২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ১০:৪৫:০৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


ফ্লাশব্যাক ২০২২
বাংলাদেশে মানবাধিকারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০১-২০২৩
বাংলাদেশে মানবাধিকারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি


২০২৩ নতুন সনটা কেমন যাবে এ আলোচনা অনেকেই করছেন। তবে সাথে আছে ফেলে আসা বছরটিও। কেমন গিয়েছে ওই বছরটা, কী হওয়া উচিৎ ছিল ওই বছর- সে ফ্লাশব্যাকটাও হচ্ছে। তবে ২০২২ সময়কালে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সর্বোপরি মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বরং প্রায় সর্বক্ষেত্রে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০২২ সময়কালে, দেশে বিরাজমান সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক।

দেশের বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) তাদের বার্ষিক পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য দিয়েছে। এমএসএফ’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে আরো বলা হয় অর্থনৈতিক মন্দা, অত্যধিক মুদ্রাস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতির ফলে দেশের সাধারণ মানুষ নিদারুণ কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। করোনা মহামারি-পরবর্তী সময়ের, অর্থাৎ ২০২০ ও ২০২১ সাল শেষে দেশে দারিদ্র্যের হার সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দারিদ্র্যের হারে যে ঊর্ধ্বগতি উঠে এসেছে, তা গ্রহণে সরকার অনীহা প্রকাশ করেছে। ফলে দেশে দারিদ্র্যের বর্তমান হার নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।

তবে প্রতিবেদনটি দিয়ে এতে আরো বলা হয় মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি)’র লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই এমডিজির বেশিরভাগ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ সরকার প্রশংসা অর্জন করেছে। বিশেষ করে করোনার বিস্তার বন্ধে বাংলাদেশ যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মূলত এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অগ্রসরমান ধাপ। ২০৩০ সাল নাগাদ কোনো ক্ষুধা বা খাদ্যাভাব থাকবে না। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে ‘শূন্য’ তথা সহনশীল পর্যায়ে আনার জন্য শতভাগ মনোযোগ, শতভাগ অংশগ্রহণ এবং শতভাগ ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমান অবস্থার বিশ্লেষণে দেখা যায় এসডিজি অর্জনের ১৭টি শর্তের প্রথম দুটো শর্ত অর্জনেই কোনো সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

তবে দেশের মানুষ সমমর্যাদা, সাম্য ও ন্যায়বিচার লাভ করবে এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশায় এমএসএফ’র পক্ষ থেকে সুপারিশও রাখা হয়। এতে বলা হয় রাজনৈতিক বিক্ষোভকারীদের দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না করে মানবিক ও সংবেদনশীল ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে হতাহতের ঘটনা কমিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সচেষ্ট থাকা। কথিত গায়েবি মামলা দায়ের ও এ সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতার করা থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিরত থাকা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা। মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব না করা এবং কোনো ধরনের ভয়ভীতি বা প্রতিহিংসার শিকার হওয়া ছাড়াই নাগরিকেরা যেন এ অধিকারসমূহ চর্চা করতে পারে, তার পরিবেশ সৃষ্টি করা। গণমাধ্যম ও নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক ডিজিটাল আইন বাতিল করা বা সংশ্লিষ্ট সকলের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা। নির্বাচনী সহিংসতা শুণ্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সকল প্রকার গুম, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর  অভিযোগসমূহ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্পৃক্তদের বিচারের আওতায় আনা। কারাগারসমূহের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাসমূহের যথাযথ তদন্ত করে তার পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিচারিক ব্যবস্থা নেওয়া। নারী ও শিশুর জন্য সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করা।

সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে নারীবান্ধব করাসহ সমাজে অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা আরও কার্যকর করা। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার চর্চায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ, সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার সাথে জড়িতদের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দেশের নাগরিকদের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা রক্ষায় ও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে সরকার উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। সে অনুযায়ী সরকারের উচিত মানবাধিকারের একটি সর্বজনগ্রাহ্য মান বজায় রাখা। সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সমঅধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি বলে মনে করে এমএসএফ। 

এমএসএফের মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বার্ষিক পর্যবেক্ষণ বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২০২২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রবণতা। এতে দেখা যায় গত বছর সালে মানবাধিকারের বিচারে অন্যতম উদ্বেগের বিষয় ছিল যথেচ্ছ গায়েবি মামলা ও গ্রেফতার। এ ধরনের মামলার মূল উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ছিল সরকার বিরোধী ব্যাক্তি ও দলের সদস্যরা। 

 বিশেষ করে বিএনপি’র বিরুদ্ধে কথিত গায়েবি মামলা এবং এ সকল মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা ক্রমশঃ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যেতে দেখা গেছে। বিএনপি’র মহাসচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের অনেক নেতা গ্রেফতার রয়েছেন এবং তাঁরা জামিনও পাচ্ছেন না। এখনও গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে নাগরিকের বাক স্বাধীনতা ও রাজনীতিতে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার  অধিকার খর্ব  হচ্ছে। ২২ আগস্ট থেকে ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ সময়ে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কথিত গায়েবি মামলা হয়েছে ৩১২টি, যাতে ৮৪৮৬ জন এজাহারভূক্ত আসামি, ২৫১১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে বিএনপি’র ১৩০৯ জনকে। বাকিদের গ্রেফতারে প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয় দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরোধীদলের সভা-সমাবেশে বাধা প্রদান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক আক্রমণের ঘটনার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৭ ডিসেম্বর নয়া পল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রিয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের হামলা ও গ্রেফতার তার মধ্যে অন্যতম। যেখানে ১ জন নিহতসহ অনেকে আহত হন। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হয়নি। সাংবাদিক নির্যাতন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশ হেফাজত ও কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে। নারী, শিশু ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে ঘটেই চলেছে। হয়েছে অবহেলা জনিত কারণে দুর্ঘটনা ।  

গত বছরে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সভা সমাবেশে বাধা দেওয়ার ব্যাপারে তথ্য দেয়া হয় যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকার দলীয় ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহিংসতা, হানাহানি ও হতাহতের ঘটনায় নাগরিক জীবনে উৎকন্ঠা বেড়েছে। অপরদিকে ক্ষমতাসীন দলের সংঘাত-হিংস্রতা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিকার ভূমিকার বিপরীতে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে অতি উৎসাহি অপতৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। এতে করে সুষ্ঠু রাজনীতি করার অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে এবং ক্রমাগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা কমছে। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এ বছর বিরোধী দল বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নানাবিধ কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়েছে যাতে করে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সভাস্থলে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে পরিবহন খাতকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করে তথাকথিত মালিক ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট নেতারা তাদের কথিত দাবিদাওয়া বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে ধর্মঘটের নামে সড়ক ও নৌপথে  যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে তারা নিজেদের পরিবহন ব্যবহার করে বিভিন্নস্থান থেকে সমাবেশে আসার পথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সরকারদলীয় কর্মীরা নানাভাবে বাধা প্রদান করে যা ছিল চরমভাবে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘন। পাশাপাশি সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন দেশের সাধারণ মানুষ ও অসুস্থ ব্যাক্তিরা। সমাবেশের প্রচারণায় বাধা প্রদান করা, হয়রানিমূলক মামলা ছাড়াও গায়েবি মামলা দায়ের, গ্রেফতার ও বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভয়-ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় কর্মীদের এহেন বলপ্রয়োগ নাগরিক জীবনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে এবং তাঁদেরকে ক্ষুব্ধ করছে। পুলিশবাহিনী সরকারি দলীয় সংস্থায় পরিণত হয়েছে  কি না এমন প্রশ্ন এখন সর্বত্র।

বিচারবর্হিভূত হত্যা / ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধ/ গুলিবিনিময়

এমএসএফ’র প্রতিবেদনে বলা হয় বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড বেআইনী, অসাংবিধানিক এবং ফৌজদারী অপরাধ যা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড বন্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার ভূমিকা রাখলেও ‘ক্রসফায়ার’ বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনাসমূহ সরকার অস্বীকার করে আসছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ২২টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যাতে ১ জন নারী, ১২ জন যুবক ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) ১জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ জন সেনা, ৩ র‌্যাব সদস্য, গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ১ নারী ও ১৩ জন যুবক। এ সময় আটক করা হয়েছে ১৯ যুবককে। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও নিখোঁজ

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের নামে যে অপতৎপরতা অব্যহত রয়েছে বলে এমএসএফ’র রিপোর্টে উল্লেখ করে বলা হয় যে এটা  অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকারের চরম লংঘন ও ন্যায়বিচার পরিপন্থি। এ ধরনের ঘটনায় আটকের ২৪ ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। ফলে নাগরিক জীবনে চরম উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হচ্ছে ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত আস্থাহীনতা সৃষ্টি করছে। 

সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকার

জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার রক্ষায় সাংবাদিকেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের যেভাবে হয়রানি ও শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র অনাকাঙ্ক্ষিতই নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কন্ঠরোধ করার সামিল যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য অশনিসংকেত। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এ বছরের চিত্র ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং  গত বছরের তুলনায় এ বছর সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। এ বছরে পেশাগত দায়িত্ব পালনে মহিউদ্দিন নাঈম নামে একজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।

দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে একজন নিহতসহ ২৬৬ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ১ জন নিহত, ১১৬ জন আহত, ৭১ জন লাঞ্ছিত, ১৭ জনের উপর আক্রমণ ও ৬১ জন হুমকির শিকার হয়েছেন। এছাড়াও ৫ জন সাংবাদিকের লাশ উদ্ধার ও ১ জন সাংবাদিক ইউএনও’র গাড়ির চাপায় নিহত হয়েছেন। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ প্রণয়নের শুরু থেকেই বিশিষ্টজনেরা এই আইনের কয়েকটি ধারায় অস্পষ্টতা থেকে তার অপব্যহার হওয়ার আশংকায় আইনটির কয়েকটি ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে আশ্বস্ত করলেও আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। যার ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার ক্রমাগতহারে বেড়েই চলছে। ছোট শিশু থেকে শুরু করে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ এই আইনের অপব্যবহারের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক, সংখ্যালঘু, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এই আইনটি অনবরত ব্যবহার হচ্ছে। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এ বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮২ টি মামলা হয়েছে ও গ্রেফতার হয়েছেন ৭৭ জন। 

ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, হতাহতের ঘটনা

২০২২ সালের অপর উদ্বেগের ঘটনা ছিল ১৮ জুলাই রাতে নড়াইলের লোহাগড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকের একটি পোস্টে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)কে নিয়ে কটুক্তির অভিযোগ তুলে নড়াইলের লোহাগড়ায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তিনটি বসতবাড়ি ও ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর হামলা। একই সাথে কয়েকটি মন্দিরে হামলা করে চারটি মন্দির ভাঙচুর করাসহ একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটান হয়। এছাড়া চারটি বাড়িঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে টাকাসহ স্বর্ণালংকার লুট করার অভিযোগও উঠে। এই হামলা ও ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক যথাযথ ভূমিকা না নেওয়া বিষয়টিকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা নির্যাতন এ সময়ে একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে একই কায়দায় স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়েছে। একই ভাবে বিচারহীনতার কারণে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ একপর্যায়ে শটগান দিয়ে ফাঁকা গুলি চালালেও ঘটনাস্থল থেকে কাউকে গ্রেফতার করেনি। যে সমস্ত চক্র এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে, বরং পুলিশকে ঘটনার শিকার ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করে  দিনের পর দিন বন্দী করে রাখার মত অবাস্তব, বে আইনী এবং অমানবিক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। 

অপরদিকে সেপ্টেম্বর মাসের শারদীয় দূর্গাপুজাকে সামনে রেখে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী পুরুষ ও শিশুরা মহালয়া উপলক্ষে এক ধর্মসভার আয়োজনে অংশগ্রহণের জন্য বোদা উপজেলার বড়শী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে (নদীর অপর পাড়ে) শ্যালো মেশিন চালিত একটি নৌকায় করে যাওয়ার সময় পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় ৬৯ জনের মৃত্যু হয় ও আনুমানিক ৩ জন নিখোঁজ হয়। এ হৃদয়বিদারক ও ভয়বাহ ঘটনাটি সবার মাঝে দুঃখ ও চরম ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। এ ঘটনা প্রথম বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব ও উদাসিনতার কারণে মানুষ এ ধরণের অনভিপ্রেত ঘটনার শিকার হয়ে আসছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এ বছরে বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ৭৮টি ঘটনায় নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২টি মন্দিরে আগুনসহ ২২ টি উপাসনালয়ের মূর্তি ভাংচুর, ২টি মন্দিরের দানবাক্স লুট, ১১টি বাড়িতে আক্রমণ, ভাংচুর ও লুটপাট এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মুন্ডা সম্প্রদায়ের একজনকে পিটিয়ে হত্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন নারীসহ দুইজনের লাশ উদ্ধার ও রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে  ঈশ্বরীপুর এলাকায়  ধানের জমিতে পানি না পেয়ে প্রতিবাদ স্বরূপ ২ আদিবাসী (সাঁওতাল) কৃষক কর্তৃক বিষপানে আত্মহত্যর ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুদের মৃতদেহ সৎকার ২টি শ্মশান দখলের চেষ্টাসহ ১৬টি পরিবারের সম্পত্তি জবর দখলের চেষ্টা করা হয়েছে। হরিজন সম্প্রদায়ের স্কুলছাত্র রেস্টুরেন্ট খেতে বসলে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় হয়েছে, অপর একটি ঘটনায় ছাত্র রাহুল দেব রায়ের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মিথ্যা মামলা করে বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতা রংধজন ত্রিপুরা ও লাংকম ¤্রােসহ ১১ জনকে হয়রানি করা হয়েছে ও রবার চাষের নামে উপজাতি সম্প্রদায়ের জুম চাষের জমি পুড়িয়ে দেয়াসহ তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, নির্যাতন, হয়রানি ও অমানবিক অচরণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে আজ অবধি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হিন্দু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধানে সরকারের ব্যর্থতাতেই দুর্বৃত্তরা একের পর এক সাম্প্রদায়িক তান্ডব চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা 

নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতারোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও নারীর প্রতি অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা লক্ষ্যণীয় নয় যার কারণে   নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। সমাজে অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের তেমন কোন নজরদারি না থাকায় ২০২২ সালে দেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা যেমন- ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত বছরের তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেড়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিচারহীনতা, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা ও অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে।

শেয়ার করুন