বইকে শক্ত হাতে ধরে রাখতে হবে। বই আমাদের আঁকড়ে রেখেছে। বাংলাদেশও ভারতের মধ্যে সীমান্ত রেখে রয়েছে। সীমান্তে প্রহরী রয়েছে, ইমিগ্রেশন রয়েছে, ইত্তেফাকে মোড়ে এখন আর আচার আনা যায় না। ব্যাগ খুলে দেখাতে হয়। এটাই হলো দু’দেশের মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল। তবে বই একমাত্র শক্তি। এই বই দু’দেশের অলঙ্ঘনকে লঙ্ঘন করতে শিখিয়েছে। বাংলাদেশের পদ্মা সেতু যেভাবে দেশের উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব কমিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই আমাদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়েছে। চার দিনব্যাপী বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কলকাতার বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আমর মিত্র এসব কথা বলেন। কবি আসাদ মান্নান বলেন, ঢাকা, কলকাতার পর নিউইয়র্কে বইমেলা হচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে যেখানে বাঙালি যাচ্ছেন সেখানেই তারা বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতিকে নিয়ে আসছেন। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, আমাদের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্ম কি বাংলা ভাষায় কথা বলবে? নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতি শেখাতে হবে। তা না হলে আমরা হারিয়ে যাবো। মনে রাখবেন অর্থবিত্ত জৌলুস দেবে, কিন্তু জীবন দেবে না। বইমেলার প্রথমদিনে মুক্তধারা সম্মাননা প্রদান করা হয় বেন’র আহŸায়ক অর্থনীতিবিদ ড. নজরুল ইসলাম ও শিল্পপতি জাকির হোসেনকে। নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলার দ্বিতীয় দিনে শহীদ কাদরী গ্রন্থ পুরস্কার ২০২২ ঘোষিত হলো। পুরস্কার পেলেন দেশি কবিতা গ্রন্থের জন্য মুজিব ইরম।
ঘোষণা করেন: ড. নূরন নবী ও ফেরদৌস সাজেদীন। নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলার তৃতীয় দিন ছিল শনিবার। ছুটির দিনে উপচেপড়া ভিড়ের মধ্যে ঘোষিত হলো মুক্তধারা-জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার ২০২২। পুরস্কার পেলেন বাংলা ভাষাসাহিত্যের শক্তিমান গবেষক, লেখক অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ। এ পুরস্কারের অর্থমান ৩ হাজার ইউএস ডলার। চারদিনব্যাপী এই বইমেলায় আরো ছিলো কবিতা আবৃত্তি, লেখক সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ ছাড়াও ছিলো বইমেলার মূল আকর্ষণ বইয়ের স্টল। মেলায় কবি, লেখক, প্রকাশক এবং পাঠক সবাই এসেছেন। আনন্দ করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, ছবি তুলেছেন, সেলফি তুলছেন এবং বই ক্রয় করেছেন, বই বিক্রি করেছেন, বই নিয়ে এবং লেখকদের বই এবং জীবনী নিয়ে আলোচনা করেছেন। কুশলাদি বিনিময় করেছেন। নিউইয়র্ক, বাংলাদেশ, কলকাতা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি এবং আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট থেকে যারা এসেছেন তারা বইয়ের ঘ্রাণে এবং বইয়ের মধ্যে চারটি দিন আনন্দ-উচ্ছ¡াসে কাটিয়েছেন। উচ্ছ¡াস করার এবার কারণও ছিলো। আর সেই কারণটি হচ্ছে পরিবেশ। চমৎকার পরিবেশ ছিলো। অডিটোরিয়ামের ভিতরে ছিলো আলোচনা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অন্যদিকে বাইরে ছিলো বইয়ের স্টল। তাও আবার প্রকৃতির দান ছায়াঘেরা মাঠে।
বইমেলার উদ্বোধন
গত ২৮ জুলাই শুরু হয় চারদিনব্যাপী বইমেলার। এ বইমেলা ৩১ জুলাই শেষ হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলা ভাষাভাষী লেখক-সাহিত্যিক ও প্রকাশকরা যোগ দিয়েছেন এ মেলায়।
‘বই হোক বিশ্ব বাঙালির মিলন সেতু’-এবারের এই সেøাগান নিয়ে নিউইয়র্কের কুইন্সের জ্যামাইকা পারফরমিং আর্ট সেন্টারে সন্ধ্যায় ফিতা কেটে ৩১তম বইমেলার উদ্বোধন করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যক অমর মিত্র। বইমেলায় অতিথি হিসেবে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূদ শহীদুল ইসলাম, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরান নবী, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, কবি আসাদ মান্নান, শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অভিনেত্রী লায়লা হাসান, লেখক নাজমুন নেসা পিয়ারী, মুহম্মদ ফজলুর রহমান, হাসান ফেরদৌস, আহমাদ মাযহার, রোকেয়া হায়দার, সউদ চৌধুরী, জসিম মল্লিক, আনিসুজ্জাামান, শাহাব আহমেদ, হুমায়ূন কবীর ঢালী, মনিরুল হক, মেসবাহ উদ্দীন আহমেদ, রেদওয়ানুর রহমান, জহিরুল আবেদীন জুয়েল, শিল্পী তাজুল ইমাম, ড. নিরুপমা রহমান, কবি-লেখক-সাহিত্যিক ও প্রকাশকরা।
পরে মঞ্চে ৩১টি মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন করেন আমন্ত্রিত কবি-লেখক-সাহিত্যিক ও প্রকাশকরা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বইমেলার আহŸায়ক গোলাম ফারুক ভ‚ঁইয়া। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বইমেলার উদ্বোধক ও কথাসাহিত্যক অমর মিত্র, কবি আসাদ মান্নান, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত কনসাল জেনারেল এস এম নাজমুল হাসান, লুৎফর রহমান রিটন, ড. নূরন নবী এবং বইমেলার আয়োজক মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ফেরদৌস সাজেদীন, প্রকাশন মনিরুল হক, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার সাজ্জাদ হোসেন। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কোন কোন অতিথি আসতে পারেননি।
বইমেলার উদ্বোধনী দিনে মঞ্চে একক সংগীত পরিবেশন করেন ড. নিরুপমা রহমান। এছাড়া নৃত্য পরিবেশন করে অনুপ ড্যান্স একাডেমি। এছাড়া ছিল মুক্তধারা সম্মাননা। এ বছর সম্মাননা পেয়েছেন ড. নজরুল ইসলাম ও সৈয়দ জাকি হোসেন। সম্মাননা তুলে দেন ড. নূরন নবী এবং উত্তরীয় পরিয়ে দেন নিনি ওয়াহেদ। উদ্বোধনী পরিবেশনায় ছিলো অনুপম ড্যান্স একাডেমি। নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন মিথান দেব, কৃষ্ণা, ঈশা, তিসা, অর্পিতা, রুচি, চৈতন্য ও ত্রিপরণা। সার্বিক তত্ত¡াবধানে ছিলেন আল্পনা গৃহ।
আলোচনা অনুষ্ঠানে অমর মিত্র বলেন, এবারের বইমেলায় গুরুত্ব অপরিসীম। একদিকে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অন্যদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। তিনি বলেন, জিন্নাহ আসলে বাঙালিদের পছন্দ করতেন না। যে কারণে আব্বাস উদ্দিনের গান গাওয়া বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমরা যাই বলি কেন বাস্তবতা হচ্ছে দুই বাংলা এখন আলাদা। আমাদের কোনোদিন মিল হবে না। সম্ভবও না। তিনি আরো বলেন, বই আমাদের শক্ত করে ধরতে হবে। বই আমাদের আঁকড়ে রেখেছে। বাংলাদেশও ভারতের মধ্যে সীমান্ত রেখে রয়েছে। সীমান্তে প্রহরী রয়েছে, ইমিগ্রেশন রয়েছে, ইত্তেফাকে মোড়ে এখন আর আচার আনা যায় না। ব্যাগ খুলে দেখাতে হয়। এটাই হলো দু’দেশের মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল। তবে বই একমাত্র শক্তি। এই বই দু’দেশের অলঙ্ঘনকে লঙ্ঘন করতে শিখিয়েছে। বাংলাদেশের পদ্মা সেতু যেভাবে দেশের উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব কমিয়েছেন, ঠিক সেইভাবেই আমাদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়েছে। বই আমাদের সাথী হোক এবং আমাদের আত্মীয়তা দীর্ঘজীবী হোক।
কবি আসাদ মান্নান বলেন, নিউইয়র্ক হচ্ছে আমেরিকার অন্যতম প্রধান শহর। এই শহরে বাঙালি তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে এসেছে। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি গিয়েছে সেখানেই তারা তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে গেছে। বাংলা এখন পৃথিবীর অন্যতম মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, আমি ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি বলেন, এবারের বইমেলায় আসা আমার ঘটনাচক্রে। কারণ ২০১৮ সালে আমাকে ওয়াশিংটন বইমেলা থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। কিন্তু ভিসা পেতে দেরি হয়, যে কারণে আসা হয়নি। এবারের বইমেলায় সেই সুযোগটা কাজে লাগাই। কারণ আমাদের ৫ বছরের ভিসা দেয়া হয়েছিলো। তিনি আরো বলেন, বইমেলা হচ্ছে, ভাষার বীজ রোপণ করা হচ্ছে এটা আশার কথা কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্ম আদৌ বাংলা ভাষায় কথা বলবে কি না। তিনি আরো বলেন, পুরস্কার লেখক বানায় না, পাঠকরাই লেখক বানায়।
এস এম নাজমুল হাসান বলেন, এই বইমেলার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম শেকড় খুঁজে পাবে।
লুৎফর রহমান রিটন বলেন, বাংলা ভাষা আমরা ৫২ সালে পেয়েছি। বুলেট বুকে নিয়ে আমরা জয়ী হয়েছি। তারপর থেকেই আমরা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি। সেই দেশ আমাদের দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আরো বলেন, বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে মুক্তিধারার বিরাট ভ‚মিকা রয়েছে।