১২ এপ্রিল ২০১২, বুধবার, ০৪:৩৬:৫৩ পূর্বাহ্ন


রাষ্ট্র প্রশাসনে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার ঘটছে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-১০-২০২২
রাষ্ট্র প্রশাসনে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার ঘটছে শাহরিয়ার কবির


একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির অভিযোগ করেছেন, ‘রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার ঘটছে। সমাজ ও প্রশাসনের ভেতর যারা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ভাইরাস ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে পূর্বাহ্নে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কখনও শান্তিপূর্ণ হবে না এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বিনষ্ট হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক মতলবে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে, যে কাজটি বঙ্গবন্ধু করেছিলেন ’৭২-এর সালের সংবিধানে। আমরা আশা করব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।

শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ‘আন্তধর্মীয় সংলাপ এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ শীর্ষক ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী সমাজকর্মী আরমা দত্ত এমপি, বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা মহিব উল্লাহ শান্তিপুরী, ঢাকার শ্রী শ্রী প্রণব মঠের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী সঙ্গীতানন্দজী মহারাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান ফাদার ড. তপন ডি রোজারিও, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সঙ্গীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদের কন্যা কলাম লেখক শাওন মাহমুদ।

সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির আরো বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ১৪/১৫ মাস সময় থাকলেও নির্বাচন কমিশন, সরকার, বিরোধী দল, এমন কি নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী এনজিওগুলো বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য নির্বাচন উৎসব হলেও অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিভিন্ন তৎপরতার কারণে নির্বাচনে সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এক ধরনের আতঙ্কের ভেতর থাকেন। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকালে বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসীদের হাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন, যার কারণে সেই সময় তিন লক্ষাধিক সনাতন ধর্মাবলম্বী ’৭১-এর মতো প্রতিবেশি ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি বলেন,  ‘রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার ঘটছে, যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্নধর্ম ও ভিন্নমতের মানুষদের প্রতি বিষোদগার করা হয় তা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াতের জোট বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এ কারণে আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশন, সরকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে ২০১৮ সালের মতো পূর্বাহ্নেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যার একটি হচ্ছে আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধর্মের নেতৃবৃন্দের সংলাপ, যে কাজ আমরা ধারাবাহিকভাবে করছি। সমাজে ও প্রশাসনের ভেতর কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটেছে তার দুটি সাম্প্রতিক উদাহরণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গোচরে আনতে চাই। এবার অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে দূর্গাপূজা হয়েছে এবং একই দিনে মুসলমানদের ঈদে মিলাদুন্নবী, হিন্দুদের লক্ষ্মীপূজা ও বৌদ্ধদের প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠানের সিংহভাগ সাফল্য অবশ্যই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিতে হবে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিঃসন্দেহে আমাদের ধন্যবাদ পাবেন। তবে এক হাড়ি দুধের ভেতর এক ফোঁটা চোনা পড়লে সমস্ত দুধ যেমন নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি লালমনিরহাটে দূর্গা পূজার ম-পে কর্তব্য পালনের জন্য নারী আনসার ভিডিপি বাহিনীর সদস্য নূর ভানুর পিতাকে এলাকার মৌলবাদী দুষ্কৃতকারীরা ফতোয়া দিয়ে একঘরে করেছে এবং তাকে মসজিদে নামাজ পর্যন্ত পড়তে দেয়া হয়নি। অন্যদিকে গত সপ্তাহে গণমাধ্যমে দেখেছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙ্গে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপের হুমকি প্রদানকারী হেফাজতে ইসলামীর নেতা মামুনুল হক, জুনায়েদ বাবুনগরী এবং চরমোনাইর পীরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় পুলিশের ব্যুরো-অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে হেফাজতি ভাষায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। আমরা এতে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। 

আরমা দত্ত এমপি বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন এলে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে সহিংসতার ম্যাপিং করা হয়। একটি স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী এই ষড়যন্ত্রটি করে। তারা ধর্মকে একটি অস্ত্র হিসেবে দেখে। নির্বাচন এলেই বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এই অস্ত্রের শিকার হয়। এই স্বাধীনতাবিরোধীদের সকল যড়যন্ত্র নস্যাৎ করে সামনের নির্বাচনে আমরা অসাম্প্রদায়িকতার বিজয় দেখতে চাই।

শাওন মাহমুদ বলেন, ‘২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ায় মৌলবাদীরা রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের হাত ভেঙ্গে ফেললে গুটিকতক মানুষ ছাড়া আর কেউ তেমন প্রতিবাদ জানায়নি। মৌলবাদীরা যখন ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গুড়িয়ে দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে’ বলে মন্তব্য করে তখনও তেমন কেউ প্রতিবাদ জানায়নি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছি। কিন্তু এই সুযোগে মৌলবাদী ও হেফাজতিরা একজোট হয়ে বাংলাদেশকে মোল্লা উমরের আফগানিস্তান বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন সময় এসেছে আমাদের পুনরায় একত্রিত হয়ে মৌলবাদী হেফাজত-জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার, প্রতিহত করার।’

মওলানা মহিব উল্লাহ শান্তিপুরী বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। আজকে সেই দেশে নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ সৃষ্টি করে একদল মানুষ ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। কোন সম্প্রদায়িক শক্তি যেন কোনভাবেই ক্ষমতায় বসতে না পারে সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, ‘দাড়ি-টুপি থাকলে কেউ আলেম-ওলামা হয়ে যায় না। ইসলাম ধর্ম কোন পোশাকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। যে যার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধান করবে। মহানবী নিজ দেশের আবহাওয়া অনুযায়ী যেমন পোশাক পড়তেন আমাদেরও তেমনি আমাদের দেশের আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক পরিধান করতে হবে এতে কোন বাধা নেই। আমরা লক্ষ্য করেছি কিছু মানুষ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পোশাক প্রশ্নে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়। বর্তমানে ইরানে এক নারীর হিজাব না পারার কারণকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে তা মূলত জোর করে চাপিয়ে দেয়া পোশাকের কারণেই ঘটেছে। সাধারণ মানুষ এর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তিনি শিক্ষানীতি নিয়ে বলেন, ‘ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক না কেন বাংলাদেশে ব্রিটিশদের বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাদ দিয়ে একক শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

স্বামী সঙ্গীতানন্দজী মহারাজ বলেন, ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। অথচ পৃথিবীর কোন ধর্মই এই সহিংসতা সমর্থন করে না। আগামী নির্বাচনে যেন কোনও ধরনের সহিংসতা ও ষড়যন্ত্রের ঘটনা না ঘটে সেজন্য এখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ আলোকিত মানুষদের মতামত অনুসরণ করতে হবে।

ফাদার ড. তপন ডি রোজারিও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন করে গিয়েছেন। যেখানে সকল ধর্মের মানুষ সমঅধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেই আমরা অনেকেই কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ি। এই নির্বাচনের সময় একই ধরনের কিছু ঘটনা ঘটে। কারণ একটি গোষ্ঠী রয়েছে যারা দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে চায়। সাম্প্রদায়িকতা বর্জন ও অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা অর্জনের জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় বলেন, ‘২০২৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু একসময় আমরা মনে করতাম নির্বাচন এলেই আমরা নির্যাতনের শিকাব হব। যদিও গত নির্বাচনে এরকম ঘটনা ঘটেনি। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন- আমাদের বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এই অসাম্প্রদায়িকতা ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু একটি ধর্মান্ধ অপশক্তি মাঝে মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এদেশটি ৯০% মুসলমানের দেশ কথাটি অনেকেই বলে, কিন্তু আমরা যারা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছি তাদের কি কোন অবদান নেই স্বাধীনতার পেছনে? বঙ্গবন্ধু যেরকম একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ চেয়েছিলেন আমরা ঠিক সেরকম একটি দেশের স্বপ্ন দেখি।

শেয়ার করুন