০৩ মে ২০১২, শুক্রবার, ০২:০৭:৩৬ পূর্বাহ্ন


বিভিন্ন দেশ থেকে তৈরি পোশাক প্রত্যাহারের ঘটনা আসলে কী
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-১১-২০২৩
বিভিন্ন দেশ থেকে তৈরি পোশাক প্রত্যাহারের ঘটনা আসলে কী বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানা


বাংলাদেশে তৈরি কিছু পোশাক বিভিন্ন দেশ নানা অজুহাতে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে-এ খবরে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ঢাকার একটি ডেইলি পত্রিকা রিপোর্ট করার পর সেটা আবার অনলাইন ভার্সন থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ কথা বলেছেন। তবে যে বিষয়ের অবতারণা এটা গার্মেন্টস শিল্পের নিত্য কিছু ঘটনা। মাঝে মধ্যে এমনটা হয়ে থাকে। অর্ডার অনুসারে মাল তৈরি করলেও বাস্তবে দেখা যায় যা নিয়ে ভোক্তার সমস্যার কারণ হলে মার্কেট হারানোর ভয়ে ব্রান্ড কোম্পানি মাল ফেরত নেয়। কিন্তু এটা নিয়ে হঠাৎ কেন তোলপাড়। 

বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন থেকেই ইউরোপসহ নানা দেশে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে, ঝড় আসতে পারে এমন অনেক শঙ্কার কথা ইতিপূর্বে শোনা গেছে। বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশ কিছু শর্তাদি দিয়ে রেখেছে, প্রত্যাশা করেছে। সে অনুপাতে নির্বাচন না হলে ওই সব দেশ কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে বলে যে শঙ্কা সেটার সূত্রপাত এসব উদ্যোগ কি না এ নিয়ে ওই দুশ্চিন্তা। 

বিষয়টি নিয়ে বিবিসি অনলাইন বাংলা একটা বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েব সাইটে গত ৫ নভেম্বর। দেশ-এর পাঠকদের জন্য সেটা নিম্নে তুলে দেওয়া গেল- 

ওই রিপোর্টে বিবিসি বলছে- ‘কানাডাসহ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া নানা ব্র্যান্ডের পোশাক বাজার থেকে তুলে নিতে বলা হয়েছে বলে বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্র্যান্ড কোম্পানির চাহিদা, নমুনা এবং নির্দেশিত উপকরণ দিয়েই বাংলাদেশি কারখানাগুলো পোশাক তৈরি করে সরবরাহ করে। ফলে পোশাক প্রত্যাহারের সঙ্গে কারখানাগুলোর আসলে কোনো দায় বা সংশ্লিষ্টতা নেই। বাংলাদেশে একটিদৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১২টি দেশ থেকে নানা ধরনের পোশাক প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছে সেসব দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পোশাকগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে-এই আশঙ্কা থেকে বাজারে থাকা এসব পোশাকের বিক্রি বন্ধ রাখতে হয়েছে। সেই সঙ্গে এরই মধ্যে যেসব পণ্য বিক্রি হয়ে গিয়েছে সেগুলো ভোক্তাদের কাছ থেকে ফেরত নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। তবে বাজার থেকে পণ্য তুলে নেওয়ার এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের কোন দায় নেই বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা।

বিজিএমইএ বলছে, ক্রেতারা অর্ডার দেওয়ার সময় পণ্যের যাবতীয় বিবরণ দিয়ে থাকে এবং সেই অনুযায়ী পণ্য বানানো হয়। এরপর নমুনা পাঠানো হলে সেটির অনুমোদনের পর মালামাল শিপমেন্ট করা হয়। স্যাম্পল অনুযায়ী পণ্য না পাঠানো হলে অর্ডারই বাতিল হয়ে যেতে পারে। ফলে এক্ষেত্রে বাংলাদেশি কারখানাগুলোর কোনো দায় নেই।

তাদের দাবি, বাংলাদেশ থেকে যখন বিদেশে পণ্য যায়, তখন সেটি সব ধরনের মান উত্তীর্ণ হয়ে ক্রেতাদের চূড়ান্ত অনুমোদন শেষেই পাঠানো হয়। যেসব পোশাক প্রত্যাহারের কথা বলা হচ্ছে, এমনকি সেসব পোশাকের দামও মিটিয়ে দিয়েছে ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো। এখন সেই কারখানায় ডিজাইনে কিছুটা পরিবর্তন এনে ওই ব্র্যান্ডের পোশাকের উৎপাদন চলছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমে বাজার থেকে তুলে নেওয়া এসব পণ্যের প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম প্রচার করায় এই শিল্পে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।’

বিবিসি জানায়, ‘বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, এট একটি ভুল সংবাদ। তবে এ ধরনের ঘটনা একেবারে নতুন কিছু নয়। উন্নত দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানা কারণে অনেক সময় বিভিন্ন পোশাক ও পণ্যবাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে থাকে। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পোশাক, প্রসাধনী পণ্য বাজার থেকে তুলে নেওয়ার উদাহরণ হয়েছে। কানাডায় শিশুদের সিøপার জাতীয় পোশাকটি নিয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা করা হয়েছে।

কানাডায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে

সর্বশেষ কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে, জর্জ ব্র্যান্ডের শিশুদের গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা স্লিপার জাতীয় পোশাকটি এ পর্যন্ত যা বিক্রি হয়েছে, তা ক্রেতাদের থেকে পূর্ণ অর্থ পরিশোধ বাবদ ফেরত নিতে বলা হয়েছে চেইনশপ ওয়ালমার্টকে। গত ৪ অক্টোবরের ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জর্জ ব্র্যান্ডের এই স্লিপারগুলো বারবার ধোয়ার কারণে এর জিপার পুল এবং পায়ের গ্রিপ পড়ে যেতে পারে বা সরে যেতে পারে। এতে জিপার চেপে গিয়ে শিশুর দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে খুলে আসা পায়ের গ্রিপের টুকরাগুলো শিশুর মুখে চলে যেতে পারে। এসব কারণ দেখিয়ে ভোক্তাদের অবিলম্বে এই সিøপার ব্যবহার বন্ধ করা উচিত বলে কানাডার ওই ওয়েবসাইটে আহ্বান জানানো হয়। যদিও ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, কোম্পানিটি কানাডায় এ ধরনের কোন ঘটনা বা স্বাস্থ্য সমস্যার অভিযোগ পায়নি।

কানাডা কনজিউমার প্রোডাক্ট সেফটি অ্যাক্ট অনুযায়ী একবার যে পণ্য প্রত্যাহার করা হয় সেগুলো ওই দেশে পুনরায় বিতরণ, বিক্রি বা এমনকি বিনামূল্যে দেওয়াও নিষিদ্ধ। এছাড়া ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের বাজার থেকেও এভাবে পোশাক সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সেদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

প্রস্তুতকারকদের দায় কতোটা

ওয়ালমার্টের স্টোরগুলোয় গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত অন্তত ২ লাখ ১৬ হাজারের বেশি পিস সিøপার বিক্রি হয়ে গিয়েছে, যা এখন তাদের ফেরত নিতে হবে। সিøপারগুলো প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশের ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান এবং হংকংয়ের পিডিএস ফারইস্ট লিমিটেড সেগুলো বিতরণ করেছে বলে জানা যায়। ইউনিক ডিজাইনার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসৈয়দ ফরিদ আহমেদ জানিয়েছেন, তাদের গাজীপুরের কারখানায় জর্জ ব্র্যান্ডের ওই স্লিপারগুলো তৈরি করা হয়েছে। এখানে জিপার নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে সেই জিপার ওয়ালমার্টের অনুমোদিত স্লিক কোম্পানির। সেই সঙ্গে গ্রিপসহ পণ্যের সার্বিক সবকিছু মান পরীক্ষা শেষেই পাঠানো হয়েছে। তাই কানাডার সরকার যে অভিযোগ তুলেছে তা নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতকারকদের কোনো দায় নেই। এ নিয়ে ওয়ালমার্টও তাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি।’

সৈয়দ ফরিদ আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সিঙ্গাপুরভিত্তিক বায়িং হাউস পিডিএস-ফারইস্ট লিমিটেড আমাদের পণ্যের গুণমান পরীক্ষা করে এরপর ওয়ালমার্টে পাঠায়। পিডিএস আমাদের কাছে সমস্যার কথা বলেছে। আমরা বলেছি যে ওয়ালমার্ট যে মানের জিপার চেয়েছে আমরা সেটাই দিয়েছি। এখানে আমাদের কোন দায় নেই। ক্ষতি হয়েছে কোম্পানির’ তিনি যুক্ত করেন।

বাংলাদেশের প্রস্তুতকারকরা ইতিমধ্যে ওই অর্ডারের পেমেন্ট পেয়ে গিয়েছেন। তাই বাংলাদেশের এখানে কোন আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কাও নেই।

‘ওয়ালমার্ট আমাদের অর্ডার দেওয়া বন্ধ করেনি। আমাদের কারখানায় উৎপাদন চলছে। তবে এবার তারা আমাদের ভিন্নরকম জিপার লাগাতে বলছে, আমরা সেটাই করছি।’ বলেন মি. আহমেদ। পোশাকের এসব অলংকার শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পোশাকের এসব অলংকার শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

বিবিসি জানাচ্ছে, বিজিএমইএ যা বলছে, তা হলো-এ বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম বিবিসি বাংলাকে জানান, ‘ক্রেতারা অর্ডার দেওয়ার সময় পণ্যের যাবতীয় বিবরণ দিয়ে দেয় এবং আমরা সে অনুযায়ী বানাই। এরপর সব পণ্য পরীক্ষানিরীক্ষা করে কোম্পানির কাছে স্যাম্পল (নমুনা) পাঠানো হয়। সেখানে অনুমোদন পেলেই পণ্যগুলো পাঠানো হয়।’

মি. আজিম জানান, আমরা স্যাম্পল অনুযায়ী পণ্য তৈরি না করলে সমস্যা আমাদের, এক্ষেত্রে অর্ডারই বাতিল হয়ে যাবে, পণ্য বাজারে পৌঁছাবে না। তার মতে, পণ্য বাজারে পৌঁছেছে মানে এটি মান উত্তীর্ণ হয়েই গিয়েছে-তিনি বলেন। ‘এক কথায় তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পণ্য তৈরির পর যদি সমস্যা হয়, তাহলে সেই দায় আমাদের নয়।’ 

এদিকে সোয়েট শার্ট বা ট্রাউজারের ফিতা জড়িয়ে দুর্ঘটনার যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে এখানেও বাংলাদেশের প্রস্তুতকারকদের কোনো দায় নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। মি. আজিম বলেন, ‘পোশাকের ডিজাইন কেমন হবে, গলার মাপ, ফিতা থাকবে কি থাকবে না, সব তারা বলে দেয়, আমার শুধু তাদের ফলো করি। পণ্য একবার পাঠানো হয়ে গেলে আমাদের কিছু করার নেই।’

এ ব্যাপারে বিজিএমইএ এখন পর্যন্ত কোনো ক্রেতা দেশের থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগ পায়নি। ক্রেতাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী, পণ্য তৈরি করা হয়। ক্রেতাদের চাহিদা ও সরবরাহ করা ডিজাইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় পণ্য তৈরি করা হয় বলে কর্মকর্তারা বলছেন। এ ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে তিনি মনে করেন।

তবে তার মতে, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ঝুঁকির আশঙ্কা থাকা এসব পণ্যের প্রস্তুতকারক হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসায় অকারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রায়শই নানান দেশের পণ্যের ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। এতে ওই শিল্পে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়ার নজির নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।’

শেয়ার করুন