহিসেবে, কেউ জানেন আমি বক্তৃতা করে বেড়াই। একটা মানুষ এতোখানি বহুরূপী হলে লোকে কিছুটা বিভ্রান্ত হবেই। যারকাছে যে চেহারাটা সামনে আসে সেটাকেই সে ধরে নেয়। যার চোখে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পড়ে সেভাবে আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লোক। যে ছাত্র পড়াতে দেখে সে ভাবে শিক্ষক, এইতো। তবে এসবের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় প্রতিটিব্যাপারই কিছুটা মূল্যহীন হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা।

প্রশ্ন:আপনি কি নিয়তিতাড়িত মানুষ?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:আমি মনে করি, নিয়তি আছে এবং নিয়তি নাই। ধরেন, আপনি একজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ এই অবস্থায় একটা দশটাকার লটারিতে দশ কোটি টাকা পেয়ে গেলেন, আপনি বলবেন, এটা আমার ভাগ্য। কিন্তু যার হাজার কোটি টাকা আছে,সে এটাকে কি এতোগুরুত্ব দেবে? কাজেই কোনটা ভাগ্য আর কোনটা ভাগ্য নয়, তা নির্ভর করে মানুষের অবস্থানের ওপর।আমাদের জীবনটা অ্যাক্সিডেন্টাল। আমি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ডান পা আগে ফেলেছি, হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে গাড়িরনিচে চাপা পড়লাম। কিন্তু বাঁ পা আগে ফেললে হয়তো একটা গাড়ির মালিক হয়ে যেতাম। জীবন অ্যাক্সিডেন্টাল তবুতারমধ্যেও একটা প্রচ্ছন্ন নিয়ম আছে।

প্রশ্ন:বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য কি আপনি লেখকসত্তাকে বিসর্জন দিয়েছেন?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:আমার বাবা সাহিত্যের লোক। আমার পরিবারে সাহিত্য। ছোটবেলা থেকে সাহিত্যের মধ্যে বড় হয়েছি। আমারমনটাও সাহিত্যমুখী। সুতরাং লেখক হওয়াই আমার পক্ষে ছিল স্বাভাবিক।কিন্তু একসময় আমার ভেতরে দ্বন্দ্ব শুরু হলো- আমি বড় না, আমরা বড়? যেদিন এই দ্বন্দ্ব শুরু হলো সেদিন আমার মনেহলো- আমিই শুধু লেখক হবো? তাহলে আমি তো স্বার্থপর হয়ে গেলাম না! আমি কি একাই পড়বো, একাই আলোকিতহবো? সব মানুষকে আলোকিত হতে হবে না? এমনি করে ‘আমি’ ছেড়ে ‘আমরা’র দিকে যাত্রা শুরু হলো।

প্রশ্ন:তাহলে এই দ্বন্দ্বই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বীজমন্ত্র?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:এই দ্বন্দ্বে পড়ে আমার লেখক সত্তা দ্বিতীয় হয়ে গেল। এতোদিনে আমি মাত্র ৪০টা বই লিখতে পেরেছি। তবে এটানিয়তি তাড়িত হয়ে নয়, সজ্ঞানে। আমার জন্মগত প্রবৃত্তির তাড়না আমাকে ও পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে। তবে ‘আমি’রদিকেও আমি হাঁটতে পারতাম। কারণ দুদিকেই আমার সমান প্রবণতা ছিল। কিন্তু সমানে তখন নতুন দেশ। একটা বড়জাতিতে নির্মাণ করার পর্ব। তাই ‘আমরা’র কাছে ‘আমি’ হেরে গেল।

প্রশ্ন:আপনি সবসময় বলেছেন নতুন বাংলাদেশ গড়তে লক্ষ লক্ষ নির্মাতা প্রয়োজন। তারা কি তৈরি হয়েছে?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ: তৈরি কখন কীভাবে হয় তা কী করে বলবো। তৈরি হতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু যদি হয়ও কীভাবে কোন দৈব স্পর্শেকে বলতে পারে, তার জবাব কে দিতে পারে! রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে- এক খ্যাপা পরশ পাথর খুঁজে বেড়াচ্ছিল।পরশ পাথর সেই পাথর যার স্পর্শে লোহা সোনা হয়ে যায়। সমুদ্রপাড়ে দিনের পর দিন পাগলের মতো খোঁজার পরএকদিন সে আবিষ্কার করলো তার হাতের বালাটা সোনা হয়ে আছে। সে বুঝলো পরশ পাথর খোঁজার কোনো একসময় সেএর স্পর্শ পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে তাকে চিনতে পারেনি। আমরাই কি এই পরশ পাথরদের সবসময় চিনতে পারি?

প্রশ্ন:বাংলাদেশ কি উন্নতির দিকে এগোচ্ছে?

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ:বাংলাদেশ বস্তুগত উন্নতির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু নৈতিক দিকে অগ্রসর হয়নি, বরং পিছিয়েছে। এই ঢাকা শহরেএকদিন বাঘ ছিল, চিতাবাঘ ছিল বিস্তর। আমার স্কুলজীবনেই বিজয় সরণির ওদিকে গেলে গা ছমছম করতো। এই শহরেএখন সারা দেশের সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। দশ বছর পরে এখানে যানজটের বেশ উন্নতি হবে। ফুটপাত দখল কমবে।গণপরিবহনে রাস্তা ভরে উঠবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকার চেহারা অনেকটাই বদলে যাবে। দৃষ্টিনন্দন হবে কিন্তু ব্যাপারটা হলো যে, টাকা থাকলে আমরা প্রাসাদ বানাতে পারি, কিন্তু প্রাসাদে থাকার জন্য রাজহৃদয় দরকার, সেইরাজহৃদয় একদিনে কোথায় পাবো? আমাদের প্রাসাদ হচ্ছে, কিন্তু রাজহৃদয় যে দূরআস্ত।তবে তাও হবে। আমি আশাবাদী মানুষ।

সাক্ষাৎকারগ্রহণ:

কথাসাহিত্যিক মিলা মাহফুজা

০৯/০৪/২০২২

সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা।


শেয়ার করুন