১২ এপ্রিল ২০১২, বুধবার, ০২:০৮:৩৬ অপরাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৮-২০২২
কথার কথকতা


হালকা বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেও একসময় তা ভারী বিষয়ে পরিণত হয়ে যায়, এটা কার দায়, আমার না কি বিষয়ের? উত্তরটা অতো সোজা নয়। এ বিষয়ে স্বল্পজ্ঞানী হুট করে কিছু একটা বলে বসবেন, কিন্তু বিজ্ঞজন হয়ে পড়বেন নির্বাক এবং চিন্তিত। এই সুযোগে একটু স্মৃতিচারণ করা যাক। ১৯৯৫ সালে আমি বাংলাদেশ অবজারভার ছেড়ে দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় চলে যাই। ছাত্রজীবনে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার কারণে আমার বিভিন্ন মিডিয়া কানেকশন গড়ে উঠলেও পেশাগতভাবে তা স্থাপিত হয় অবজারভারের মাধ্যমে, ১৯৮১ সালের দিকে। কয়েক বছরের মধ্যেই অবজারভার কম্পিউটার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারি অফিসগুলোতে কম্পিউটার ব্যবহারের অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছিলো কমপিউটার সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য। ওপর থেকে আওয়াজটা আসলেই সংশ্লিষ্ট লোকজনের জ্বর এসে যেতো টেনশনে। যা-ই হোক, এর অনেক আগেই অবজারভার কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করে। আমি আমার আরো দুই সহকর্মীকে উৎসাহিত করে তিনজনই ভর্তি হয়ে গেলাম সায়েন্স ল্যাব এলাকায় এক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে তিন মাসের প্রোগ্রামিং কোর্স, মোট দুটো পরীক্ষা হবে। পাস করলে সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে, জ্ঞান আহরণ তো হবেই। অর্ধেক সময় পার হলে প্রথম পরীক্ষা হলো, আমরা তিনজনই পাস করলাম, কিন্তু এরপর থেকে আমার অন্য দুই কলিগ ক্লাস করা বন্ধ করে দিলেন। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে চালিয়ে যেতে থাকলাম। প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্ণধার আসাদ সাহেব ভদ্র মানুষ, অবজারভার হাউজ থেকে আসা বয়স্ক ছাত্রগুলো পেয়ে তিনি অন্যরকম একটা আনন্দ পাচ্ছিলেন এবং আমাদের ব্যাপারে খুবই মনোযোগী ছিলেন। ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত অন্য ছাত্রদের সাথে আমি একাই চালিয়ে গেলাম, আমার দুই কলিগ আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেন। ফাইনাল পরীক্ষা হলো। পাস করলাম কিন্তু ফল হলো তৃতীয় বিভাগে পাস। আমি বললাম, স্যার এটা আমার জন্য ইজ্জতের ব্যাপার, কমপক্ষে সেকেন্ড ক্লাস পেতে হবে। তিনি বললেন, আবার পরীক্ষা দিন। দিলাম, সেকেন্ড ক্লাস পেলাম, সার্টিফিকেট নিলাম, খুশি হলাম। অবশ্য ওখানে যা পড়লাম সেগুলো সরাসরি আমার পেশায় কাজে না লেগে উপকার এসেছে পরোক্ষভাবে। যার জন্য অফার পেলাম ইনডিপেনডেন্ট থেকে প্রমোশনসহ। ওখানে জয়েন করার পর দেখলাম, সেখানে আছেন এক ইয়াং চৌকস কম্পিউটার ইনচার্জ, আমার প্রশিক্ষণ আছে জেনে খুবই খুশি হলেন। আমি নিউজের স্টাফ হলেও পত্রিকাটির কম্পিউটার সম্পর্কিত সুবিধা-অসুবিধাগুলো তিনি আমার সাথে আলাপ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কোনো এক পরিণত সময়ে একদিন আমি একটা বিষয় ওনার কাছে জানতে চাইলাম। বললাম, একটা জিনিস কি লক্ষ করেছেন যে, কম্পিউটারের বাংলা কিবোর্ডে কোনো ড্যাশ নাই, আছে হাইফেন? হাইফেন আর ড্যাশ কিন্তু ভিন্ন জিনিস। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ঠিক ধরেছেন অথচ যারা এটা লক্ষ করার বিষয় তারা কেউ দেখলোই না! ওরা হাইফেন আর ড্যাশকে একই বিষয় মনে করেছে, ভেবেছে ড্যাশটাই হয়তো খাবার না পেয়ে অথবা ডায়েট কন্ট্রোল করে হাইফেন হয়ে গেছে। তবে দুঃখের কথা হলো, সেই চৌকস ইঞ্জিনিয়ারকে কোনো একসময় অন্য একটি প্রতিষ্ঠান হায়ার করে নিয়ে গেলো। একেবারেই তরতাজা ইয়াংম্যান, কিন্তু পরে জানলাম, অসময়ে পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছেন তিনি। বাংলা কম্পিউটারে হাইফেন সাহেব এখনো ড্যাশ মশায়ের ভ‚মিকায় অভিনয় করে যাচ্ছেন!

এটুকু লিখেই যদি লেখাটা পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেই, তাহলে সম্পাদক সাহেব অবশ্যই বিস্মিত এবং মনোক্ষুণœ হবেন। একটা নিয়মিত ও নির্ধারিত কলামের আয়তন তো আর এতো ছোট্ট হতে পারে না! আসলে পারে কি? অবশ্য আমারো মনে হয়, যারা লম্বা লেখা পছন্দ করেন না তারাও একদমে পড়ে শেষ করার জন্য আরেকটু লেখা এর সাথে দাবি করবেন। তাই অন্য একটা বিষয় সংক্ষেপে এর সাথে জুড়ে দেবো। বিষয়টা অনেক জটিল এবং লম্বা লেখা দাবি করে, তারপরও আমরা যথাসম্ভব সংক্ষেপে শেষ করবো যাতে পাঠক বিরক্ত না হন।

ইদানীং বাংলা সাহিত্য জগতে কিছু তথাকথিত বিজ্ঞ মানুষের আবির্ভাব হয়েছে যারা তাদের চিন্তার মধ্যে অদ্ভুত কিছু ভাবনাজুড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে একজনকে জানি যিনি মনে করেন, বাংলাদেশে সাহিত্যের জন্য যে দুটো সরকারি পুরস্কার আছে তার কোনো একটা ওনার পাওয়া উচিত। এটা তিনি সরাসরি বলেন না, উচ্চারণ করেন পরোক্ষভাবে, কৌশলে। আমি শুভাকাক্সক্ষীর মতোই ওনাকে বললাম, সাধারণ কৌশলে হবে না, নাজিল হতে হবে। কিছুটা পথও বাতলে দিয়েছিলাম। এটা করেছি এজন্য যে, পথগুলো ওনার চলার পথের কাছাকাছি রয়েছে আর পুরস্কার পাবার জন্য উপস্থাপনযোগ্য সম্বলও ওনার আছে। কিন্তু সমাজে কিছু মানুষ থাকে, যারা এতো বেশি বোঝে যে, ওদের বারোটা বাজানোর জন্য অন্য মানুষ লাগে না, নিজেরাই যথেষ্ট। তিনি দেশে গিয়ে সরকারি-বেসরকারি ও আধাসরকারি সব মহলের সাথে বেশ লম্বা সময় নিয়ে ওঠাবসা করে ঘনিষ্ঠ হয়ে ফিরে এসেছেন। আমি জানি, তিনি নিজের বারোটা বাজিয়েছেন, নিজেই নিজের আকৃতি ছোট করে দিয়েছেন। ওনার সফল হবার রাস্তায় উঠবার জন্য তিনি ভুল পন্থা অবলম্বন করেছেন, আমি যেটা বলেছি তার উল্টোটা করেছেন। যাদের সাথে উনি ঘনিষ্ঠ হবার জন্য এক মাস সময় দিয়েছেন ওনাদের আমি প্রায় সাড়ে চার দশকেরও বেশি সাংবাদিকতা পেশায় থাকা সময়টা ধরে দেখবার সুযোগ পেয়েছি। আমি নিশ্চিত, ওনার প্রত্যাশার গুড়ে উনিই বালি ছিটিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য মুদ্রার ব্যবহারে আবার অনেক অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায়!

এই মহলেরই আরেকটা বিষয় সামান্য আলাপ করে আজ শেষ করবো। এক মহল ইদানীং আওয়াজ তোলার চেষ্টা করছেন যে, কবিতা লেখার আগে ছন্দ শিখতে হবে। আমি পরোক্ষভাবে এদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, ভাষা আগে আর ব্যাকরণ তার পরে। কিন্তু না, ওনারা এতোই পÐিত হয়ে উঠেছেন যে, সবকিছু পÐ না করে ছাড়বেনই না! তো এই পর্যায়ে আমরা কি করতে বা বলতে পারি? এই অতিপÐিতেরা চর্যাপদ, আবদুল হাকিম, ঠাকুর, নজরুল কাউকেই ছাড়েনি। পারে তো শেক্সপিয়ার এবং জালালুদ্দীন রুমীর কবিতাও কারেকশন করে দেয়! এ অবস্থায় এদেরকে আপনারা একটা পরামর্শ দিন। ওদেরকে বলুন, শিশুদের জন্য একটা প্রশিক্ষণ কোর্স খোলার জন্য, এতে দুটো সাবজেক্ট থাকবে। একটা হলো, কীভাবে মাকে ডাকতে হবে নবজাতককে তা শেখাবে আর আরেকটা হলো, শিশু কাঁদবার সময় কোন ছন্দ এবং সুরে কাঁদবে তা এরা প্রশিক্ষণ দেবে। না না, স্যরি ভাই, আমি বলতে পারবো না, আপনারাই ওদেরকে বলুন। তবে অবশ্যই বলে দেবেন, প্রশিক্ষণের সময় ওরাও যেন মা মা বলে কোন এক ছন্দ ও সুরে কান্না করতে থাকে।

প্রিয় পাঠক, কানে কানে একটা কথা বলি, ওদেরকে বলবেন না যেন। এরা কিন্তু তিরস্কারও বুঝতে পারে না, বলার সাথে সাথে হয়তো এ কাজ শুরু করেও দিতে পারে। এ অবস্থায় আমরা কি করতে পারি? আসুন, সবাই মিলে প্রার্থনা করতে থাকি, হে বিধি, আমাদেরকে অজ্ঞতা এবং অজ্ঞ মানুষের হাত থেকে বাঁচাও আর ওদেরকেও অজ্ঞতা থেকে মুক্তি দাও!


শেয়ার করুন