দশ বছরের দন্ড পেয়ে যেখানে নিম্ন আদালতে আত্মসমার্পনের নির্দেশ। সেটা উপেক্ষা করে অনেকটা পালিয়ে একজন সংসদ সদস্য বা আসামী সবার চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে বিদেশ চলে যেতে পারে এ ঘটনা ছিল ঈদুল ফিতরের ছুটিতে টক অব দ্যা কান্ট্রি। হাজি সেলিম। এখন ব্যাংককে রয়েছেন। উদ্দেশ্য দেখানো হয়েছে, উন্নত চিকিৎসা। তার ব্যক্তিগত সচিব বলছেন, উনি পালিয়ে যাবেন কেন? উনি দেশে ফিরে আত্মসমার্পন করবেন। তার আগে উনি ওনার স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলো করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু আসলেই কী। হাজী সেলিম না হয় ফিরলেনই।
কিন্তু একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী আদালতের বিচারে অভিযুক্ত। তাকে আত্মসমার্পন করতে বলা হয়েছে। তিনি অনুমতি না নিয়ে চুপিসারে বিদেশ চলে গেলেন। ফিরলে তিনি ফিরতেও পারেন। না ফিরলেও সেখানে কারোরই কিছু করার নেই। ব্যাংকক হয়ে তিনি যদি ইউরোপ, কানাডা যে কোনো অজানা এক দেশে চলে যেয়ে আশ্রয় নিলেন। কার কী করার আছে।
কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে এভাবে কী দন্ডপ্রাপ্তরা পালিয়ে চলে যেতে পারেন? হাজী সেলিমের এ ঘটনায় উঠে আসছে বেগম খালেদা জিয়া প্রসঙ্গ। তিন বারের প্রধানমন্ত্রী। ৭৫ বছর বয়স। অনেক দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত। বিএনপির মত দেশের একটি জনপ্রিয় ও বেশ ক’বার দেশ পরিচালনা করা পার্টির চেয়ারপার্সন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং সে অনুপাতে আদালত দন্ড দিয়েছেন। তিনি জেলে দীর্ঘদিন কাটালেন।
ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন /ফাইল ছবি
এ নিয়ে তোলপাড় দেশ ও দেশের বাইরেও। সরকারের টনক নড়েনি। পরিবারের পক্ষ থেকে এমনকি সর্বস্তরের লোক, সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে অনে
কেই তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতির আবেদন করেছেন। কিন্তু সরকার বারবার বলেছেন, দন্ডপ্রাপ্তদের দেশের বাইরে যাওয়া আইনের আওতায় পড়ে না।
ফলে তাকে অনুমতি দেয়া যায়না। এমনকি মাসের পর মাস,বছর ধরে সে আবেদন একের পর এক খারিজ করে দেয়া হয়েছে। সেখানে আরেক দন্ডপ্রাপ্ত, যিনি বর্তমান সরকারেরই সংসদ সদস্য। তিনি কিভাবে দন্ডিত হয়েই দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারলেন? এ ক্ষেত্রে কী কোনো আইনের ব্যাখ্যা নেই। নিয়মের বালাই নেই? আইন কী নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য বরাদ্দ? অন্যরা কী এর বাইরে? ঈদের সময় হাজি সেলিমের ঘটনাটিই অলোচিত। এ ব্যাপারে দেশ’র এ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় সিনিয়র আইনজীবী রাজনীতিবিদ ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে। খোকন সেলিম প্রসঙ্গ টেনে বলেন,‘দেশে স্পষ্ট দ্বৈত শাসন বিরাজ করছে। এ (হাজি সেলিম) ঘটনা সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো।’
ব্যারিস্টার খোকন বলেন,‘খালেদা জিয়া কোনো অপরাধ করেনি। বিনা অপরাধেই তাকে শাস্তি দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। শাস্তি ভোগ করছেন। তিনি প্রচন্ড অসুস্থ। তাকে হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডও তার চিকিৎসার যে স্তর সে ব্যাবস্থা বাংলাদেশে না থাকার দরুন দেশের বাইরে নেয়ার জন্য বার বার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সে আবেদন গৃহীত হয়নি। তিনি এখনও অসুস্থ,চিকিৎসাধীন। অথচ একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী তাদের (সরকার দলীয়) লোক হওয়ায় কিভাবে বিদেশে চলে গেলেন।’
তিনি বলেন,‘সরকার বিচার বিভাগ,দুদক,পুলিশ বিভাগ সব কিছু দলীয়করণ করে প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে। না হয় একজন নিরাপদ মানুষ (বেগম খালেদা জিয়া) সম্মানিত মানুষকে বিনা অপরাধে জেলে ভরে রাখছে, সেখানে তাদের লোক দন্ডপ্রাপ্ত হয়েও সবার সম্মুখ দিয়ে বাইরে চলে যেতে পারে।’ তিনি বলেন,‘এটা আড়ালে আবডালে নয়। প্রকাশ্যেই তো বিমানবন্দর দিয়ে তিনি পার হয়ে চলে গেছেন। এটা স্পষ্ট সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকার দলের স্পষ্ট দ্বৈতনীতি। যা প্রমাণিত।’
উল্লেখ্য, গত শনিবার হাজী সেলিম হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেছেন ।
এদিকে আওয়ামী লীগের এ রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ওই মামলায় প্রায় এক যুগ আগে বিচারিক আদালতের রায়ে হাজী সেলিমের ১৩ বছর দন্ড হয়েছিল। ওই সাজার রায়ে হাজি সেলিম আপিল করেছিলেন। সে আপিলের রায় শুনানী নিয়ে ২০২১ সনের ৯ মার্চে ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করে।
‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের দায়ে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্যের ১০ বছর কারাদন্ড বহাল রাখে হাইকোর্ট এবং পুর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে। এবং রায়ের পুর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমার্পনের নির্দেশ দেয়া হয়। হাজী সেলিমের রায়ের পুর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশের সাথে সাথে বিদেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকটা গোপনে লুকোচুরি করে বিমানবন্দরে পৌঁছে চলেও যান। এ কাজে তাকে কে কে কিভাবে সহায়তা দিয়েছেন এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাজী সেলিমের দেশত্যাগের বিষয়ে আমরা কিছুই জানিনা। উনি কিভাবে যেতে পারলেন তা আমাদের প্রশ্ন। তার বিদেশ যাওয়ার কোনো আইনি সুযোগ নেই। উনার তো আদালতে আত্মসমার্পন করার কথা ছিল।’
এদিকে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ঘটনার পর স্থানীয় একটি টেলিভিশনকে মিডিয়াকে বলেছেন, ‘এই ক্ষেত্রে তাঁর (দন্ডপ্রাপ্ত আসামী হাজি সেলিম) সাজা হয়েছে বিচারিক আদালতে। আপিল প্রক্রিয়াও শেষ হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতেও তাঁর সাজা বহাল রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করার আদেশ দিয়েছেন।
সে অবস্থায় সেই ব্যক্তি কোনোভাবেই দেশত্যাগ করতে পারেন না। যাঁরা তাঁকে দেশত্যাগ করতে সাহায্য করেছেন, তাঁরা মস্ত বড় অপরাধ করেছেন। তাঁরা সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করেছেন। এখন তিনি দেশে ফিরে না এলে তখন কী হবে? সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তাঁর দেশে ফেরার সম্ভাবনাও কম।’ ঘটনা নিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।