২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৪:১৯:৩৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :


পবিত্র রমজানে এহসানের গুরুত্ব
ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৩-২০২২
পবিত্র রমজানে এহসানের গুরুত্ব



পবিত্র রমজান মুসলিম জাহানে উপহার দেয় ইবাদতের প্রশংসিত বহুপন্থা, যদ্বারা মুসলিম উম্মতের আল্লাহ-সচেতন ব্যক্তিরা বিশেষ মর্যাদায় উন্নতি হতে পারেন। একারণে রমজান আগমনের সুখবরে মুসলিম হৃদয়ে ও মনের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয় রোযাকে স্বাগত জানানোর অদৃশ্য অব্যক্ত রোমাঞ্চ। এটা হচ্ছে রমজানের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যের প্রতি মুসলিম উম্মতের অসীম শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার প্রত্যক্ষ রূপান্তর।

পবিত্র রমজান মুসলিম জাহানে আরো উপহার দেয় পরম দয়ালু প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার নৈকট্যলাভের সুনিশ্চিত সুযোগ। আরো দেয় উদাসীন কলুষিত হৃদয়কে পরিশোধনের এবং আত্মশুদ্ধির বহু পন্থা যা বছরের অন্য সময় পাওয়া যায় না। আরো দেয় সারা বছরে সঞ্চিত পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার অনমনীয় প্রতিশ্রুতি। কারণ পবিত্র রমজানে রোযা পালন করা হয় একমাএ প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়। কাজেই রোযাদারদের রোযা পালনে ধৈর্যধারণ, আন্তরিক নিষ্ঠা, আত্মসংযমের দৃঢ় মনোবল এবং আত্মশুদ্ধির ঐকান্তিক ইচ্ছার পুরস্কার আল্লাহ তা’আলাই দিবেন , যার ধরন ও পরিমান কারও জানা নাই। এজন্যই এহসান অবলম্বনে রোযা পালনে ধৈর্যধারণ করার ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ রোযার পবিত্রতা ও মর্যাদা সংরক্ষণে শুধুমাএ খাদ্য ও পানীয় বর্জন করাই নয় বরং কান, চোখ, হাত, পায়ের সাহায্যে কৃত পাপ থেকে দূরে থাকায় ধৈর্যধারণ করা, মানসিক চিন্তাভাবনার ও হৃদয়ে লালিত অবৈধ ইচ্ছাকে সংযত করার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বছরের অন্য সময়ে কৃত প্রাত্যাহিক অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রমে সময় অপচয় করা, অতিরিক্ত খাদ্য ভক্ষণের অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করায় ধৈর্যধারণ অপরিহার্য। ধৈর্যশীলদের পুরস্কার সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১০: বল হে আমার বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে পূণ্য। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।{সূরা আয-যুমার}।


রোযার সাথে ধৈর্যের সম্পর্ক সম্বন্ধে রাসূল (সা.) বলেছেন, “রোযা ধৈর্যের অর্ধেক আর ধৈর্য ঈমানের অর্ধেক।”{ইয়াহিয়া ওলোম আদ্-দ্বীন খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৩০}। রোযার রাখার পুরস্কার সম্পর্কে হাদিস থেকে আরও জানা যায়। রোযাদার ব্যক্তির সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, “ যার মুষ্টিতে আমার প্রাণ সেই সত্তার [আল্লাহ তা’আলার] শপথ, রোযাদারের মুখের গন্ধও আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধি হতেও উৎকৃষ্ট। কেননা রোযাদার [আল্লাহ তা’আলা বলেন] আমার উদ্দেশ্যেই খাবার, পানীয় ও লোভনীয় বস্তু পরিত্যাগ করে থাকে। তাই আমি বিশেষভাবে রোযার পুররস্কার দান করব। আর নেক কাজের পুরস্কার দশগুণ পর্যন্ত দেয়া হয়ে থাকে।”{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ২, ১৭৫৯}। রোযার ফজিলত সম্পর্কে রাসূল (সা.) আরও এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ বলেন, রোযা আমারই উদ্দেশ্যে এবং আমিই এর পুরস্কার দান করব। রোযাদার ব্যক্তির খুশীর সময় দু’টি। যখন সে ইফতার করবে তখন সে খুশী হবে। আর যখন সে আল্লাহ তা’আলার সাথে সাক্ষাত করবে তখন আল্লাহ পাক তাকে বিনিময় দান করবেন [ এজন্যই সে খুশী হবে]। ”{সহীহ মুসলিম, ২৫৭৭ এবং ২৫৭৮}।  রোযা পালনকারীর জন্য আরও রয়েছে বিশেষ পুরস্কার যা অন্যদের জন্য থাকবে না। রাসূল (সা.) বলেছেন, “বেহেশতের রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে। কিয়ামতের দিন এটি দিয়ে রোযাদাররা  (বেহশতে) প্রবেশ করবে। রোযদার ছাড়া আর একজন লোকও এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। শেষ বিচার দিবসে রোযাদরেেদরকে ডেকে বলা হবে, রোযাদাররা কোথায়? তখন তারা উঠে দাড়াবে। তারা ছাড়া আর একজন লোকও সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই তা বন্ধ করে দেয়া হবে। তারা প্রবেশ করে দেখতে পাবে তাদের পূর্বে ঐ দরজা দিয়ে আর একজনও প্রবেশ করেনি।”{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ২, ১৭৬১}। 

ইনশা আল্লাহ আশা করব এ দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশকারী হবেন সকল মুসলিম কারণ মানবজাতির মধ্যে তারাই একমাএ উম্মত যারা পবিত্র রমজানে রোযা পালন করে থাকেন। ইসলামী শরিয়তে নির্ধারিত বয়স অনুযায়ী বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রতি বছরই মুসলিম উম্মতের অকৃতজ্ঞ কিছু ব্যক্তি ব্যতিরেকে আর সকল মুসলিমই পবিত্র রমজানের উপহার যেমন পূর্ববর্তী বছরে অর্জিত পাপের গোনাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্যলাভের প্রত্যাশায় বিশেষ পন্থায় ইবাদত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। তারা একনিষ্ঠ অন্তরে বিশ্বাস করেন যে, পরম দয়ালু প্রতিপালক তাদের ইবাদত ও প্রার্থনা কবুল করবেন এবং অর্জিত পাপের বোঝা থেকে নিস্কৃতি দিবেন। হাদিস থেকে এসম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায়, রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরের রাতে ঈমান  সহ [এব্যাপারে একনিষ্ঠ বিশ্বাস] সওয়াবের আশায় নামায পড়ল তার অতীতের গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি সওয়াবের আশায় ঈমানসহ রমজানের রোযা রাখল তারও অতীতের সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।”{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ২, ১৭৬৬}। উপরন্তু পবিত্র রমজানের মাহাত্ম্য উপহার দেয় আল্লাহ তা’আলাকে  ভালোবাসার আল্লাহ-সচেতন হৃদয় বা পরহেজগারী বৈশিষ্ট্য অর্জনের অনবদ্য সুযোগ।  পবিত্র রমজানে রোযা পালনের নির্দেশ কেন দিয়েছেন, এসম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১৮৩: হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পার- ।{সূরা আল-বাকারাহ}। এই আয়াত থেকে  স্পষ্ট যে, পূর্ববর্তী উম্মতের জন্য রোযা ফরয ছিল তবে তাদের রোযা পালনের নিয়মাবলী ও নির্ধারিত সময়ের ব্যাপারে কিছুটা পার্থক্য ছিল। কারণ আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত বিধিবিধান সময়ের ভিত্তিতে ও দাবীতে ইবাদতের পদ্ধতিতে ও জীবনাদর্শের ক্ষেএে কিছুটা রদবদল হলেও মূল বিধানের মধ্যে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পূর্ববর্তী উম্মতের জন্য নির্ধারিত বিধিবিধান দিয়েছিলেন, এসম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৪৮: আমি তোমাদের [আহলে কিতাবী] প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ [জীবনাদর্শ]  দিয়েছি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন [তখন মানব সন্তানের ধর্মীয় কোনো স্বাধীনতা এবং জবাবদিহির কোনো প্রয়োজন হতো না], কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম [জীবনাদর্শ] দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। অতএব দৌড়ে কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন কর। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তিনি অবহিত করবেন সে বিষয়, যাতে তোমরা মতবিরোধ [ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে] করতে।{সূরা আল-মাইয়েদা}। 

মানবজাতির কাছে আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত সকল নবী-রসূলের উম্মতের জন্যই নির্ধারিত বিধিবিধান ছিল। জীবনাদর্শের প্রয়োগ পদ্ধতির ক্ষেএে তারতম্য থাকলেও মূল ভিত্তিতে কোনো পার্থক্য ছিল না। সকল নবী-রসূলই তাওহিদের দাওয়াত দিয়ে এক আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করার ও আল্লাহ-সচেতন হয়ে জীবন-যাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই বলা যায় জীবনাদর্শের মূলভিত্তি অটুট রেখে প্রয়োগ পদ্ধতির বিভিন্ন শাখায় পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন হয়েছে। অবশেষে ইবাদতের বিভিন্ন শাখার মূলভিত্তি ও জীবনাদর্শের মূলভিত্তি ও তার শাখা-প্রশাখার বিস্তারিত বিধিনিষেধের পরিপূর্ণতা লাভ করেছে আল-কুর’আন ও শেষ রাসূল (সা.) এবং সাহাবাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত ব্যবহারিক জীবন ঘনিষ্ঠ সুন্নাহর মাধ্যমে। ইসলামী দ্বীনের বা শরিয়তের পরিপূর্ণতা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৩: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের [মানবজাতির জন্য] দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। {সূরা আল-মাইয়েদা}। কাজেই নতুন কোনো জীবনাদর্শ বা দ্বীন-ধর্ম  এবং নবী-রসূল আর প্রেরিত হবেন না। যাহোক উপরোক্ত আয়াতে ‘লাআল্লাকুম তাত্তাকুম’ বাক্যে  ইঙ্গিত রয়েছে যে, তাক্্ওয়ার [আল্লাহ-সচেতন হৃদয়ে বা এহসানের সাথে কাজ করার প্রত্যয় বা পরহেজগারীর] শক্তি অর্জন করার ব্যাপারে পবিত্র রোযার উল্লেখ্য ভূমিকা বিদ্যমান। কেননা পবিত্র রোযা পালনের সাথে জড়িত থাকে আত্মিক, শারীরিক, প্রবৃত্তির অবৈধ চাহিদার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানসিক শক্তির দৃঢ়তা এবং আল্লাহ-সচেতন হৃদয়ের অংশগ্রহণ। আরও থাকে অদৃশ্য শাইত্বানের অনুপ্রেরণা ,কুমন্ত্রণা ও ফিসফিসানির বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম করার উদ্দীপ্ত সংকল্প। এজন্যই পবিত্র রমজানে মুসলিমদের প্রতিটা কাজে এবং আনুষ্ঠানিক ইবাদতে থাকে আল্লাহ-সচেতন হৃদয়ের বিনিদ্র উপস্থিতি। একঠিন কাজ যাতে সহজ হয়, তার জন্য পরম দয়ালু আল্লাহ তা’আলা বান্দার প্রতি দয়ার্দ্র হয়ে শাইত্বানকে শিকলে আটকিয়ে দেন। তদুপরি রোযাদর ব্যক্তির মাগফেরাতের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলে দেয়া হয় এবং দোযখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এসম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, “রমজান মাস শুরু হলে আসমানের দরজাসমূহ উম্মুক্ত করে দেয়া হয়, দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শাইত্বানকে শিকল লাগিয়ে বন্ধী করা হয়।”{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ২, ১৭৬৪}।

এহসান কি এবং তার তাৎপর্য:  ইমাম কুরতবী (রাহি.) বলেছেন, এহ্সানের প্রথম অর্থ হচ্ছে সুন্দর ও সুচারুভাবে ইবাদত করা। আল্লাহ তা’আলা সবকিছু জানেন এং দেখছেন এরকম সচেতনতা নিয়ে নামায/ইবাদত করা। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, যাবতীয় কর্ম, চরিএ,অভ্যাস, আচার-আচরণ,পারস্পরিক আদান-প্রদান ইত্যাদিকে সুন্দর করা। মুসলিম, অবিশ^াসী, কাফের এবং জীব-জন্তু নির্বিশেষে সকলের সাথে উত্তম ব্যবহার করা।{মা’আরেফুল কুর’আন, পৃষ্ঠা ৭৫৩}। আল্লাহ তা’আলার নৈকট্যলাভের এবং পূর্ববর্তীতে অর্জিত পাপ থেকে নিস্কৃতির প্রত্যাশায় পবিত্র রমজানে  মুসলিম উম্মত সবকিছু সুচারুভাবে [এহসানের সাথে] সম্পাদন করতে চেষ্টা করেন। যাতে তাদের পরহেজগারীর বৈশিষ্ট্য অর্জনের এবং আল্লাহ তা’আলার নৈকট্যলাভের গন্তব্য সুরক্ষিত থাকে। এজন্যই বলা যায়, পবিত্র রমজানে কৃত সব ইবাদতের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে এহসানের। আরবী শব্দ এহসানের ভাবার্থ ও গুরুত্ব ব্যাপক তবে রোযা পালনের ক্ষেএে দু’টি অর্থ যেমন ইবাদতে, জীবন-যাপনে, প্রাত্যাহিক বিভিন্ন কার্যকলাপে (১) আল্লাহ-সচেতনতার [ইবাদতে এহসানের] উপস্থিতি এবং (২) সবকিছুই সুচারুভাবে সম্পাদন করার [কর্মে এহসান অবলম্বনের] অদম্য ইচ্ছা ও চেষ্টা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। স্মরণ রাখতে হবে যে, এগুলোর উপস্থিতি শুধুমাএ পবিত্র রমজানেই নয় বরং মুসলিমদের জীবনের সর্বক্ষেএে উপস্থিত থাকা সাফল্য অর্জনের জন্য অপরিহার্য। কারণ মনোনীত বান্দাহ হিসেবে মুসলিমদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করে একান্ত অনুগত ইবাদীর সম্মানে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। একারণেই তাদের প্রতিটা কর্মে, চিন্তা-চেতনায় ও চেষ্টায় থাকবে স্বচ্ছতা, আল্লাহ-সচেতনতা এবং  সুন্দর সুচারুভাবে সম্পাদন করার অদম্য ইচ্ছা। তারা আল্লাহ তা’আলার মনোনীত উম্মত, তাদের আর্দশ ও জীবনের কার্যকলাপ থেকে অন্যেরা ইসলামী মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্ব ও উৎকৃষ্ট জীবনাদর্শ সম্পর্কে প্রয়োগিক শিক্ষা গ্রহণ করবেন। জীবন যাপনে এহসানের গুরুত্ব বুঝার ক্ষেএে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পার্থিব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেএে সাফল্যের সাথে জড়িত থাকে কার্য সম্পাদনে গভীর মনোযোগ, একনিষ্ঠ অন্তরে চেষ্টা এবং কর্মের গুরুত্ব ও লাভের প্রতি নিরঙ্কুশ অনুরাগ ও শ্রদ্ধা। পেশাগত জীবনে, ক্রীড়াবিদদের অক্লান্ত পরিশ্রমে, গবেষকের গবেষণায় যেমন থাকে প্রতিষ্ঠানের মালিকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের সচেতনতা, সাফল্যের  চূরান্তে পৌছানোর ঐকান্তিকতা এবং আন্তরিকতা তেমন থাকে প্রতিটা কর্ম সম্পাদনে এহসান অর্থাৎ সুন্দরতম পদ্ধতিতে সম্পাদন করার যথাসাধ্য চেষ্টা। তদুপরি থাকে তাদের স্বীয় প্রতিষ্ঠানে উর্ধতন কর্তাব্যক্তিদের সন্তুষ্টি অর্জনের, প্রশংসা পাওয়ার, নিজের প্রবৃত্তির পরিতৃপ্তিতে প্রশান্তিলাভের এবং জনগণের প্রশংসিত ভালোবাসার স্বীকৃতি। আরো থাকে পুরস্কার পাওয়ার ও সুনাম অর্জনের অদৃশ্য প্রত্যাশা। অনুরূপ মুসলিমদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেএে সাফল্য অর্জনে থাকবে একনিষ্ঠ ঈমানের সংশ্লিষ্টতা, আল্লাহ তা’আলার প্রতি অকৃতিম ভালোবাসার গুরুত্ব ও ধর্মীয় মূল্যবোধের জ্ঞান এবং সুচারুভাবে কার্যসম্পাদনে আন্তরিকতা। ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে এহসানের গুরুত্ব ও ভাবার্থ সম্পর্কে জীব্রিল (আ.)-এর প্রসিদ্ধ হাদিস থেকে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন নবী (সা.) লোকদের সামনে বসেছিলেন। এমন সময় একজন লোক এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, ঈমান কি? তিনি (সা.) বললেন, ঈমান এই যে, তুমি আল্লাহ, তার ফিরেশতা, (পরকালে) তার সাথে সাক্ষাৎ ও তার রসূলগণের প্রতি বিশ্বাস রাখবে। মরণের পর আবার জীবিত হতে হবে, তাও বিশ্বাস করবে। লোকটি জিজ্ঞেস করল, ইসলাম কি? তিনি (সা.) বললেন, ইসলাম এই যে, তুমি আল্লাহর ইবাদত করতে থাকবে এবং তার সাথে (কাউকে) শরীক করবে না, নামায কায়েম করবে, নির্ধারিত ফরয যাকাত দেবে এবং রমজানের রোযা রাখবে। সে জিজ্ঞেস করল, এহসান কি? তিনি (সা.) বললেন, (এহসান এই যে) তুমি (এমনভাবে আল্লাহর) ইবাদত করবে যেন তাকে দেখছ; যদি তাকে না দেখ, তিনি তোমাকে দেখছেন (বলে অনুভব করবে)।---- এরপর লোকটি চলে গেল। তিনি (সা.) বললেন, তোমরা তাকে ফিরিয়ে আন। কিন্তু সাহাবীগণ দেখতে পেলেন না। তখন তিনি (সা.) বললেন, ইনি (ছিলেন) জীব্রাঈল (আ.); লোকদেরকে তাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে এসেছিলেন। {সহীহ আল-বোখারী,খন্ড ১, ৪৮}। এই হাদিসে ইবাদত করার ক্ষেএে এহসানের গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী শরিয়তে প্রদত্ত সতাসত্য হিসেবে প্রমানিত পদ্ধতিতে ইবাদত করে ইবাদতকে সুন্দর করার সদিচ্ছা হচ্ছে ইবাদত গ্রহণযোগ্য হওয়ার ক্ষেএে একটি অন্যতম শর্ত। আল্লাহ-সচেতন হৃদয় ও জবাবদিহির ভয়ের বৈশিষ্ট্য ব্যতিরেকে একাজে সফল হওয়া যায় না। কাজেই ইবাদতে এহসান আরোপ করা বা সুন্দর করা হচ্ছে ঈমানের অংশ। মুসলিমদের জীবনের প্রতিটা কর্ম, চিন্তাভাবনা যেমন ইবাদতের অংশ অনুরূপ পবিত্র রমজানের প্রতিটা মূর্হুত হচ্ছে ইবাদত। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার যিকিরে মশগুল থাকার জন্য আল্লাহ-সচেতন হয়ে সবকিছু করার সদিচ্ছা।  উপরোল্লিখিত হাদিস থেকে সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তা’আলাকে দেখা কারও পক্ষেই সম্ভব নয় তাই রাসূল (সা.) বলেছেন আল্লাহ তা’আলা তোমাকে দেখছেন এরকম সচেতন চিত্তে অর্থাৎ আল্লাহ-সচেতন [এহসান অবলম্বনে] হৃদয়ে ইবাদত কর। জেনে রাখা ভালো যে, বিশ্বজাহানের অন্তর্ভূক্ত প্রকাশ্য ও গোপনীয় কোনো কিছুই সর্বজ্ঞ আল্লাহ তা’আলার জ্ঞানের বর্হিভূত নয়। সীমাহীন জ্ঞান দিয়ে আল্লাহ তা’আলা সর্বএ উপস্থিত আছেন, সবার কর্ম, ভালো-মন্দ চিন্তাভাবনা, ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে হৃদয়ের অবস্থান, হৃদয়ে লুকিয়ে রাখা পরিকল্পনা সবকিছুই আল্লাহ তা’আলা জানেন বা দেখছেন। এরকম বিশ্বাসই মুসলিমদের গভীর ঈমানে প্রতিষ্ঠিত থাকতে সাহায্য করে এবং এহসানের সাথে ইবাদত করায় উদ্বুদ্ধ করে। মোদ্দা কথা হল, আল্লাহ-সচেতন হৃদয় বা আল্লাহ তা’আলার উপস্থিতি সম্পর্কে স্মরণ রাখার যোগ্যতা ব্যতিরেকে কেউ সাফল্যের পরিপূর্ণতা দেখতে পারেন না। কৃতকর্মের শুদ্ধতা, ন্যায্যতা, বৈধতা বিচার করে অবৈধ ও অপকর্ম থেকে নিরাপদে থাকায় সর্তকতা অবলম্বন করতে পারেন না। 

গভীর ঈমানের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এহসান ]আল্লাহ-সচেতন হৃদয়], রমজানে রোযা পালনে উপহার দেয় ইবাদতে পরিপূর্ণতা এবং প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জনের নিশ্চয়তা। উল্লেখ্য যে, মানবের পার্থিব জীবন-যাপনের প্রতিটা ক্ষেএে/কর্মে আল্লাহ তা’আলার [ সীমাহীন জ্ঞান দিয়ে] উপস্থিতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে জবাবদিহির ভয়ে ঈমানদাররা কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় অবৈধ কাজে জড়িত হতে পারেন না। তাতে ব্যক্তি জীবন, পরিবারের এবং সমাজের সকলেই অবৈধ অপকর্মের অভিশাপ থেকে নিরাপদে থাকার সুযোগ পান। পবিত্র রমজানের রোযা পালন এমন একটা পরিপূর্ণ ইবাদত যার সাথে জড়িত রয়েছে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং জীবন ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বিষয়ের সম্পৃক্ততা। এর মধ্যে ব্যক্তি জীবনঘনিষ্ঠ এমনকিছু বিষয় রয়েছে যা অন্য কারও অনুপস্থিতিতে ও গোপনে সম্পাদন করা যায় তবে আল্লাহ তা’আলার সীমাহীন জ্ঞান থেকে কোনো অবস্থাতেই গোপন রাখা যায় না। এসম্পর্কে উল্লেখ্য যে, নর-নারীর যৌনতা, শাইত্বানের অনুপ্রেরণায় খারাপ চিন্তাভাবনা, চোখ, কান, হাত, পা দিয়ে গোপনে করা যায়, ঈর্ষান্বিত হৃদয়ের বাসনা ও সহিংসতা লালন করা এবং রোযা রেখেও রোযা ভাঙ্গার মত কাজে জড়িত হওয়া। তদুপরি জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়: পরর্চ্চা করা, অপ্রয়োজনীয় কথা বলা, অযথা সময় নষ্ট করা, চিত্তবিনোদনের জন্য প্রবৃত্তির অবৈধ চাহিদায় অশ্লীল দৃশ্য দেখা এবং তাতে অংশগ্রহণ করা, সংস্কৃতির প্রগতির নামে নারী-পুরুষের অবাধ সংমিশ্রণে অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া, মিথ্যা কথা বলা, দূর্নীতিতে জড়িত হয়ে মানুষের ও দেশের সম্পদ আত্মসাৎ করা, অন্যদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে কারও সাথে ঝগড়া-বিবাদে জড়িত হওয়া, রোযা রাখা সত্ত্বেও নামায আদায় না করা ইত্যাদি গর্হিত কর্ম থেকে নিজেকে সংরক্ষিত করতে এহসানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আল্লাহ-সচেতন হয়ে মানসিকভাবে দৃঢ়সংকল্পে প্রতিষ্ঠিত না হলে এগুলো থেকে বিরাত থাকা কঠিন। কাজেই বলা বাহুল্য একঠিন কাজে সফল হতে প্রবৃত্তির অবৈধ চাহিদার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যই একাজ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৭: হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন।{সূরা মুহাম্মদ}। অর্থাৎ তোমরা যদি ইসলামী শরিয়তের বিধিবিধান [আল-কুর’আন এবং সুন্নাহর] সঠিকভাবে মেনে দৃঢ়সংকল্পে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে উদ্বুদ্ধ হও তবে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের সংগ্রামে সাহায্য করবেন। আমরা জানি, আল্লাহ তা’আলার কোনো কাজেই সৃষ্টিজগতের কারও সাহায্য তার দরকার নেই তবে মানুষের মাধ্যমেই আল্লাহ তা’আলা তার দ্বীনকে সংরক্ষণ করে থাকে। আল্লাহ তা’আলা আরও বলেছেন, ৬৯: যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিযোগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।{সূরা আল-আনকাবুত}। অতএব বলাই বাহুল্য আত্মশুদ্ধির জন্য সংগ্রাম না করলে আল্লাহ তা’আলা সাহায্য করেন না। এসম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ১১: আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।{সূরা আর-রা’দ}। পবিত্র রমজানের ২৯ বা ৩০ দিন এহসান অবলম্বনে ইবাদত এবং জীবন ঘনিষ্ঠ কর্ম সম্পাদন করার অভ্যাস সৃষ্টি হলে পরবর্তীতে তার প্রভাব আল্লাহ-প্রেমী বান্দাদের হৃদয়ে উজ্জীবিত থাকবে, এরকম আশা, ইনশা আল্লাহ করা যায়। 

এপর্যায়ে পরর্চ্চা বা গীবত সম্পর্কে আল-কুর’আনের আয়াতে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞা এবং হাদিসে দেওয়া সতর্কতা সম্পর্কে বাড়তি আলোচনা করা হল। কারণ পবিত্র রমজানে পরর্চ্চায় জড়িত হওয়া থেকে বিরত না থাকলে রোযার উদ্দেশ্য ব্যর্থ ব্যাহত হবে। তাই এহসানের সাথে রোযা পালন করতে হবে, যেখানে পরর্চ্চার মতো গর্হিত পাপ জড়িত থাকবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,  ১২: মু’মিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেচেঁ থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা [পরর্চ্চা] না করে। তোমাদের কি তার মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।{সূরা হুজুরাত}। পরনিন্দা করা বা পরর্চ্চায় জড়িত থাকার অভ্যাস মানব হৃদয়ে লালিত একটা বিধ্বংসীরোগ, যার ছোবল থেকে নিজ পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীবৃন্দ, প্রতিবেশি, পরিচিত ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক সহকর্মী ও বিরোধী দলের সদস্য, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর কেউ নিস্তার পায় না। এই অদৃশ্যরোগের সাথে জড়িত থাকে ঈর্ষান্বিত হৃদয়ের সম্পৃক্ততা কাজেই এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা অত্যন্ত কঠিন কাজ। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আলেম-ওলামাদের অনেকেই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এই গর্হিত কাজে জড়িত হয়ে পড়েন। বিশেষ কোনো বিষয় নিয়ে একএে গল্প করতে বা আড্ডায় বসলেই আলোচনার মূল বিষয় ক্রমশ পরর্চ্চায় পরিণত হয়। কারও দোষ-ত্রুটি অথবা চরিএের দূর্বলতা নিয়ে সমালোচনা, কটুক্তি করা হয়ে যায় আলোচনার মূল বিষয়। কাউকে হেয়জ্ঞান করার জন্য সামান্য দোষকে অতিরঞ্জিত করে অনেক বড় করে দেখানো হয়। এসম্পর্কে শব-ই-মিরাজের হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, “আমাকে নিয়ে যাওয়া হলে আমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছ দিয়ে গেলাম যাদের নখ ছিল তামার। তারা তাদের মুখমন্ডল ও দেহের মাংস আচঁড়াচ্ছিল। আমি জীব্রিল (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম এরা কারা? তিনি বললেন: এরা তাদের ভাইয়ের গীবত করত এবং তাদের ইজ্জতহানী করত। রাসূল (সা.) আরও বলেন, “গীবত ব্যভিচারের চাইতেও মারাত্মক গোনাহ। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, এটা কিরূপে? তিনি (সা.) বললেন, একব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তাওবা করলে তার গোনাহ মাফ হয়ে যায়, কিন্তু যে গীবত করে, তারা গোনাহ প্রতিপক্ষের মাফ না করা পর্যন্ত মাফ হয় না।{মাযহারী, মা’আরেফুল কুর’আন, পৃষ্টা ১২৮৫}। 

কাজেই বলা যায় যে, গীবতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার হক ও বান্দার হক উভয়ই নষ্ট করা হয়ে থাকে। পবিত্র রমজানে এই অমার্জনীয় পাপ থেকে মুক্ত থাকতে না পারলে বলাই বাহুল্য রোযাদারদের রোযার পবিত্রতা ও মাহাত্ম্যের প্রতি শ্রদ্ধার এবং পরহেজগারী অর্জনে আন্তরিকতা  থাকে না। কারণ রোযা পালনে এহ্সানের কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। পরর্চ্চার সাথে জড়িত থাকে মিথ্যার বলার অভ্যাস ও অন্যদেরকে হেয় করার প্রবল ইচ্ছা। মুসলিম ভ্রাতৃত্ববন্ধনের সংহতি ও পরস্পরের কল্যাণ কামনার গুরুত্বকে ইসলামী শরিয়তে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে সেটা উপরোল্লিখিত আয়াত থেকে সহজেই অনুমেয়। পরর্চ্চা করাকে মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার মত ঘৃণিত কাজের সাথে আল্লাহ তা’আলা তুলনা করেছেন। এই আয়াতের ব্যাখ্যা করা যায় একাধিক দৃষ্টিকোন থেকে তবে প্রসিদ্ধ আলেমদের মতে মৃত মানুষের শরীরে আঘাত লাগলে যেমন প্রতিবাদ করতে পারেন না তেমন মুসলিম ভাই-বোনদের অনুপস্থিতিতে তাদের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য বা কুৎসা রটনা করলে তারা প্রতিবাদ করার সুযোগ পান না। অতএব পরর্চ্চার মত গর্হিত পাপ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ-সচেতনতার বা এহ্সান অবলম্বনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অনুরূপ রোযা পালনের মর্যাদাকে ও পরহেজগারীর বৈশিষ্ট্য অর্জনকে অঁটুট রাখার জন্য পরর্চ্চার অভ্যাস পরিত্যাগ করার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পরর্চ্চা করা এবং প্রশ্রয় দেওয়া, শ্রবণ করা সবই হারাম। পরর্চ্চার মধ্যে মিথ্যাচার জড়িত থাকে, কাজেই পরর্চ্চাকারীকে পরর্চ্চা থেকে বিরত রাখা, প্রশ্রয় না দেওয়া এবং না শোনা বস্তুত মিথ্যাচারকে প্রতিহত করা হয়। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা বুঝতে পারি না যে, মানবতার চিরশত্রু শাইত্বান রমজান মাসে শিকলে আটকা থাকলেও আমাদেও নাফস বা প্রবৃত্তির শাইত্বান থেকে আমরা মুক্ত থাকি না। কারণ পরর্চ্চায় জড়িত হওয়ার পিছনে মূল কারণ হচ্ছে প্রবৃত্তির চাহিদা। তাই পবিত্র রমজান থেকে লাভবান হতে প্রবৃত্তির এই অবৈধা চাহিদা নিয়ন্ত্রণ কওে এহ্সানকে অবলম্বন করতে হবে। যাতে এটা আমাদেও অভ্যাসে পরিণত হয়। তাই শুধুমাএ পবিত্র রমজানে নয় বরং সারা বছরই পরর্চ্চাকারীদের সাথে একই প্রকার আচরণ করা আল্লাহ-সচেতন হৃদয়ের অবস্থান সম্পর্কে প্রতিবাদন হয়। একাজে ধীশক্তিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ ব্যক্তির কর্তব্য সম্পর্কে উল্লেখ করে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৬৩: রব্বানীরা [আল্লাহভীরু বান্দা] এবং আলেমরা কেন তাদেরকে পাপ কথা বলতে এবং হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করে না? তারা খুবই মন্দ কাজ করছে।{সূরা আল-মাইয়েদা}। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, শুধুমাএ আলেমদের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে না দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে এবং পবিত্র রমজানের মাহাত্ম্যকে সমোন্নত রাখতে পরর্চ্চাকারীকে পরর্চ্চা হতে বিরত রাখার এবং না শোনার দায়ভার সকলের উপরই রয়েছে।

এহ্সান সম্পর্কে আল-কুর’আন: এহসান সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা আরও বলেছেন, ৯০: আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা [আল-আদ্ল], সদাচরণ [আল-এহসান} ও আত্মীয়স্বজনকে [আল-কুরবা] দানের নিদের্শ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন আশ্লীলতা [আল-ফাহ্্শা], অসৎকার্য [আল-মুনকার] ও সীমালংঘন [আল-বাগী]; তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।{সূরা আন-নাহ্্ল}। এই আয়াতে বর্ণিত তিনটি কাজ করার আদেশ: ন্যায়বিচার, সদাচরণ [এহসানের সাথে বা সুন্দরভাবে করা], আত্মীয়স্বজনের প্রতি দয়া দেখানো, অনুগ্রহশীল হওয়া; আরও তিনটি কাজ: অশ্লীলতা, যাবতীয় মন্দ কাজ এবং জুলুম ও উৎপীড়ন থেকে বিরত থাকার আদেশ আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন। এগুলো জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়, পবিত্র রমজানে এগুলো সঠিকভাবে মেনে রোযা পালন করা বস্তুত পরহেজগারী অর্জনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেএে সফল হতে আদল এবং এহসান অবলম্বনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। স্মতর্ব্য যে, উপরোক্ত আয়াতে আদলের [ন্যায়বিচার অর্থাৎ বিচারে সমান করার] ভাবার্থ অত্যন্ত ব্যাপক তবে নিজের বাহ্যিক কর্মের সাথে অন্তরের চিন্তাভাবনাকে ও বিশ্বাসকে সমন্বয় করা হচ্ছে একটা বিশেষ অর্থ। বাহ্যিক কার্যকলাপের সাথে আভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনার, উদ্দেশ্যের ও ইচ্ছার সমন্বয় হচ্ছে ঈমানের পরিচয়। এর বিপরীতে হবে হৃদয়ে মোনাফেকি আচরণ লালন করার লক্ষণ। অতএব বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণের মধ্যে সমন্বয় করা হচ্ছে নিজের প্রতি ন্যায়বিচার করা তদ্ব্যতিরেকে নিজেকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।  অনুরূপ আদলের আরো অর্থ হচ্ছে মানুষ ও আল্লাহ তা’আলার অধিকারের ক্ষেএে ন্যায়বিচার করা। আল্লাহ তা’আলার অধিকারকে [হক্কে] নিজের ভোগবিলাসের উপর এবং তার সন্তষ্টিকে নিজের কামনা-বাসনার  উপর অগ্রাধিকার দেওয়া। আল্লাহ তা’আলার আরোপিত বিধানাবলী যথাযথভাবে পালন করা এবং নিষিদ্ধ [উপরোল্লিখিত তিনটি নিষিদ্ধ বিষয়] ও হারাম বিষয়াদি [মানুষের ন্যায্য অধিকার বা হক্্ সম্পৃক্ত বিষয়ও এর অন্তর্ভূক্ত] থেকে বেঁচে থাকা। দ্বিতীয় আদল হচ্ছে: নিজের সাথে আদল করা, যেমন দৈহিক ও আত্মিক ধ্বংসের কারণাদি বস্তু থেকে নিজেকে বাচাঁনো, নিজের এমন কোনো কামনা পূর্ণ না করা যা পক্ষান্তরে ক্ষতির কারণ হয় এবং সবর ও অল্পেতুষ্টি থাকা এবং নিজের উপর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা না চাপানো। আর তৃতীয় আদল হচ্ছে নিজের ও সমগ্র সৃষ্টজীবের সাথে সহানুভূতিমূলক ব্যবহার করা, কারও সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করা, সবার জন্যই নিজের মন ও বিবেকের কাছে সুবিচার দাবী করা [ সকলের কল্যাণে নিজের অবৈধ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা] এবং কাউকে কথা অথবা কর্ম দিয়ে প্রকাশ্যে ও গোপনে কোনোরূপ কষ্ট না দেওয়া। রমজান মাসে রোযার পবিত্রতায় রোযা পালনের মহৎ উদ্দেশ্যকে সফল করতে উপরোল্লিখিত সবকিছুই মুসলিমদের ইচ্ছার, আকাঙ্খার, উদ্দেশ্যের, চেষ্টার ও প্রবৃত্তির চাহিদার এবং চরিএের বৈশিষ্ট্য হতে হয়। এগুলোতে প্রতিষ্টিত থাকা এবং লালন করার অদম্য ইচ্ছা হচ্ছে বস্তুত ইবাদতের অংশ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উপরোল্লিখিত বিষয়ে সত্যনিষ্ঠ অন্তরে প্রতিষ্ঠিত থাকা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। কাজেই এহসান [আল্লাহ-সচেতন হৃদয়ে সুন্দরভাবে করার ইচ্ছা ] অবলম্বনে সম্পাদন না করলে এগুলোতে সফল হওয়া যাবে না। পবিত্র রমজানের মাহাত্ম্যে এগুলো এহসানসহ সম্পদন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। কাজেই রমজানে রোযা পালন হচ্ছে এমন এক পরিপূর্ণ ইবাদত, যদ্বারা মুসলিম উম্মত আত্মসংযমে আত্মশুদ্ধির সুযোগ পেয়ে থাকেন। কারণ রাত-দিন সর্বক্ষণ রোযার পবিত্রতায় আল্লাহ তা’আলার স্মরণে মুসলিমদের হৃদয় প্রতিষ্ঠিত থাকে। এজন্যই মুসলিম জাহানে রোযার মাসে অনৈতিক ও অপ্রয়োজনীয় কর্মের এবং অযথা, অশ্লীল মানব সহজাত প্রকৃতি বিরোধী আচরণের পরিমান  যা আল্লাহ তা’আলার অসন্তুষ্টির কারণ হয়, বহুলাংশে হ্রাস পায়। তাতে ইবাদীরা নিজের চরিএ, কর্ম, ব্যহ্যিক ব্যাবহার, মানব কল্যাণে পরস্পরের প্রতি প্রদর্শিত আচার-আচরণকে, প্রতিদিনের অভ্যাসকে সুন্দর করতে পারেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে পারস্পরিক লেনদেনে সততা অবলম্বনে ন্যায়বিচার করে সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে দৃষ্টান্তমূলক  উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন। পরস্পরের প্রতি ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শন এবং অনুগ্রহশীল হওয়া এহসানের বৈশিষ্ট্য। এগুলো সাধারণত সদাচরণের অন্তর্ভূক্ত কাজেই মানব নিষ্ঠুরতা, উদ্ধত ও অহংকারী প্রকৃতির বিপরীতে।  পবিত্র রমজানে মুসলিম উম্মতের একটা বিশেষ অংশ  মানব নিন্দনীয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে থাকেন। আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্যলাভের প্রত্যাশায় তারা কারও খারাপ আচরণ দেখেও প্রতিশোধের পরির্বতে ক্ষমা প্রদর্শন করতে অর্থাৎ এহসান অবলম্বন করতে ভালোবাসেন। এই প্রকৃতির ব্যক্তিদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৩৪: সমান নয় ভালো ও মন্দ। জবাবে তাই বল যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবে তোমার সাথে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। ৩৫: এ চরিএ তারাই লাভ করে, যারা সবর করে এবং এ চরিএের অধিকারী তারাই হয়, যারা অত্যন্ত ভাগ্যবান। ৩৬: যদি শাইত্বানের পক্ষ থেকে তুমি কিছু কুমন্ত্রণা অনুভব কর, তবে আল্লাহর স্মরণাপন্ন হও। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। {সূরা হা-মীম সাজদাহ}। এই আয়াত থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, অদৃশ্য শাইত্বান মানুষকে খারাপ কাজে জড়িত করতে কুমন্ত্রণা দেয় এবং প্রবৃত্তির চাহিদায় নানা ধরণের পাপ কাজে জড়িত হওয়ায় অনুপ্রেরণা দেয়। রাসূল (সা.) উম্মতের প্রতি উপদেশ দিয়ে বলেছেন, “তোমরা অনুকরণপ্রিয় হয়ো না যে, তোমরা এরূপ বলবে, লোকেরা যদি আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে তবে আমরাও ভালো ব্যবহার করবো। যদি তারা আমাদের উপর জুলুম করে তবে আমরাও জুলুম করব। বরং তোমরা নিজেদের হৃদয়ে এ কথা বদ্ধমূল করে নাও যে, লোকেরা তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করলে তোমরাও ভালো ব্যবহার করবে। তারা তোমাদের সাথে অন্যায় আচরণ করলেও তোমরা জুলুমের পথ বেছে নিবে না।”{তিরমিযী ১৯৫৬। অতএব বলাই বাহুল্য, রমজানে এহসান অবলম্বনে রোযা পালন করলে যে উদ্দেশ্যে  আল্লাহ তা’আলা রোযা পালনের আদেশ দিয়েছেন তাতে উর্ত্তীণ হওয়া সহজ হয়। ইনশা আল্লাহ চলবে। 


শেয়ার করুন