২০ মে ২০১২, সোমবার, ০৩:৩৫:২৯ পূর্বাহ্ন


‘সরকার উৎখাত’ প্রসঙ্গে হঠাৎ জনমনে প্রশ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৫-২০২৪
‘সরকার উৎখাত’ প্রসঙ্গে হঠাৎ জনমনে প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা/ফাইল ছবি


খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই কথা উচ্চারণ করেছেন। যাতে তার রয়েছে অনেক আক্ষেপ, জিজ্ঞাসা। গত ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশের কিছু লোক, যারা একেবারে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া-এদের কিছু বক্তব্য আর আমাদের দেশের কিছু আছে বুদ্ধি বেচে জীবিকা নির্বাহ করে, সেই তথাকথিত বুদ্ধিজীবী অনবরত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গিবত গাইছে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এ দেশের অতি বাম, অতি ডান-সবই এখন এক হয়ে গেছে, এটা কীভাবে হলো, আমি জানি না। এই দুই মেরু এক হয়েও সারাক্ষণ শুনি আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে হবে। অপরাধটা কী আমাদের?’

দ্বিতীয় দফায় অনেকটাই এক ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করেন তিনি থাইল্যান্ডে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সফর শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে। ২ মে’র ওই ব্রিফিংয়ে এক পর্যায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তারা (অতি বাম) পুরো ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। তিনি বলেন, ‘ধরে নিলাম তারা আমাকে উৎখাত করবে। কিন্তু এরপর কে আসবে ক্ষমতায়- তারা কি সেটা ঠিক করতে পেরেছে? সেটাই আমার প্রশ্ন- কে আসবে ক্ষমতায়? কে দেশের জন্য কাজ করবে? কাকে তারা আনতে চায় (ক্ষমতায়) সেটা কিন্তু স্পষ্ট নয় আর সেটা স্পষ্ট নয় বলেই তারা জনগণের সাড়া পাচ্ছে না।’ 

পরপর দুইস্থানে প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য দেশের সচেতন মহল থেকে শুরু করে সর্বস্তরে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। কথাগুলো তিনি এমন এক সময়ে বলেছেন, যখন তিনি একটি জাতীয় নির্বাচনে প্রায় সবগুলো আসনে জয় নিয়ে সরকার গঠন করেছেন। ৭ জানুয়ারির বিতির্কিত নির্বাচনের পর এখন মে মাস। ক’দিন হলো। তাছাড়া এটা তিনি টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করেছেন। ফলে সর্বস্তরে ব্যাপক জানাশোনা ও কতৃত্ব। তাকে বা আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করবে এমন দুঃসাহস দেশে অন্তত নেই এটা সর্বজন সমাদৃত। 

সরকার বিরোধী নাম ভূমিকায় অভিনয় করছে জাতীয় পার্টি। তারা অস্তিত্ব শুণ্য। গত ১৫ বছরে যাদের একটা মিছিল বা সম্মেলন হয়েছে আউটডোরে এমনটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংসদে তারা বিরোধী দল সেটা দয়া-দক্ষিণায় এটা তারা নিজেরাই বলছেন। এবং কেমন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে অমন প্রাপ্তি সেটা তারা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছেন। প্রকৃতঅর্থে বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলসমূহ। কিন্তু এসব দলের এমন শক্তিই নেই ক্ষমতাসীনদের উচ্ছেদ করার, ক্ষমতাচ্যুত করার। 

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনসহ কোনো নির্বাচনেই এ সরকারের অধীনে এসব বিরোধী দলসমূহ যাচ্ছে না। প্রতিরোধও করছে না তারা। সাধারণ জনগণকে বুঝানোর কাজটা করছে যে- ‘তোমরা এ অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেও না।’ ব্যাস এটুকুই। কিন্তু এমন কথাতেই কী সরকার পতন বা উচ্ছেদ হয়ে যাবে- সেটা অবুঝরাও বিশ্বাস করবে না। 

একই সঙ্গে এ দলসমূহ বড় আন্দোলনেও যাচ্ছে না এ অব্দি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ২৮ অক্টোবর একটা মহাসমাবেশ করেছিল পল্টনে। সেখানে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হলেও সে সমাবেশ শুরুর আগেই লাঠিপেটা ও তাড়া খেয়ে পালাতে বাধ্য হয় নেতাকর্মীরা। ব্যাপক ধরপাকড় এরপর। বাকিটা সবার জানা!

নির্বাচন হয়ে যেয়ে সরকার গঠনের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের এক এক করে মুক্তি দেয়া হয়। এখনও কোমড় সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি ও সমমনাদলগুলো। ওই সময়ের পর অদ্যাবদি একটা মহাসমাবেশ বা সমাবেশ করারও সাহস করতে পারেনি। 

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে ঠান্ডা। পিনপতণ নিরাবতা। এ দলগুলো নিজেরাই অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যস্ত। উপজেলাতে দলগুলোর নির্দেশনা ভঙ্গ করে অনেকেই অংশগ্রহণে তাদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এগুলো সামাল দিয়ে আরেকটা আন্দোলনের পাঁয়তারা করতেছে তাও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে। সেখানে ক্ষমতাসীনগন কোথায় পেলেন তাদের উৎখাতে এরা সোচ্চার হচ্ছে? জনমনে প্রশ্নটা এখানেই। 

বাংলাদেশে অতীতে যে রাজনৈতিক আন্দোলনের কালচার সেটা অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল, ধর্মঘট। ঘেরাও এসব কঠোর প্রতিরোধের আন্দোলন। তাও মাসের পর মাস, কখনও বছরব্যাপী চলার পর সরকার নরম হয়। বৈদেশিক চাপ বাড়ে। সরকার বাধ্য হয়। নতি স্বীকার করে বিরোধীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে অলোচনা করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণে স্বচেষ্ট হতে বাধ্য হয়। কিন্তু নতুন সরকারের এখনও ৬ মাসই হয়নি। বিরোধীরা অনেকটাই চুপচাপ, বিশ্রামে সে মুহূর্তে সরকারের তরফ থেকে ‘উৎখাত’ শঙ্কা!

বাংলাদেশে শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আন্দোলনে সরকারের পরিবর্তন হয় এমনটা এখন আর কেউ বিশ্বাস করেন না। এরসঙ্গে যুক্ত আছে বৈদেশিক শক্তিধরদের ইন্টারেস্ট। ওইসব স্বার্থে দুইয়ে দুইয়ে চার হয়। টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ বহু কাঠখড় পোড়ানো এক দল। এ উপমহাদেশে প্রবীণ এ দলটির বহুত অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে। কাকে কিভাবে সামাল দেয়া লাগবে সেটা তাদের চেয়ে কে ভাল বুঝবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে এখন দক্ষ। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে এসব কিছু তার নখদর্পনে। দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনীতির পদক্ষেপগুলো বেশ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে জানেন, এটা বাংলাদেশের মানুষও জানেন। কিন্তু এমনি মুহূর্তে এমন কী হলো যে তার মুখ থেকে হঠাৎ ‘সরকার উৎখাত’র এমন কথা বের হওয়া। সেটা যে তিনি এমনি এমনিই বলেছেন, বা কথার কথা বলেছেন বিষয়টা হালকা নয় বলেই আলোচিত হচ্ছে। 

তার এসব কথা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের কথাও উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে এখন অনেক দেশেরই স্বার্থের বিষয় জড়িত। নিজস্ব স্বার্থ বাস্তবায়নে বাংলাদেশে সঠিক উন্নয়ন ঘটুক সেটা অবকাঠামোগত, রাজনীতি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার থেকে শুরু করে সর্বত্র সেটা অনেকেই চায় না। নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে তারা নিজস্ব বলয়ের মধ্যে রেখে এসব কাজ করতে মুখে মুখে উৎসাহ যোগায়। কিন্তু বাংলাদেশ কিভাবে চলবে, কিভাবে এগিয়ে যাবে এটা শুধু বাংলাদেশের মানুষই ভাল জানেন। বাংলাদেশের মানুষ ঠিক করবেন। প্রধানমন্ত্রী এ কথাটাই বলে আসছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আমেরিকার কথা বারবার তিনি উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, তাদের দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার আগে তারা ঠিক করুক। আমাদের দেশে সে তুলনায় অনেক ভাল। শুধু আমেরিকা বলেই নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় যারাই নাক গলাতে আসেন, তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বহু আগ থেকেই এমন বক্তব্য দিয়ে আসছেন। এ বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষেরও। বাংলাদেশ ঠিক করবে তারা কোন পথে চলবে, কিভাবে চলবে। 

সাংবাদিকদের সঙ্গে শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের তো কিছু লোক রয়েছে, যারা সবসময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কানভারী করছে। তারা অনেক জ্ঞানী গুণী বুদ্ধিজীবী এবং তারা যখন সারাক্ষণ উল্টাপাল্টা বলতেই থাকবে, কিছুটা (বিদেশিরা) তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার দেশের মানুষইতো অনেকে প্রভাবিত হয়ে যায় আর বিদেশীরা তো হবেই। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু এসব কথায় প্রভাবিত হয় না। তারা কিন্তু ঠিক আছে। তাদের একটা আত্মবিশ্বাস আছে।’ 

অনেকটা একই প্রসঙ্গে ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের হামলার ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই দেশে মানবাধিকার কতটুকু আছে, সেটাই প্রশ্ন। কথা বলার স্বাধীনতা কতটুকু আছে, সেটাই প্রশ্ন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার কতটুকু আছে, সেটাই প্রশ্ন। বাংলাদেশের ওপর মানবাধিকারে রিপোর্ট লেখে, নিজেদের আয়নার চেহারা দেখে না। এটাই প্রশ্ন। 

প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে আরও বলেন, ‘মানবাধিকার সংস্থা, বিচার বিভাগ, যারা নিষেধাজ্ঞা দেয়, আমাদের ওপর খবরদারি করে, তাদের কাছে জবাব চাই। সেখানে আমার বাঙালি কেন মারা যাবে? ওই রকম ছোট্ট একটা শিশুকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে হত্যা করা! শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন করা, এর জবাব আমরা চাই। এটা তো সম্পূর্ণ মানবাধিকার লঙ্ঘন।’ 

সবশেষ

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রচন্ড একটা চাপ দেখেছিল বিশ্ব। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে মার্কিনীরা নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেছিল সেটাও। ওই কাজে সহযোগিতাকারীদের জন্য নতুন ভিসানীতিও প্রণনয় করে তারা। কিন্তু নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র অজ্ঞাত কারণে চুপ হয়ে যায়। অনেকেই বলছেন যে গত ১০ নভেম্বর দিল্লিতে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘টু প্লাস টু’ মন্ত্রী পর্যায়ের সংলাপে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন যে সংলাপে যোগ দিয়েছিলেন ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অর্থাৎ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কীভাবে আরও ‘মুক্ত, অবাধ, নিরাপদ ও সমৃদ্ধশালী’ করে তোলা যায়, এসব প্রসঙ্গে সাথে ছিল বাংলাদেশ প্রসঙ্গও। ওই বৈঠক শেষে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পিছুটান দেয়। এরপর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনটা কেমন হলো, ওই প্রেক্ষাপটটা কী ছিল, সেটা নতুন করে আর বলার কি! নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর তড়িৎ রেজাল্ট হওয়ার আগেই কে কে অভিনন্দন জানিয়েছে অনেক ইঙ্গিত ছিল। 

ফলে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দৃশ্যত শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, সোচ্চার ভারতও। এবং ওই দুইদেশ কার্যত একই ভূমিকায়। এ বিষয়টা এখন আর আড়ালে আবডালে নয় প্রকাশ্যেই যা ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গের বিশ্লেষণেও ফুটে উঠছে প্রতিনিয়ত! এমতাবস্থায় বাংলাদেশ তাদের নিজস্বতা নিয়ে কিভাবে এগুবে এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শেয়ার করুন