২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ০৭:৪৪:১১ পূর্বাহ্ন


শহিদ জননীর ২৮ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি
সার্বজনীন মাতৃরূপে শহিদ জননী জাহানারা ইমাম
রুবিনা হোসেন
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৬-২০২২
সার্বজনীন মাতৃরূপে শহিদ জননী জাহানারা ইমাম


বাস্তবে তিনি ছিলেন দু’পুত্র সন্তানের জননী। স্বামী ছিলেন প্রকৌশলী এবং নিজের কর্মজীবন ছিল শিক্ষকতাকেন্দ্রিক। সমাজের অন্য দশজন নারীর মতো তাঁরও ছিল এক সুখী গৃহকোণ। কিন্তু তিনি ছিলেন আলাদা। অতুলনীয় সে․ন্দর্য, প্রখর ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ, পরিমিতিবোধ, অসম সাহস এবং সর্বোপরি জীবনদর্শন জীবনের প্রথম থেকেই তাঁকে অন্য সকলের থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

তাঁর এই স্বাতন্ত্রবোধই তাঁকে পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনগণের নেতৃত্বের প্রথম সারিতে এনে দাঁড় করিয়েছিল। দু’পুত্র সন্তানের আম্মা আজ তাই সকল প্রজন্মর ‘আম্মা’ হিসেবে পরিচিত। সার্বজনীন মাতৃরূপী শহিদ জননী জাহানারা ইমাম এর আজ ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেও তিনি রয়ে গেছেন সকল প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে। মহিয়সী এই নারীর জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট পিতা  সৈয়দ আব্দুল আলীর তত্ত্বাবধানে তিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এড করেন।

একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নেন। শিক্ষায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে ফেলোশীপ  নিয়ে দু’বার যুক্তরাষ্ট্র যান। কর্মজীবনে ১৯৫২ থেকে ৬০ সাল পর্যন্ত তিনি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল এর প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং দুই বছর কর্মরত ছিলেন।

প্রথমে তিনি পরিচিত ছিলেন শিশু সাহিত্যিক হিসেবে, পরবর্তীকালে ছোটগল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর রচিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাঁথা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ তাঁকে এনে দিয়েছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।

সুসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত জাহানারা ইমামের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: অন্যজীবন, ক্যান্সারের সাথে বসবাস, বীরশ্রেষ্ঠ, বুকের ভিতর আগুন, নিঃসঙ্গ পাইন, নাটকের অবসানে, দুই মেরু। ১৯৯০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরুস্কার  ছাড়াও তিনি সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরুস্কার , অনন্যা সাহিত্য পুরুস্কার  লাভ করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন আঙ্গিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধে জড়িয়ে যায় তাঁর পুরো পরিবার। মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গ করে দেন নিজের প্রাণপ্রিয় জ্যেষ্ঠ সন্তান রুমীকে। তিনি জানতেন যুদ্ধের ভয়াবহতায় রুমীকে তিনি হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং বাস্তবে হয়েছিলও তাই। রুমীকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বামীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন- টাকা পাঠানো থেকে শুরু করে নিজ হাতে খাওয়ানো পর্যন্ত। ২৯ আগস্ট দু’পুত্র এবং স্বামী শরীফ ইমামকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।

দুদিন পর অমানুষিক নির্যাতন শেষে স্বামী ও ছোট ছেলে ফিরে এলেও মুক্তিযোদ্ধা পুত্র রুমী আর ফিরে আসেনি। ছেলের শোক এবং নির্যাতনকেন্দ্রে অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শরীফ ইমাম ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সব হারিয়ে ফেলার পরও তাঁর মাতৃত্বের আবেদন এতোটুকু কমেনি। ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধাদের মায়ের মর্যাদাতেই আসীন ছিলেন আমৃত্যু। স্বাধীনতার পর হৃদয়কে পাথর করে তরুণ প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে গেছেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’।

জাহানারা ইমামের চরিত্রের অন্যতম প্রধান দিক ছিল গভীর দেশপ্রেম। আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। পাকিস্তানি ক্সসন্যদের হাতে তাঁর তরুণ মুক্তিযোদ্ধা পুত্রের মৃত্যু এবং স্বামীর জীবনাবসান তাঁকে নিঃসঙ্গ করে ফেললেও প্রবল জীবনবাদের কারণেই তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। তিনি চিন্তায় ও চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। নিরহংকারী, নম্র, বিনয়ী জাহানারা ইমামের জীবনে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা ও অধ্যবসায় ছিল। তাঁর মাঝে ছিল বাঙালির ঐতিহ্যবাহী  সাংস্কৃতি , সামাজিক আচার-আচরণ, রুচি এবং আধুনিক জীবনের এক অপূর্ব সমন্বয়। জাহানারা ইমামের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, চমৎকার বাচনভঙ্গী, অপার সৌন্দর্য  এবং অমায়িক ব্যবহার মধ্য দিয়ে নিমিষেই পরকে আপন করে নেওয়ার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল।

মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত কোনো মানুষের পক্ষে অবধারিত ভবিতব্য জানার পরেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে নিজের যাবতীয় কর্তব্য সুসম্পন্ন করা, রুচি সৃজনশক্তি ও পরিমিতিবোধ অটুট রাখা সম্ভবপর নয়। কিন্তু জাহানারা ইমাম সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন। জাহানারা ইমামের শক্তি ও তার প্রচন্ডতা প্রকাশ পায় রোগের দুঃসহতার ভেতরেও ক্রমাগত মননচর্চায় নিয়োজিত থাকায়, একটির পর একটি বই লিখে যাওয়ায় এবং দেশের ভয়াবহ রাজ‣নতিক দুঃসময় ও ক্সনতিক অবক্ষয়ে গর্জে ওঠার সাহসে। খুব বড় মাপের মানুষদের পক্ষেই এটা সম্ভব।  মৌলবাদী , ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অশুভ গোষ্ঠী এবং স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ঠিক তখনই জাহানারা ইমাম তাঁর আশ্চর্য সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে

তাদের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করা শুরু করেন, সোচ্চার হন একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতক এদেশীয় দালালদের বিচার করতে। জাহানারা ইমামের মাঝে ছিল সাংগঠনিক দক্ষতা, বিরল নেতৃত্বের গুণাবলী এবং সাহসিকতার অপূর্ব সমন্বয়। মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে তিনি একজন দক্ষ সংগঠক ও নেত্রী হিসেবে তাঁর যোগ্যতার স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন, সংগঠিত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে।

আন্দোলনকালীন তৎকালীন সরকারের বৈরী  আচরণ, রাজাকারদের আস্ফালন, দুরারোগ্য ব্যাধির যন্ত্রণা কোন কিছুই তাঁকে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য হতে বিচ্যুত করতে পারেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন এবং একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার জননী হওয়া যেমন ছিল গৌরবের, তার চেয়ে অধিকতর গে․রবময় অধ্যায় ছিল তাঁর জীবনের শেষ আড়াই বছর। বাংলাদেশে জামায়াত-শিবির চক্রের ফ্যাসিস্ট সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদেরকে সামাজিক ও রাজ‣নতিকভাবে নির্মূল করার জন্য জাহানারা ইমাম যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মৃত্যুশয্যায় বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশ্যে

রেখে যান তাঁর নির্দেশ- “একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী-বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ‘৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। জয় আমাদের হবেই।”

বলার অপেক্ষা রাখে না যে বর্তমানে চলমান যুদ্ধাপরাধীর বিচার শহিদ জননী জাহানারা ইমামেরই অবদান। তীব্র দহন যন্ত্রণায় কাতর এই জননী তাঁর ব্যক্তিগত শোককে অমোঘ শক্তিতে রূপান্তরের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি দেখে যেতে পারেননি ঠিকই কিন্তু দুই যুগ পূর্বে যুদ্ধাপরাদীদের ফাঁসির দাবীতে তাঁর আহূত আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই আজ বাঙালি জাতি কলংকমুক্ত হতে পেরেছে।

এই সাহসী জননীর ২৮ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতির গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ।

শেয়ার করুন