২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৬:১০:৩৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৩-২০২৩
যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ উদীচীর প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখছেন সুব্রত বিশ্বাস


যশোরে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলা প্রায় ২৪ বছর। এই ২৪ বছরেও এই ঘটনার বিচার হয়নি। বিএনপি-জামায়াত সরকারের কাছে বিচার চেয়েও পাইনি। উল্টো মামলাটি হিরাগারে চলে গিয়েছিল। স্বাধীনতার শক্তি এখন ক্ষমতায়। তারা প্রায় ১৪ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু তারাও এই হামলার বিচার করেনি। এই সরকারের কাছে আমরা বিচার প্রত্যাশা করেছিলাম কিন্তু আমাদের সেই প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি। এখন মনে হচ্ছে বর্তমান সরকারও একই পথে হাঁটছে। তাদের প্রশ্ন আমরা এখন কার কাছে বিচার চাইবো? তারপরেও বলতে চাই-এই নৃংশস হামলার বিচার করা হোক। গত ১২ মার্চ বিকেলে যশোর উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে হামলার বর্ষপূর্তিতে জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন। উদীচীর সভাপতি সুব্রত বিশ্বাসের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আলিম উদ্দিনের পরিচালনায় বিক্ষোভ সমবেশে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শরাফ সরকার, অধ্যাপক সৈয়দ মজিবুর রহমান, জাকির হোসেন বাচ্চু, বাবুল আচার্য, সুলেখা পাল, ওবায়দুল্লাহ মামুন, হিরো চৌধুরী, লিয়াকত আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মশিউর রহমান এবং ঘোষণা পত্র পাঠ করে সুপর্ণা সরকার রিমা।

সুপর্ণ সরকার রিমা ঘোষণা পত্রে বলেন, সাম্য, স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং একটি মানবিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের মুক্তিপাগল লাখো মানুষ। তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ভাই-বোনেরাও লাখো মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় ৩০ লক্ষ শহিদ, সম্ভ্রম হারিয়ে বীরাঙ্গনা নাম নিয়েছিলেন কয়েক লাখ মা-বোন। উদীচীর ভাই-বোনের রক্তস্রোতও মিশে একাকার হয়ে আছে তাদের সঙ্গে। শহিদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় মহান সংবিধানের চার মূলনীতি-গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, সেইসব মূলনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শসমূহ নানা ষড়যন্ত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। দেশজুড়ে অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে নারকীয় নানাবিধ সাম্প্রদায়িক তান্ডব। মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ অবরুদ্ধ, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত। বাংলার চিরায়ত সুর আজ রুদ্ধ। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আস্ফালনের কাছে সহজিয়া শিল্পীরা আজ কুণ্ঠিত। প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট বক্তৃতা বক্তব্য শুনে ও লেখাসমূহ পড়ে বেড়ে উঠছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। বিভিন্ন স্থানে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং এর আদর্শকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনকি জাতির পিতাকেও অবজ্ঞা অসম্মানিত করতে দ্বিধা করা হচ্ছে  না। 

তিনি আরো বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে উদীচী দেশ পুনর্গঠনে এবং সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে যশোহরে তিন দিনব্যাপী উদীচীর জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল। দেশ-বিদেশ থেকে উদীচীর ভাই-বোন এবং সম্মানিত অতিথি শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা উপস্থিত হয়েছেন। তখনই সম্মেলনের তৃতীয় দিন অর্থাৎ ৬ মার্চ বিকেলে অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে এক শক্তিশালী বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় ঘটনাস্থালে নিহত হন নূর ইসলাম, নাজমুল হুদা তপন, সন্ধ্যা রাণী ঘোষ, ইলিয়াস মুন্সী, শাহ আলম বাবুল, বাবুল সুত্রধর, শাহ আলম বুলু, রতন রায় ও রামকৃষ্ণ সহ ১০ জন। আহত হন দুই শতাধিক নারী পুরুষ। তাদের মধ্যে ৫০ জনের অধিক হাত-পা-চোখ হারিয়ে জীবনের মত পঙ্গু হয়ে যান। 

তিনি বলেন, পরিতাপের বিষয়, ঘটনার ২৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিচার আজও হয়নি। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কলঙ্কিত দিন হিসেবে চিহ্নিত করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী গত ২৪ বছর ধরে শহিদদের স্মরণে এবং বিচারের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। এবারও যথারীতি দেশ বিদেশের সব উদীচী সংগঠনের ভাই-বোনেরা সংগীত ও বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ সভার আয়োজন  করেছে। যুক্তরাষ্ট্র উদীচীর আজকের এই প্রতিবাদ সভা তারই অংশ। 

উল্লেখ্য, হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামসহ অন্যান্যরা। আদালত সূত্র মতে, ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। ইতিমধ্যে ২০০১ সালের নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার নির্যাতন। তরিকুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তার নাম বাদ দিয়ে দেন। মামলাও স্থবির হয়ে পড়ে। ২০০৬ সালের ৩০ মে যশোহর স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল আদালত বাকি ২৩ আসামিকে খালাস দিয়ে দেন। এরপর ন্যায়বিচার পেতে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুনঃতদন্তের আবেদন করলে মামলাটি বর্ধিত তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায় সরকারের আমলে হরকত-উল-জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান গ্রেফতার হলে ওই বছরের ১৯ নভেম্বর উদীচী বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। তার স্বীকারোক্তিতে পুলিশ হরকত-উল জিহাদের সদস্য বরিশালের আবুল হোসেন ও মাদারীপুরের মাওলানা আবদুর রউফকে আটক করে। এমনি অবস্থায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দায়িত্ব পেলে ২০০৬ সালে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। এর প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মামলায় খালাসপ্রাপ্তদের পুনরায় আত্মসমর্পণের জন্য সমন জারির নির্দেশ দেন। এ সংক্রান্ত একটি আদেশ ২০১১ সালের ২০ জুন যশোহর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদলতে পৌঁছায়। এরপর ২১ জুন খালাসপ্রাপ্ত ২৩ আসামীর বিরুদ্ধে সমন জারি করেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এর মধ্যে তরিকুল ইসলাম, মহিউদ্দিন আলমগীর, আহসান কবীর হাসান ও মিজানুর রহমান মিজান মারা গেছেন। অবশিষ্ট ২০ আসামীর মধ্যে ১৭ জন বিভিন্ন সময়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়েছেন। পরে এদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম নামে এক আসামি খুন হন। আর ৩ জন শফিকুল ইসলাম মিন্টা, শফিফুল ইসলাম লিটু ও সোহরাব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করায় তাদের বিরুদ্ধে ২৪ জুলাই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আটক হন এ মামলার অন্যতম আসামি শফিকুল ইসলাম মিন্টু। পরে আদালত থেকে জামিন পেয়ে তিনি মুক্ত ছিলেন। এরপর থেকে মামলার কার্যক্রম আর এগোয়নি।

তিনি বলেন, ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য এই হত্যাকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় গত ২৪ বছরেও কোনো বিচার হয়নি। সরকার প্রথমে বাদী হয়ে মামলা করে এবং প্রহসনের বিচার করে। পরে উদীচীর পক্ষ থেকে পুনঃতদন্তের জন্য আবেদন করা হলে সেটা গৃহীতও হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে মামলা কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। আমরা জানি না, স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বে কোন অদৃশ্য কারণে বারবার তাগিদ দেয়ার পরও সরকার জাতীয় ও স্থানীয় প্রশাসন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি এবং করছে না। তাই দেশ বিদেশের উদীচীর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি অবিলম্বে বিচার কার্যক্রম শুরু করে মামলার নিষ্পত্তি করা হোক।

শেয়ার করুন