২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০২:২২:৫৮ পূর্বাহ্ন


রাজনীতিতে সমঝোতার সম্ভাবনায় গুড়েবালি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৮-২০২২
রাজনীতিতে সমঝোতার সম্ভাবনায় গুড়েবালি


দেশের সংকটকালীন সময়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দেশের স্বার্থে একটা ঐকমত্যের প্রত্যাশা দেশের অন্তত ৯৮ শতাংশ মানুষের। দুই দল এক টেবিলে বসে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা নির্বাচনী পরিকল্পনা ঠিক করে নির্বাচন আয়োজন। দেশে বিরাজমান বৈশ্বিক সংকটে মানুষের কল্যাণ কীভাবে হয় সেগুলো মোকাবিলা করা। দেশের স্বার্থে বহির্বিশ্বের সঙ্গে কোন নীতিটা বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে কল্যাণকর সেটা নির্ধারণ করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দুই দলের মধ্যে যে একটা অভ্যন্তরীণ বিরোধ সেটা মিটিয়ে দেশের স্বার্থে সব ভুলে এক হয়ে যাওয়া এগুলোই মানুষের প্রত্যাশা। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। বিরোধীদলকে ন্যায্য দাবি আন্দোলনের বাধা দেবেন না বলে জানান দিয়েছিলেন, মানুষ খুবই আশান্বিত হয়েছিলেন। কারণ দিনশেষে বিএনপি-আওয়ামী লীগে যারা রয়েছে, এরা কিন্তু কেউ ব্যক্তিগত, কেউ ফ্যামিলিগত, কেউ আত্মীয়স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশী থেকে শুরু করে একে অপরের কাছের। শুধু রাজনৈতিক বিদ্বেষে একটা বিরোধ দেশব্যাপী। এটা হয়তো কমে যেতো। বিএনপি থেকেও একটা আভাস আসছিল, একটা সমঝোতায় বোধহয় বিএনপি যাচ্ছে। নির্বাচন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই দুই দলের ঐকমত্য হয়ে যাবে। করোনা ও এরপর ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে বিপর্যস্ত বিশ্ব। বাংলাদেশ এর যাঁতাকলে রীতিমতো পিষ্ট। একটা দেশ কখন আইএমএফের লোন যায়, যার আর কোনো উপায়ন্তর থাকে না। অনেকেই মনে করছেন হঠাৎ করেই প্রায় ৪০ শতাংশ অধিক জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অর্থ আইএএমএফের শর্ত হজম কী না কে জানে! 

বাংলাদেশ সে পর্যায়ে। এসময়ে জাতীয় ঐক্যটা খুবই প্রয়োজন এটা এখন সবক্ষেত্রে থেকেই মানুষ বলে আসছে। যদিও দেশের একশ্রেণির সুশীলসমাজ এটাতে দ্বিমত। এখনো তারা শীর্ষ দুই দলের মধ্যে কীভাবে বিরোধ জিইয়ে রাখা যায় সে কথাই বলছেন। অথবা দীর্ঘ ছুটি নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাতে ঘুরে বেড়ান বা চুপ হয়ে রয়েছেন। হয়তো এটা তাদের কোনো কৌশল বা অ্যাসাইনমেন্টও। 

কোনো সংকটকালীন মুহূর্তে এদের থেকে দেশ ও রাষ্ট্র ভালো কিছু পায় না। কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক, খেতাব বা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে তারা সব সরকারেরই দ্বারস্থ থাকেন। তদবির করেন। সে সরকারের পাচাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরা ছাড়া সাধারণ মানুষ দিনশেষে দেশটা সুন্দরভাবে চলুক, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মতোঐকমত্য হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে প্রস্তুত। দেশের বিরাজমান সংকটটাও অমনই এক ক্রান্তিকালীন সময়ের মতোই। কিন্তু দুই দলের সমঝোতার একটা আভা সামান্য দেখা গেলেও সেটা এখন কী আবার অস্তমিত হয়ে গেছে? প্রশ্ন এখন সর্বত্র।

দেশের মানুষের তথা, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ খরচ করে তৈরি হওয়া পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে সকল নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মা সেতু হয়েছে এটা সবার জানা। কিন্তু দিনশেষে এর অধিকার রাষ্ট্রের সকল মানুষের। ফলে এখানে একক কৃতিত্ব দেশের মানুষের। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এটা বলেছেন। কিন্তু সে অনুষ্ঠানে বিএনপিকে দাওয়াত দেয়া হলেও সেখানে তাদের উপস্থিত না হওয়াটা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। আবার সেখানে বিএনপি নেতাদের উপস্থিত না হওয়ার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর সেই উক্তি (খালেদা জিয়াকে) উনাকে পদ্মা সেতুর ওপর থেকে টুস করে ফেলে দেয়ার বক্তব্যটা সর্বস্তরের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পদ্মা সেতু থেকে চুবিয়ে উঠানোটাও মানুষ কঠোর সমালোচনা করেছেন। কারণ পদ্মা সেতু যেমন বাংলাদেশের মানুষের সম্মানের,গর্বের। ড. ইউনূসও দেশের সম্মান-গর্বের। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ারও অনেক জনপ্রিয়তা, তার আমলেও দেশে উন্নয়ন হয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। হ্যাঁ, উন্নয়ন এরশাদের আমলেও হয়েছে। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না সে কিছু না কিছু চেষ্টা করে থাকেন। আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় মেগা প্রজেক্ট দৃশ্যমানের পেছনে টানা থ্রি টার্ম ক্ষমতায় থাকা। 

তবে মানুষ মাত্র ভুলত্রুটি হতে পারে। তারা অতীতে কী করেছেন বা বলেছেন, তার দায়ভার সাধারণ মানুষের ওপর ছেড়ে দেয়া বুদ্ধিমানের। কারণ দিনশেষে একটা রাজনৈতিক দল সাধারণ মানুষের ভোট চেয়ে সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে। ফলে জনগণকেও কিছু দায়িত্ব দেয়া উচিত নয় কি। 

পদ্মার রেশ কাটতে না কাটতে চায়ের দাওয়াত আবার আশার সঞ্চার করলেও পরক্ষণে যে ঘটনা ঘটেছে ভোলাতে সেটা আবারো মানুষ অন্ধকার দেখছে চোখে মুখে। 

বিএনপিসহ বিরোধীদল এমনকি সরকারের শরিক দলও যখন কঠোর সমালোচনায় ব্যস্ত তখন সরকারের উচিত ধৈর্য ধরা। কারণ এটা তো সত্য শতভাগ বিদ্যুতের দাবি করার পরও চরম লোডশেডিং হওয়া হুট করেই মানুষ মেনে নেবে না। একটু সময় দিতে হবে। বুঝতে সময় দিতে হবে লোডশেডিংয়ের কারণ। মানুষ শতভাগ বিদ্যুৎ পেয়ে আয়েশি হওয়ার পর লোডশেডিং সহ্য হবে না এটাই স্বাভাবিক। বিরোধীদল সরকারের ভুলভ্রান্তি ধরে সমালোচনাও যদি না করেন তাহলে বিরোধী কেন? কিন্তু এটা সরকার কী সহ্য করতে পারছে না? প্রশ্নটা সেখানে। নতুবা দেশব্যাপী বিএনপি কয়েকদিন বিক্ষোভ মিছিল করে সব ক্ষান্ত দিতেন এই তো। সরকারি ভাষ্যমতে বিএনপির তো আন্দোলনেরই ক্ষমতা নেই সাপোর্ট নেই। তাহলে সে বিএনপি কী করলে তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা না হওয়ারই কথা। বহুদিন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলরা বলছেন, ‘দেশে অনেক ইস্যু। কিন্তু বিএনপি সেগুলো নিয়ে মাঠে নামে না। আওয়ামী লীগ ওই পর্যায়ে থাকলে দেখিয়ে দিতো। বিএনপির যোগ্যতাই নেই।’ বিএনপিকে এভাবে উসকে দেয়া হয়েছিল কোন স্বার্থে। 

এরপর সেখানে বিএনপি আন্দোলনে মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গে সেটাও আবার সহ্য হয় না। দু’দুটি তাজা প্রাণ (স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল নেতা) গুলি করে শেষ করে দেয়া মানুষ কী ভালোভাবে নিয়েছে। প্রথম বলা হয়েছিল আগস্ট মাস বিএনপি রক্ত চায়। তারা নিজেরাই করেছে। এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, অস্ত্রের বিপক্ষে পুলিশ কী আঙুল চুষবে? 

পুলিশ থেকে বলা হয়েছে, সমাবেশের অনুমোদন ছিল। কিন্তু বিক্ষোভের অনুমোদন ছিলো না। দেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আন্দোলনের কয়টা পুলিশের অনুমোদন নিতে হয়েছে। আন্দোলন তো বিএনপিই শুধু নয়, দীর্ঘ সংগ্রাম আন্দোলন তো আওয়ামী লীগেরই বেশি। জন্মলগ্ন থেকে অধিকার আদায়ে আওয়ামী লীগ লড়ে আসছে। তাহলে সব অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুলিশের অনুমতি নিয়ে করে আসছে এ যাবৎ আওয়ামী লীগ? মোটেও না। জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননও ভোলার ঘটনায় প্রচণ্ড বিরক্ত। তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। জাতীয় পার্টিও। তাহলে আওয়ামী লীগের যে নীতি সেটাতে তারা কী একঘরে হয়ে যাচ্ছেন?

এটা কী দলটির ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলকর। তবে এটা ঠিক কিছু অতিউৎসাহী যেটাকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় অনুপ্রবেশকারী রয়েছে ক্ষমতাসীনদের দলে। যারা প্রতিনিয়ত সরকারের ভালো কিছু করার ইঙ্গিত দেখলেই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতে চিকন বুদ্ধি দিয়ে চেষ্টা করেন। ভোলার ঘটনাও তেমন হতে পারে।

মুহূর্তে দু’দুটি মানুষ গুলিতে নিহত হওয়াটার দায় বিএনপি পুলিশের ওপর চাপিয়েছে। পুলিশকে সাপোর্ট দিচ্ছে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা আঙুল চুষবে কি-না সে ধুয়া তুলে। পুলিশ আজ একজনের। কাল রাষ্ট্রক্ষমতা অন্যজনের কাছে গেলে তার হুকুমেই চলবে। দিনশেষে সাধারণ মানুষ এরজন্য সাফার করে যাবে এটা কোনো সঠিক পরিকল্পনার ফসল নয়।

প্রধানমন্ত্রীর চায়ের দাওয়াতের পর বিএনপির ওপর একটা চাপও পরে বিভিন্ন পর্যায় থেকে। যেন সবকিছু ভুলে একটা সমঝোতার জন্য তারা এগিয়ে যায়। কারণ দেশের মানুষ কোনো ধরনের সংঘাত চায় না। সেখানে ভোলার ঘটনা বিএনপিকে আবারো পুরোনো স্থানে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। বিএনপিকে মাঠে নামতে না দেয়ার যে সরকারের একটা মহলের পরিকল্পনা সেটা তারা বুঝে গেছেন। কাজেই বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সরকার ও তার সাপোর্টের বিভিন্ন পর্যায় থেকে যতোই বলা হোক না কেন, যে ২০২৩ সনে তেমন নির্বাচন আর হবে না, সেটা আর কেউ বিশ্বাস করছে না। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বার্থে বিভিন্ন প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসছেন দেশের রাজনৈতিক দলের নীতিকে ভূলুণ্ঠিত করে তাদের নিজেদের মত প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। এ সুযোগ করে দিয়েছে রাজনীতিবিদ,কতিপয় দালাল সুশীলরাই। প্রায় দেড়যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির সুযোগ খোঁজা বেশি কিছুনা। যাদের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়ার প্রচেষ্টা। যাদেরকে রাজনীতি থেকে বনবাসে পাঠানোর পরিকল্পনা। তারা তো লতাপাতা আঁকড়ে ধরে হলেও বাঁচার চেষ্টা করবেন। এটা স্বাভাবিক। এমন নজির শুধু যে বিএনপির তা নয়। বিগত সময়ে সকল দলই বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়েছে বিভিন্নভাবে। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে লড়াইটা আর খেলার মাঠে নেই। অদৃশ্য পর্যায়ে। যা মানুষ অনুধাবন করতে পারছে। 

যার সূত্র ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন তথা উন্নয়ন সহকারীরা যে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন ও সব দলের অংশগ্রহণের যে চাপ দিয়ে আসছেন সেটাই এখন পারফেক্ট সলিউশন হিসেবে মানুষও মানছেন। এখানে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা শীর্ষ দুইয়ের সমঝোতা, সেটা ক্ষীণ হয়ে গেছে। বিদেশিদের মত বাস্তবায়ন করতে যেয়ে দেশের স্বার্থ কতটা সঠিক থাকবে, সেটাই এখন মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটা ঠিক, পরবর্তী নির্বাচনটা যেন সঠিক ও ফেয়ার হয় সে প্রত্যাশাটা সাধারণ মানুষের এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেটা যেভাবেই হোক না কেন। মানুষ চায় পছন্দসই মানুষটাকে ভোট দিয়ে নেতা বানাতে। ভোটকেন্দ্রে যেতে। নির্ভয়ে ভোট প্রদান করতে। বিগত সময়ে ভোট কেন্দ্রে যেয়ে শুনেছে, তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে বা ভোট দেয়ার পরিবেশটাও কোথাও পায়নি- এমন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন তারা।


শেয়ার করুন