৩০ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ৬:৩৯:১০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
যুক্তরাষ্ট্রে এবার বন্দুকধারীর গুলিতে তিন আইনশৃংলাবাহিনীর সদস্য নিহত ‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের প্রতিভা বিকাশে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা রাখা যাবে না’ সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে - আসাদুজ্জামান খান কামাল ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ‘বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নিন’ ভূল স্বীকার করে সরে দাড়ানোয় একজনের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার বাফেলোতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত ‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ


পাল্টাপাল্টি হামলার হুঙ্কার : মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা
মো. তৈয়বুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৪-২০২৪
পাল্টাপাল্টি হামলার হুঙ্কার : মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা


সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলায় দুই জেনারেল ও উচ্চপদস্থ সাত সামরিক কর্মকর্তাসহ ১১ জন নিহত হয়। এতে ইসরাইলকে সন্দেহ করে বদলা নেওয়ার ঘোষণা দেয় ইরান। তেহরান নিজ ভূখণ্ড থেকে গত ১৩ এপ্রিল শনিবার সরাসরি ৩ শতাধিক ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও মিশাইল নিক্ষেপ করে। তা আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্যান্স, জর্ডানসহ ইসরাইলের সেনাবাহিনী আকাশেই ৯৯ শতাংশ প্রতিহত করে। সাত স্তরের নিরাপত্তা ভেদ করে ৯টি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের ভূখন্ডে আঘাত হানে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। এদিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাব দেবে তার দেশ- এমন মন্তব্য করেছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর প্রধান। তবে সেই হামলা কিভাবে হবে তা প্রকাশ করেনি। তবে পাল্টা হামলা না করতে পশ্চিমা ইসরাইলি মিত্ররা নেতানিয়াহুর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ইরানে পাল্টা হামলায় অংশ নেবেন না তারা। তবে ইসরাইলকে রক্ষায় যা কিছু করার দরকার তা তারা করবে। অপরদিকে ইসরায়েল পাল্টা কোনো হামলা চালালে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দেবে ইরান। সেই পদক্ষেপ হবে আরও কঠোর ও ভয়াবহ। এমন হুঙ্কার দিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরি কানি। দেশটির অন্যতম বার্তা সংস্থা আইএসএনএ ও এবিসি নিউজ এ খবর প্রকাশ করে।

এদিকে নিজেদের পরবর্তী পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান (চিফ অব স্টাফ) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাগেরি। সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। মোহাম্মদ বাগেরি বলেন, ইসরায়েল যদি এ হামলার জবাব না দেয় তাহলে দেশটিতে আর হামলা পরিকল্পনা নেই ইরানের। ইসরায়েলের যেসব লক্ষ্যে হামলা চালানো হয়েছে তার সবই পূরণ হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। হামলা পাল্টা হামলার হুঙ্কার দিচ্ছে দুই দেশই। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করছে পুরো বিশ্ব।

ইরানে হামলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েল 

ইরানের নজিরবিহীন হামলার জবাব দিতে দেশটির ওপর সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী। সোমবার (১৫ এপ্রিল) ইসরায়েলি স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু। ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম কেএএন জানিয়েছে, তেল আবিব একটি সীমিত জবাব দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এর ফলে হামলার ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে পারবে তেহরান। এ ছাড়া সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানো যাবে।

সম্প্রচার মাধ্যমটি বলছে, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাকে প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে রাখতে চাইছে ইসরায়েল। তাই নতুন করে দ্বিতীয় আর কোনো যুদ্ধ ফ্রন্ট খুলতে চায় না দেশটি। ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলাটির ধরন কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছে কেএএন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের ভেতরে গুপ্ত হত্যাকাণ্ড বা বড় ধরনের সাইবার হামলা করতে পারে তেল আবিব। গত শনিবার রাতে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবারের মতো ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ইরান। মূলত চলতি মাসের শুরুর দিকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে ইসরায়েলি বোমা হামলার জবাবে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে এই পাল্টা হামলা করে তেহরান। ১৫ এপ্রিল সোমবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর প্রধান বলেছেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাব দেবে তার দেশ। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা জবাব দেওয়া থেকে বিরত থাকতে তেল আবিবকে চাপ দিয়ে আসছে। গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে দেশটির কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে ইসরায়েল। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে একের পর এক হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিল ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকেও দাবি করা হয়, ইসরায়েলে হামলায় ব্যবহারের জন্য শতাধিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করেছে ইরান। যে কোনো সময় এ অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানায় ইসরায়েল।

কয়েক সেকেন্ডেই জবাব দেবে ইরান 

ইসরায়েল পাল্টা কোনো হামলা চালালে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দেবে ইরান। সেই পদক্ষেপ হবে আরও কঠোর ও ভয়াবহ। এমন হুঙ্কার দিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরি কানি। দেশটির অন্যতম বার্তা সংস্থা আইএসএনএ ও এবিসি নিউজ এ খবর প্রকাশ করে। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এক বিবৃতিতে বলেন, ইরান মনে করে ইসরায়েলকে একটি উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানের স্বার্থের ওপর যে কোনো ধরনের আগ্রাসন চালানো হলে কঠোর জবাব দেওয়া হবে। হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ, যা ইরানের আত্মরক্ষার বৈধ অধিকারের আওতায় পড়ে। আমাদের দেশের স্বার্থের ওপর ইসরায়েলি আক্রমণের প্রতিক্রিয়া এটি।’ এ সময় আবার আক্রান্ত হলে যে কোনো পদক্ষেপের জন্য ইরান প্রস্তুত বলেও জানান তিনি। এদিকে ১৬ এপ্রিল মঙ্গলবার কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির সঙ্গে কথা বলেছেন ইব্রাহিম রাইসি। তিনি তখন বলেন, ‘ইরানি স্বার্থের বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধীর ন্যূনতম পদক্ষেপ অবশ্যই কঠোর, বিস্তৃত এবং বেদনাদায়ক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে মোকাবিলা করা হবে।’

অপরদিকে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরি কানি বলেন, ইসরায়েল যদি পাল্টা হামলা চালায় তবে ইরানের প্রতিক্রিয়ার গতি হবে কয়েক সেকেন্ডেরও কম। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে নিজেদের কনস্যুলেটে হামলার জবাবে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে ইরান। গত শনিবার রাতের এ হামলায় শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে দেশটি। ইরানের নজিরবিহীন হামলার জবাব দিতে দেশটির ওপর সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী। সোমবার (১৫ এপ্রিল) ইসরায়েলি স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু। এতে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইসরায়েলের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার জবাবে একের পর এক হুঙ্কার দিচ্ছে ইরান। সোমবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর প্রধান বলেছেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাব দেবে তার দেশ। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধ এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা জবাব দেওয়া থেকে বিরত থাকতে তেল আবিবকে চাপ দিয়ে আসছে।

এদিকে নিজেদের পরবর্তী পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান (চিফ অব স্টাফ) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাগেরি। সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। মোহাম্মদ বাগেরি বলেন, ইসরায়েল যদি এ হামলার জবাব না দেয় তাহলে দেশটিতে আর হামলা পরিকল্পনা নেই ইরানের। ইসরায়েলের যেসব লক্ষ্যে হামলা চালানো হয়েছে তার সবই পূরণ হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ইসরায়েলের কোনো বেসামরিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যবস্তুতে ইরান হামলা চালায়নি। দেশটিতে হামলায় কেবল সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করা হয়েছে। হেরমন পর্বতে ইসরায়েলের একটি গোয়েন্দা ঘাঁটিতে হামলা করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ইরানের হামলায় ইসরায়েলের এ ঘাঁটি দুটিই উল্লেখযোগ্যভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সেগুলোকে নিষ্কিৃয় করা হয়েছে। শনিবারের হামলার চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী হামলা চালাতে তেহরান সক্ষম বলেও দাবি করেন তিনি।

মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মোড় : ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর তাবৎ দুনিয়া নড়েচড়ে বসেছে। তিন শতাধিক ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। যদিও বদলে যেতে বসেছে বিশ্বরাজনীতির সমীকরণ। সামরিক, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থাকার পরও ইসরায়েল পাল্টা তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর পথে পা বাড়ায়নি- যেমনটি দেখিয়েছিল গত বছরের অক্টোবর হামাস পাঁচ হাজারের বেশি মিসাইল নিক্ষেপের পর। অন্যদিকে পশ্চিমা মিত্ররা একদিকে যেমন ইসরায়েলের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে, অন্যদিকে তেমনি দেশটিকে নিশ্চুপ থাকার পরামর্শও দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কার্বি জানিয়েছেন, ‘যাই ঘটুক না কেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন মনে করেন না যে এই সংঘাত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে গড়াবে।’ ইতোমধ্যেই এ নিয়ে আলোচনার জন্য জি সেভেন জোটের বৈঠক ডাকা হয়েছে। ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার ইউরোপীয় দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মিলিত হতে চলেছেন ‘অতি জরুরি’ বৈঠকে।

অনেকেরই ধারণা, আকাশপাতাল সর্বত্র সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষা-প্রযুক্তির জাল বিছিয়ে রেখেছে ইসরায়েল। এই সক্ষমতার দম্ভ থেকেই তারা ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়ে গত কয়েক মাসে হত্যা করেছে ৩১ হাজারের বেশি নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষকে। কিন্তু শুধু ফিলিস্তিনিদের দমিয়ে রাখা তাদের উদ্দেশ্য না। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে খবরদারির স্বপ্ন রয়েছে এই জাতির, যারা হাজার বছর ধরে ইউরোপে প্রবাসী ছিল। প্রায় একশ বছর আগে ইসরায়েলে ফিরে আসতে শুরু করার পর থেকে প্রতিনিয়ত আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে দেশটি। আরব জাতিসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সুযোগে ১৯৪৮ সালে তারা নিজেদের জন্য স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন করতে যেমন সক্ষম হয়, তেমনি ৮০ শতাংশের বেশি ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করে। বর্তমানে যে লাখ বিশেক ফিলিস্তিনি গাজা উপত্যকায় গাদাগাদি করে প্রায় বন্দি অবস্থায় রয়েছে তাদেরও সবাইকে হয়তো নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায় তারা। শুধু পশ্চিমাদের কূটনীতি ও সামরিক শক্তির জালই নয়, ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর বিভক্তিও ফিলিস্তিন ইস্যুকে জটিল করে তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার পর ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির এই তাৎক্ষণিক পাল্টা প্রকাশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বাধ্য করছে বিশ্বরাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে। 

প্রসঙ্গত, গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালায় ইসরায়েল, যার মধ্য দিয়ে নতুন মোড় নেয় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সিরিয়ার বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে শতাধিক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। যা তারা নিজেরা সদম্ভে স্বীকারও করেছে। ইসরায়েলের এই খবরদারির বিরুদ্ধে ইরান মাঝেমধ্যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেও সরাসরি ইসরায়েলে হামলা করেনি। কিন্তু কনস্যুলেট আক্রান্ত হওয়ার পর ৭২ ঘণ্টা আগে ঘোষণা দিয়ে গত শনিবার প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের ভূখণ্ডে সরাসরি তিন শতাধিক ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে তারা। যদিও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা এসব ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ শতাংশের বেশি গুলি করে ভূপাতিত করেছে। তবে পরে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, ইরানের অন্তত নয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দুটি বিমানঘাঁটিতে আঘাত করেছে। বিস্তৃত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও দেশটির মিত্র শক্তিগুলোর ছোড়া গুলি এড়িয়ে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছেছে এসব ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের নেভাটিম বিমানঘাঁটিতে আঘাত করেছে। এতে একটি রসদবাহী উড়োজাহাজ, একটি রানওয়ে ও একটি স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে। আরও চারটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছে নেগেভ বিমানঘাঁটিতে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ উদ্যোগে তৈরি অ্যারো-৩ বিশেষত হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই ধ্বংস করার জন্য তৈরি হয়েছে। যা ভেদ করতে পেরেছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র।

নয়টি ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ঘটনা এখন ইসরায়েলের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন এ দেশটির কোনো সংশয় নেই, ইরান হামলা করতে পারে এবং কোনো ধরনের হামলা পরিচালনা করলে তার সামরিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশেও দ্বিধা করবে না। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যত দুর্ভেদ্যই হোক, সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ব্যাপক পাল্টা আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর সুযোগ নেই। গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলের সেনাসদস্য, বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ইসরায়েল এই সংখ্যা প্রথমে ১৪০০ বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেও পরে সেটিকে সংশোধন করে ১২০০ বলে ঘোষণা করে। যা ছিল এ দেশটির অহংকারী শাসকদের জন্য বিব্রতকর এবং তাদের জাতিগত মানসিক অশান্তির জন্যও যথেষ্ট। এ ঘটনার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ইরানের এমন ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা তাদের আবারও বিব্রতকর, অশান্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিল।

গত শনিবার ইরান এই হামলা চালানোর পর দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি পরদিন রবিবার বলেছেন, ‘যদি ইহুদিবাদী শাসক (ইসরায়েল) বা তার সমর্থকরা বেপরোয়া আচরণ করে, তাহলে তারা একটি নিষ্পত্তিমূলক এবং আরও অনেক শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখতে পাবে।’ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তিনি ‘নিষ্পত্তি’ বলতে এমন কোনো আক্রমণের কথা বুঝিয়েছেন যাতে ইসরায়েল ‘শান্ত হতে বাধ্য হয়’। পশ্চিমা বিশ্লেষকরাও মধ্যপ্রাচ্যে বড় রকম অশান্তি বা রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন। ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ভর করছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অবস্থানের ওপর। এই উগ্র জাতীয়তাবাদী ধর্মবাদী নেতা বলেছেন- ‘আমরা প্রতিহত করেছি, হটিয়ে দিয়েছি, আমরা জয়ী হব।’ ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে নেতানিয়াহু এ কথা বলেন। এখন পর্যন্ত তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেননি; তবে প্রতিশোধমূলক কোনো পদক্ষেপ যে তিনি নেবেন তা তার চরিত্রে পরিষ্কার। ১৯৮২ সালে তিনি ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের উপরাষ্ট্রদূত থাকার সময় অল্প দিনেই মার্কিন টেলিভিশনের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন, যেখানে উগ্রবাদিতা ছিল তার ট্রেডমার্ক।

১৯৮৮ সালে নেতানিয়াহু দেশে ফিরে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট কেনেসেটে লিকুদের সদস্য নির্বাচিত হন। তখন থেকেই তার উগ্র জাতীয়তাবাদী চেহারা দেখতে পায় বিশ্ববাসী। পরে তিনি লিকুদ পার্টির চেয়ারম্যান হয়ে ফিলিস্তিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনার সমালোচনা শুরু করেন। চিরকালই তিনি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার ঘোর বিরোধী। তিনি কখনও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে আপস করেননি। ২০১৯ সালে তিনি ইসরায়েল রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কখনোই হবে না। মানুষ যেমনটি বলছে তেমনটি তো নয়ই। এটা কখনোই হবে না।’ ২০২২ সালে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টর সরকার গঠন করেন এবং বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রস্তাব আনেন। তার এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে এখনও প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য অতল গহ্বরের দ্বারপ্রান্তে : জাতিসংঘ মহাসচিব

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য অতল গহ্বরের দ্বারপ্রান্তে।’ গত ১৪ এপ্রিল রবিবার তিনি হামাসকে সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে বলেছেন। অন্যদিকে গাজায় মানবিক সহায়তার অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতি। এ দুটি বিষয়ে দরকষাকষি হওয়া উচিত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। গুতেরেস বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্য অতল গহ্বরের দ্বারপ্রান্তে।’ তিনি বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের মানুষ একটি পরিপূর্ণ ধ্বংসাত্মক সংঘাতের মুখোমুখি। তারা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এখনই তাদের খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনা জরুরি। আর এ দায়িত্ব সবার।’ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভার শুরুতে ভাষণে গুতেরেস এসব কথা বলেন। স্থানীয় সময় রবিবার বিকালে ইসরায়েলের অনুরোধে ইরানের হামলা নিয়ে এ সভা শুরু হয়। এতে নিজ নিজ দেশের অবস্থানের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েল ও ইরানের রাষ্ট্রদূতরা। 

তেরেস বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দিক থেকে বড় বড় সামরিক পক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে। ফলে ইতোমধ্যে সেখানকার বেসামরিক নাগরিকরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। তাই এখনই সময়, সবাইকে যুদ্ধের কিনারা থেকে ফিরে আনার।’ তিনি বলেন, ‘ইরান-ইসরায়েল-গাজা সংঘাত যাতে আবার উস্কে না যায় তা প্রতিরোধে সবার দায়িত্ব রয়েছে। সবাইকে সক্রিয়ভাবে এই দায়িত্ব পালনের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।’

কৌশলগত পরিকল্পনার পরামর্শ বাইডেনের 

ইসরায়েল ইরানে পাল্টা হামলা চালাবে কি না, তা এখনও জানা যায়নি। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বরাতে একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, সতর্কতার সঙ্গে কৌশলগত পরিকল্পনা করতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পরামর্শ দিয়েছেন জো বাইডেন। ইরানের সরাসরি হামলার পর বাইডেন এই পরামর্শ দেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই পরামর্শ নেতানিয়াহু নিশ্চয় গভীর চিন্তার সঙ্গে নিয়েছেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। ফিলিস্তিন বা ইরান প্রসঙ্গে নেতানিয়াহু সব সময় হুঙ্কার দিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত হলেও ইরানের হামলার পর বেশ নমনীয় হয়ে আছেন। ইরানি হামলার ‘উল্লেখযোগ্য জবাব’ দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। প্রধান মিত্রের কাছ থেকে উস্কানি না পেয়ে হতাশ হয়েও থাকবেন নেতানিয়াহু। যদিও তার চরিত্রে দমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ অতীতে দেখা যায়নি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান আকস্মিকভাবে হামলা চালায়নি ইসরায়েলে। ইসরায়েল তথা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ইরানের দীর্ঘ প্রস্তুতি রয়েছে। পশ্চিমারা নানাভাবে চাপে রাখলেও ইরান কখনও তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসেনি এবং ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি জোরদার করে চলেছে। তাই গত শনিবার ইসরায়েলে পরিচালিত ইরানের এই হামলা হয়তো সত্যিই ‘নিষ্পত্তির’ উদ্দেশ্যে। এখন ইসরায়েল পাল্টা হামলা করলে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। আর সেখানে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হতে পারে দুই পক্ষের মিত্ররা। ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান যুদ্ধের পাশে নতুন এমন যুদ্ধের আশঙ্কা বিশ্বপরিস্থিতিকে যে আরও জটিল করে তুলবে, এতে কোনো সংশয় নেই।

শেয়ার করুন