১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৭:২৩:৪৬ অপরাহ্ন


ইশরাক কারাগারে মেসেজ কী?
হতাশা ঢাকতে কঠোর সরকার
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৪-২০২২
হতাশা ঢাকতে কঠোর সরকার কারাগারের পথে পুলিশ ভ্যানে হাস্যজ্জোল ইশরাক : ফেসবুক ছবি


কারাগারের নতুন ঠিকানায় বিএনপির তরুণ নেতা ইশরাক। বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। এটা পুরোনো খবর। গত ৬ এপ্রিল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহা শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক। 

গণমাধ্যমের খবর হচ্ছে ৬ এপ্রিল সকালে রাজধানীর মতিঝিল থেকে ইশরাক হোসেনকে আটক করা হয়। সকালে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে মতিঝিল এলাকায় জনসচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণের সময় ইশরাককে আটক করা হয়। আটকের পর ২০২০ সালের একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করে পুলিশ। আটকের কারণ হিসেবে জানতে চাইলে গণমাধ্যমে মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এনামুল হক মিঠু জানান, গাড়ি পোড়ানোর একটি মামলায় ইশরাক হোসেন এক নম্বর আসামি। এই মামলায় ওয়ারেন্ট থাকায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইশরাকের আইনজীবী জামিন আবেদন করলে তা নামঞ্জুর করে। এবং তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

বলা হয় ২০২০ সালের মতিঝিল থানার বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা ওই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিনে ছিলেন ইশরাক। উচ্চ আদালতের আদেশ মোতাবেক আত্মসমর্পণ না করায় ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন। ২৬ মে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচন বানচাল করতে আসামিরা একত্রিত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপরীত পাশে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পুড়িয়ে মারার উদ্দেশে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে অল্পের জন্য গাড়িতে থাকা যাত্রীরা প্রাণে বেঁচে যায়।

ইশরাক গ্রেফতার পরবর্তী ঘটনা

গণমাধ্যমের খবরে বলা হয় গাড়িতে আগুন দিয়ে নাশকতার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেফতার বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে ‘ছিনিয়ে নিতে’ পুলিশের প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়েছেন তার সমর্থকরা। বুধবার দুপুরে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তখন তাকে আদালত থেকে কারাগারে নেয়া হচ্ছিল। হামলা ও সংঘর্ষে চার পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। তাদের মধ্যে এএসআই শাহীনের শরীরে রাবার বুলেটবিদ্ধ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হামলাকারীদের লাঠিচার্জ করার পাশাপাশি রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ। অন্যদিকে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে আদালত থেকে কারাগারে নেয়ার পথে তাকে বহনকারী প্রিজনভ্যানে হামলার ঘটনায় দলটির ১২ নেতাকর্মীকে একদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী এ আদেশ দেন। রিমান্ডে যাওয়া আসামিরা হলেন, মনিরুজ্জামান মনি, ইমতিয়াজ হাসান জনি, রাসেল, আলাউদ্দিন, ওবায়দুর রহমান পারভেজ, ওলি, সোয়েব হোসেন, ইমরান, শহিদুল হক ওরফে শহিদুলাহ, সেন্টু, কুতুব উদ্দিন মন্ডল ও আব্দুর রব। এছাড়া ইমরান হোসেন মাসুদ, গোলাম মোস্তফা পিয়ার, আশরাফ উদ্দিন, শাকিল আহম্মেদ মিলন, মাসুদ ও ইব্রাহীমের রিমান্ড ও জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। আর মামলায় এজাহারভুক্ত ৮৮ জনসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের দুইশ থেকে আড়াইশো জনকে আসামি করা হয়।

ঘটনার নেপথ্যে কি? স্যাবোটাজ?

এ হলো বিএনপি নেতা ইশরাক গ্রেফতার ও এর পরের ঘটনার আদ্যোপান্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে তখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে দেশ-বিদেশে কি আলোচিত হচ্ছিল। ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওইদিন দেশের পত্র-পত্রিকায় সবার চোখ ছিল একটি খবরের ওপর। তাহলো ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বৈঠক। দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে পররাষ্ট্র দফতরে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলাফল জানতে দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে ছিল। যদিও এর আগের একটি ঘটনা বিএনপিকে হতাশ করে আওয়ামী লীগকে করে বেশ চাঙ্গা। তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা চিঠির খবরটি। এতে সরকার ও তাদের দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেশ চাঙ্গা অনুভব করে। কিন্তু পরের দিন বেলা বাড়ার সাথে খবর আসে র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা তুলতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার হতে হবে বলে। এমন মন্তব্য ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের। তার মন্তব্যে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় গত বছর ডিসেম্বরে। এছাড়া আরো অনেক ঘটনা ঘটে এর পর পরে। এসব নিয়ে সরকার বেশ অস্বস্তিতে ছিল। এরই মধ্যে ৫ এপ্রিল দেশে পত্র-পত্রিকায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সাথে বৈঠকের খবরে অন্যরকম পরিস্থিতি দেখা দেয়। 

এমন খবর নিয়ে যখন তোলপাড় তখনই খবর আসে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর এর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় হাতে হ্যান্ডক্যাপ পরা ছবি। বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে নানান ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। কারো কারো মতে, ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের কারাগারের যাওয়াও ঘটনাটি ওইদিনের জন্য অর্থাৎ ৫ এপ্রিলের জন্য বিব্রতকর ছিল। কেননা সরকারের বিরুদ্ধে দেশে সুশাসনের ঘাটতির পাশাপাশি মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে জোরেশোরে। কেননা গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার' অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন অর্থ দফতরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ খবর প্রকাশিত হয় গত বছরে। এতে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অন্তর্ধান ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয় র‌্যাবের বিরুদ্ধে। কিছু রিপোর্টে আভাস পাওয়া যায় যে এসব ঘটনায় বিরোধীদলীয় সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের টার্গেট করা হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করে ইশরাক হোসেনের কারাগারের যাওয়াও ঘটনাটি ওইদিনের জন্য অর্থাৎ ৫ এপ্রিলের জন্য অন্যরকম ছিল। কেননা তখন আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে এমনকি দেশে অনেকে বক্তব্য দিতে সুবিধা পাবে যে বাংলাদেশে ঠিকই বিরোধীদলীয় সদস্য হেনস্তা বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এভাবেই মেসেজটি দেশে বিদেশে প্রভাব ফেলবে। আর এতে বলা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সঠিক। এতে সরকার আরো বেকায়দায় পড়বে। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এমন সময়ে ইশরাক হোসেনের কারাগারের যাওয়াও ঘটনাটি সরকারের ভেতরে কেউ কি স্যাবোটাজ করেনি তো?

অন্য মেসেজ কি হতে পারে?

ইশরাক হোসেনের কারাগারের যাওয়ার ঘটনাটিতে আরো অন্যরকম মেসেজ হতে পারে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন। তাদের মতে, রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা খবরের পর থেকে তাদের মধ্যে এমন চাঙ্গা ভাব। অন্যদিকে সরকার ও তার দল আওয়ামী লীগসহ শরিকরাও নানান ধরনের হতাশার মধ্যে আছে। এছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বিএনপি বেশ দাবড়িয়ে সভা-সমাবেশে করে যাচ্ছে। 

সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কঠের মনোভাব দেখাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ইশরাক হোসেনের কারাগারের যাওয়াও ঘটনাটিতে অন্য আরেকটি মেসেজ দিচ্ছে দেশবাসীকে। তাহলো সরকার মোাটেও ভীত বা বিব্রতকর অবস্থায় নেই। বরং পাল্টা হুংকার সরকারের যে তারা শক্ত অবস্থানেই আছে। শুধু তাই নয় বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে আদালত থেকে কারাগারে নেয়ার পথে তাকে বহনকারী প্রিজনভ্যানে হামলার ঘটনায় দলটির ১২ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আর তাদেরকে একদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। ফলে সরকার জানান দিতে চায় যে তারা নরম অবস্থানে নেই বিএনপির আন্দোলনের ব্যাপারে। যে কোনো পরিস্থিতিতে সরকার যে সক্রিয় তা তারা প্রমাণ করতেই এমন ঘটনা বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। 

কেননা এর আগেও দেখা গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে গত মাসে সারাদেশে জেলা পর্যায়ে যে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়, তাতে বিভিন্ন জেলায় এ কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলা হয়।  এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক। অন্যদিকে বাম জোটের হরতালের শেষ মুহূর্তে পল্টনে লাঠিপেটা করেছে পুলিশ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে গত ২৮ মার্চ বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাকা আধাবেলা হরতালের শেষভাগে এসে পুলিশের সঙ্গে বাম জোটের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

এছাড়া পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলায় হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা বিএনপির নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ৯ এপ্রিল রাতে তাঁকে উপজেলা সদর থেকে গ্রেফতার করা হয়, অন্যদিকে নাশকতার মামলায় চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহম্মেদকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত ১০ এপ্রিল আদালতে হাজিরা দিয়ে জামিন আবেদন করলে জেলা দায়রা জজ এস এম জিয়াউর রহমান জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠান। বিষয়গুলো সম্পূর্ণ আদালতের হলেও এসব ঘটনায় সরকারের শক্ত অবস্থানকেই জানান দিচ্ছে বলেই রাজনৈতিক পর্যরেক্ষক মহল মনে করেন। 


শেয়ার করুন